নবিগণ এক বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মানুষ। নবিগণ অতি মানব নন কিংবা মানব সৃষ্টির বহির্ভূত কোনো প্রাণী নন। মানুষের সমাজে মানুষের মধ্য হতেই তাঁরা বাছাই হয়েছেন। নবিগণ ছিলেন নিস্পাপ, নিষ্কলুষ এবং সাধারণ মানব চরিত্রের চেয়ে ব্যতিক্রমী আদর্শের। মানবীয় বৈশিষ্ট্যের বিচারে তারা একই শ্রেণির হলেও তারা অন্য আর দশজন মানুষের মতো সাধারণ মানুষ ছিলেন না। কোনো মানুষ মানবীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে ভুল করতে থাকে, কিন্তু আল্লাহ কখনো কোনো নবিকে ভুলের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখেননি। তারা আল্লাহর পক্ষ হতে প্রেরিত মহামানব। যাদের মূল দায়িত্ব ছিলো মানুষকে সত্য ও সুন্দরের পথে আহ্বান জানানো, কল্যাণের পথে আহ্বান জানানো। আল্লাহ মানব চরিত্রে যে ধরনের বৈশিষ্ট্য দেখতে চান, সে বৈশিষ্ট্যে মানুষকে গড়ে তোলা। নবিগণ আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এক মহাপুরুষ। মানব জাতির কল্যাণের জন্যই আল্লাহ যুগে যুগে অসংখ্য নবি পাঠিয়েছেন। নবিদের মধ্য হতে যারা মর্যাদার দিক থেকে অগ্রগণ্য তাদেরকে বলা হয় রাসুল। কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী পৃথিবীতে মোট চারজন রাসুল আগমন করেছেন। আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি ও রাসুল।
মানুষকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে। মানুষ এ প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালন করবে আল্লাহর দাসত্ব ও গোলামীর মাধ্যমে। মানুষ এই বিশ্ব চরাচরে এক স্বাধীন সত্তা। মানুষের স্বাধীনতা অবাধ নয়, তাকে একটি জীবন প্রণালী বা জীবন যাপন পদ্ধতি বাতলে দেওয়া হয়েছে। এই জীবন যাপন পদ্ধতিকে আল্লাহর পক্ষ হতে বলা হয়েছে হেদায়েত। যে হেদায়াতের বাণী অনুযায়ী দুনিয়ার জীবন পরিচালনা করবে তার জীবন সফলকাম হবে এবং তাঁর সৃষ্টির উদ্দেশ্য পূর্ণতা লাভ করবে। উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে হেদায়াতের পথ অনুসরণ না করে যে নিজ ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতাকে বল্গাহীনভাবে পরিচালনা করবে সে তার সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করবে, পরিণামে তার জীবনও ব্যর্থ হবে। মানুষের পরিচয় ও তার মূল কর্তব্য সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ঘোষণা, “নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে খলিফা প্রেরণ করতে চাই।” (সুরা বাকারা: ৩০)
এই খলিফার দায়িত্ব বা কর্তব্য কি হবে সে সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘‘আমি মানুষ ও জিন জাতিকে আমার ইবাদত ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি।’’ (সুরা আয যারিয়াত: ৫৬)
মানুষ কিভাবে আল্লাহর দাসত্ব করবে এ জন্য মানুষেরই মধ্য হতে আল্লাহ যুগে যুগে নবি ও রাসুল প্রেরণ করেছেন। নবি রাসুলগণও আল্লাহর প্রতিনিধি। মানুষের প্রতিনিধিত্ব ও নবি রাসুলগণের প্রতিনিধিত্বের মধ্যে পার্থক্য হলো, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবি রাসুলদেরকে বিশেষভাবে বাছাই করেছেন, তাঁরা আল্লাহর প্রিয় মানুষ। তাঁরা সরাসরি আল্লাহর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়েছেন। যারা পূতঃপবিত্র জীবনের অধিকারী। যারা কখনোই নিজ ইচ্ছা খুশির মাধ্যমে নিজের জীবনকে পরিচালিত করেননি। পৃথিবীতে আল্লাহর আদেশ, নির্দেশ ও ইচ্ছার বাস্তবায়নই নবিদের কাজ। নবিগণ মানুষকে কেবলমাত্র আল্লাহর দাসত্বও গোলামির দিকে আহ্বান জানিয়েছেন। যুগে যুগে আল্লাহ মানুষকে সঠিক পথের দিশা দেওয়ার জন্য অসংখ্য নবি ও রাসুল পাঠিয়েছেন। আল কুরআনে মাত্র পঁচিশ জন নবির নাম এসেছে। হাদিসেও বেশ কয়েকজন নবির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। নবিদের মোট সংখ্যা কত, তা কুরআনে বর্ণনা করা হয়নি, তবে কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী আমরা বুঝতে পারি এমন কোনো জনপদ নেই যেখানে আল্লাহ নবি পাঠাননি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘‘আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে এ মর্মে রাসুল পাঠিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো ও ‘তাগুত’ বর্জন করো। অতঃপর তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক মানুষকে আল্লাহ সৎ পথে পরিচালিত করেন এবং কিছু সংখ্যকের জন্য বিপথগামিতা অবধারিত হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো, অস্বীকারকারীদের পরিণতি কী হয়েছে।’’ (সুরা নাহল: ৩৬)
পৃথিবীর ইতিহাস এ কথাই সাক্ষ্য দেয় যে, যখনই কোনো জনপদে নবি পাঠানো হয়েছে সেখানকার মানুষেরা প্রথমে সেই নবির বিরোধিতা করেছে। নবির আহ্বানে সাড়া দেয়নি। নিজেদের ইচ্ছা এবং খামখেয়ালীপনাকে পুঁজি করে তারা নবির আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেছে। নবিগণ জাজ¦ল্যমান সত্যের ভিত্তিতে তাদের ন্যায় ও কল্যাণের দিকে আহ্বান জানালেও প্রতিটি জাতির মধ্যে অবাধ্যতা এবং অস্বীকৃতির মাত্র ছিলো বেশি। এ অস্বীকৃতি এবং অবাধ্যতার মূল কারণ ছিলো, তাদের প্রতিপত্তি, গর্ব অহংকার আর নিজেদের খামখেয়ালীপনোকে প্রাধান্য দেওয়া। তারা যাতে বশ্যতা স্বীকার করে এ জন্য প্রতিটি জনপদে যখন নবি পাঠিয়েছেন তাদেরকে নানারকম দুর্যোগ দুর্বিপাক দিয়ে কষ্টের মধ্যে অবতরণ করিয়েছেন। এ কষ্ট ও দুর্বিপাক এ জন্য ছিলো যাতে তারা আল্লাহর দিকে ফিরে আসে। এ কথাই আল্লাহ এভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘‘আমি কোনো জনপদে এমন কোনো নবিই পাঠাইনি যেখানকার অধিবাসীদেরকে অভাব-অনটন আর দুঃখ-কষ্ট কশাঘাত করেনি যাতে তারা নম্রতা ও কাতরতা প্রকাশ করে।’’ (সুরা আরাফ: ৯৪)
আল্লাহ একই কথা ভিন্ন ভাষায় বর্ণনা করেছেন। এক একটি জনপদে আল্লাহ প্রথমে নবি পাঠিয়েছেন। এরপর বার বার সতর্ক করেছেন। সতর্ক করার পর নানা রকম বিপদ দিয়েছেন। দুঃখ কষ্টে জর্জরিত করেছেন, যাতে তারা নবির আহ্বানের দিকে ফিরে আসে। বার বার সতর্ক করা, বিপদ আপদ দিয়ে সতর্ক করার পরও যখন তারা নবির আহ্বানে কর্ণপাত করেনি তখন সেই জনপদকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
‘‘আর আমি এমন কোনো জনপদকে ধ্বংস করিনি, যাতে কোন সতর্ককারী আসেনি।’’ (সুরা আশ শুয়ারা: ২০৮)
আল্লাহ প্রত্যেক জাতির মধ্যে নবি পাঠিয়েছেন। হয়তো আমাদের কাছে এ তথ্য নেই, যে অতীতে পৃথিবীতে কতগুলো জাতি ছিলো, বা কোন জনপদে কতগুলো জাতির জনগণ বসবাস করতো। তবে কুরআনের ঘোষণা হচ্ছে, আল্লাহ প্রত্যেক জাতির জন্য নবি পাঠিয়েছেন। আর এমনও হয়নি যে, একজন নবি পাঠাবার পর সেই জাতির কাছে আর কখনো নবি পাঠানো হয়নি। একজন নবি অতীত হয়ে যাওয়ার পর সেই জাতির জনগণ যখন নবিদের শিক্ষা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছে তাদের কাছে আবার নবি পাঠিয়েছেন। কোনো জাতি নবির আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেছে কিংবা নবির আহ্বানে সাড়া দেয়নি এ জন্য আর কখনো নবি পাঠানো হয়নি, বিষয়টি এমন হয়নি, আল্লাহ তাদের কাছে বার বার নবি পাঠিয়েছেন। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘‘পূর্ববর্তী জাতিগুলোর মধ্যে আমি বার বার নবি পাঠিয়েছি।’’ (সুরা যুখরুফ: ০৬)
‘‘এবং নিশ্চয়ই আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছি এবং তার পরে ক্রমান্বয়ে (একের পর এক) রসুলদেরকে প্রেরণ করেছি, মারইয়াম পুত্র ঈসাকে সুস্পষ্ট প্রমাণ দিয়েছি এবং পবিত্র রূহের মাধ্যমে (জিবরাঈলের মাধ্যমে) তাকে শক্তিশালী করেছি, অতঃপর যখনই কোনো রসুল এমন কিছু এনেছে যা তোমাদের মনঃপুত নয়, তখনই তোমরা অহংকার করেছো এবং কিছু সংখ্যককে অস্বীকার করেছো এবং কিছু সংখ্যককে হত্যা করেছো।’’ (সুরা বাকারা: ৮৭)
একইভাবে আল্লাহ মূসা (আ.) এর মাধ্যমে জানালেন যে, তিনি অতি অল্প সংখ্যক নবির নাম তাকে জানিয়েছেন, এ ছাড়া অসংখ্য নবি তিনি পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।
“আর অনেক রাসুল, যাদের বর্ণনা তোমাকে পূর্বে দিয়েছি এবং অনেক রাসুল, যাদের বর্ণনা তোমাকে দেইনি আর আল্লাহ মূসার সাথে সুস্পষ্টভাবে কথা বলেছেন।” (সুরা নিসা: ১৬৪)
আল্লাহ মানব জাতির হেদায়াতের জন্য একই জাতির মধ্য হতে অসংখ্য নবি পাঠিয়েছেন। যা তিনি বিভিন্নভাবে কুরআনে বার বার বর্ণনা করেছেন। “আর আমি তাকে দান করেছি ইসহাক ও ইয়াকুবকে। প্রত্যেককে আমি হেদায়াত দিয়েছি এবং নূহকে পূর্বে হেদায়াত দিয়েছি। আর তার সন্তানদের মধ্য থেকে দাঊদ, সুলাইমান, আইয়ুব, ইউসুফ, মূসা ও হারুনকে। আর আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদেরকে প্রতিদান দেই।” (সুরা আনআম: ৮৪)
আল্লাহ প্রত্যেক ভাষাভাষীর জন্য পৃথক নবি পাঠিয়েছেন। এমন কখনো হয়নি যে, এক ভাষার লোকের জন্য ভিন্ন ভাষার নবি পাঠিয়েছেন। বরং যখন যে জনপদে নবি পাঠিয়েছেন, তখন সেই ভাষার এবং জাতির মধ্য থেকে নবি পাঠিয়েছেন। যাতে সেই জনপদের লোকেরা বলতে না পারে যে, নবি যেই ভাষায় কথা বলে, তা আমরা বুঝতে পারি না। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেন, ‘‘আর আমি প্রত্যেক রাসুলকে তার কওমের ভাষাতেই পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের কাছে বর্ণনা দেয়, সুতরাং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সঠিক পথ দেখান। আর তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’’ (সুরা ইবরাহীম: ০৪)
এই যে ভাষা ও বর্ণের পার্থক্য তাও যে, আল্লাহর দান তা আল্লাহ খুলে খুলে বর্ণনা করেছেন। যাতে পৃথিবীর এক জাতি থেকে আর এক জাতির পার্থক্য নির্ণয় করতে সহজ হয়। এক জাতি থেকে আর এক জাতির স্বাতন্ত্র বোঝা যায়। সকল স্বতন্ত্র জাতির জন্যই আল্লাহ পৃথক নবি পাঠিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘‘আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আসমান ও জমিনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও তোমাদের বর্ণের ভিন্নতা। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য।’’ (সুরা রুম: ২২)
এভাবে আল্লাহ প্রতিটি জনপদ, প্রতিটি নগর, গ্রাম, জাতি আর ভাষাভাষির লোকের মাঝে নবি পাঠিয়েছেন। নবি পাঠানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে পূর্বেই বলা হয়েছে। আল্লাহ নবির মাধ্যমে মানুষকে তাঁর দিকে আহ্বান জানিয়েছেন। নবিরা মানুষদেরকে এক আল্লাহর দাসত্ব ও নবির আনুগত্য করার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা আহ্বান জানিয়েছেন সত্য, সুন্দর ন্যায় ও কল্যাণের দিকে। মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন ভালো কল্যাণের বিষয়গুলো, তাদেরকে সতর্ক ও সচেতন করেছেন। তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করেছেন। মানুষের চরিত্রকে পরিশুদ্ধ করেছেন, তাদের জীবনকে পরিশীলিত করেছেন। নবিদের দাওয়াতের মূল ভিত্তি ছিলো তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদ। পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম (আ.)-ই প্রথম নবি। তিনি তার সন্তানদেরকে আল্লাহর হুকুমে পরিচালনার জন্য আমৃত্যু চেষ্টা করেছেন। পৃথিবীর সকল মানুষের আদি পিতা হযরত আদম (আ.) এবং সৃষ্টি পরম্পরায় মূলত সকল মানুষই আদমের সন্তান। এ জন্য আল্লাহ আদালতে আখিরাতে সকল মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলবেন ‘‘হে আদম সন্তানেরা আমি কি তোমাদের এ মর্মে হেদায়াত করিনি যে, শয়তানের বন্দেগী করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’’ (সুরা ইয়াসিন: ৬০)
নবিদের দাওয়াত সম্পর্কে আল্লাহ কুরআনে বলেন, ‘‘আমি নূহকে তার কওমের নিকট প্রেরণ করেছি। অতঃপর সে বলেছে, “হে আমার কওম, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য মহাদিনের আযাবের ভয় করছি।’’ (সুরা আরাফ: ৫৯)
এই একই আহ্বান জানিয়েছেন হুদ (আ.)। তার সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘‘আর আদ জাতির কাছে (পাঠিয়েছিলাম) তাদের ভাই হূদকে। সে বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের অন্য কোনো ইলাহ নেই, তোমরা কি তাক্বওয়া অবলম্বন করবে না?’’ (সুরা আরাফ: ৬৫)
হযরত সালেহ (আ.) কে পাঠানো হয়েছিলো সামুদ জাতির প্রতি। তিনিও তার জাতিকে একই আহ্বান জানিয়েছিলেন, তার সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘‘আমি সামুদ জাতির কাছে তাদের ভাই সালিহকে পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো ইলাহ নেই। তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে সুস্পষ্ট প্রমাণ এসেছে। এটি হলো আল্লাহর উটনী, তোমাদের জন্য নিদর্শন, তাকে আল্লাহর জমিনে চরে খেতে দাও, মন্দ উদ্দেশ্যে একে স্পর্শ করবে না, করলে পীড়াদায়ক শাস্তি তোমাদেরকে গ্রাস করবে।’’ (সুরা আরাফ: ৭৩)
আরবের আর একটি জনপদ মাদইয়ান, সেই জনপদের অধিবাসীদের প্রতি পাঠানো হয়েছিলো হযরত শু‘আইব (আ.) কে। মাদইয়ানবাসীরা গোটা হেজাজ এবং আরব ভূমির বিভিন্ন অঞ্চলে চলাচলরত মানুষের যাতায়াতের পথে অবস্থান করতো। তাদের বসবাসই ছিলো সকল মানুষের যাতায়াতের পথের ধারে। এ জন্য মিশর, ফিলিস্তিন, জর্ডান, বর্তমান ইরাক ও ইরান এবং হেজাজসহ অপারপর মানুষের সাথে তাদের ব্যবসায়িক লেনদেন ছিলো অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। মাদইয়ানে বসবাসরত ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের লোকদের অভ্যেস ছিলো তারা বিক্রি করার সময় মানুষকে ওজনে কম দিতো, আর ক্রয় করার সময় বেশি নিতো। শু‘আইব (আ.) এর আহ্বান সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘‘আর মাদইয়ানে (প্রেরণ করেছিলাম) তাদের ভাই শু‘আইবকে। সে বলল, “হে আমার কওম, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো ইলাহ নেই। তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণ এসেছে। সুতরাং তোমরা পরিমাণে ও ওজনে পরিপূর্ণ দাও এবং মানুষকে তাদের পণ্যে কম দেবে না; আর তোমরা জমিনে ফাসাদ করবে না তা সংশোধনের পর। এগুলো তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা মুমিন হও।’’ (সুরা আরাফ: ৮৫)
উপর্যুক্ত বর্ণনা আয়াতমসূহ আমাদের কাছে এ সত্যই তুলে ধরেছে যে, নবিগণ মানুষকে আল্লাহর দাসত্ব ও তাদের আনুগত্য করার আহ্বান জানিয়েছেন। নবি-রাসুলদের আনুগত্য মূলত আল্লাহরই আনুগত্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন, ‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসুলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। অতঃপর কোনো বিষয়ে যদি তোমাদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয় তাহলে তা আল্লাহ ও রাসুলের দিকে প্রত্যার্পণ কর- যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর।’’ (সুরা নিসা: ৫৯)
এই আয়াতে অনেকগুলো বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে, নবিগণ মানুষকে আল্লাহর দাসত্বের দিকে আহ্বানের পাশাপাশি তাদের আনুগত্য করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। নবিরা ছিলেন আল্লাহর আদেশের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। এমন কখনো হয়নি, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে আদেশ প্রদান করা হয়েছে, তা নবিরা পালন করেনি। আল্লাহর যে কোনো হুকুমের প্রথম আনুগত্যকারী ছিলেন নবিগণ। তারা যা বলতেন তাই করতেন। কোনো নবির জীবনে কখনো কথা কাজের বৈপরীত্যের কথা চিন্তাও করা যায় না। আল্লাহর যে কোনো হুকুমের প্রথম বাস্তবায়নকারী ছিলেন নবিগণ।
আল্লাহর পক্ষ থেকে যে ওহি অবতীর্ণ হতো, তা তাঁরা মানুষের কাছে পেশ করতেন, সেই ওহির ভিত্তিতে তাদেরকে গড়ে তুলতেন, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করতেন। এ বিষয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন, ‘‘অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের প্রতি একজন রাসুল পাঠিয়েছেন, যে তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়। যদিও তারা ইতঃপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিল।’’ (সুরা আলে ইমরান: ১৬৪)
নবিগণ হচ্ছেন সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে তারা মানবতার কল্যাণেই কাজ করেছেন। নবিরা নিজেদের কল্যাণ নয়, মানবতার কল্যাণকে প্রাধাণ্য দিয়েছেন। নবি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, হে নবি আমি আপনাকে গোটা মানবজাতির জন্য সুসসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি। কিন্ত বেশিরভাগ লোকই তা জানে না।’’ (সুরা সাবা: ২৮)
একই কথা অন্যত্র একটু ভিন্ন আঙ্গিকে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘‘হে নবি আমি আপনাকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে আর আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারী ও আলোকপ্রদীপ হিসেবে প্রেরণ করেছি।’’ (সুরা আহযাব: ৪৫-৪৬)
আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ‘‘দেখ! তোমাদের নিকট একজন রাসুল এসেছেন, যিনি তোমাদের মধ্য থেকেই একজন। যা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর তাতে তিনি কষ্ট পান। তিনি তোমাদের হিতাকাক্সক্ষী। ঈমানদারদের জন্য তিনি বড়োই স্নেহশীল ও রহমদীল।’’ (সুরা তাওবা: ১২৮)
নবি এসেছেন সকল মতবাদের ওপর আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করার জন্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে বলেন, তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি তাঁর রাসুলকে হেদায়াত ও সত্য দীন সহকারে প্রেরণ করেছেন, যাতে এই দীনকে অন্য সকল দীনের ওপর বিজয়ী করা যায়।’’ (সুরা ফাতহ: ২৮)
উপর্যুক্ত বর্ণনার সংক্ষিপ্তসার যদি আমরা পর্যালোচনা করি তবে বুঝতে পারি যে নবির আগমনের কারণ হচ্ছে,
১. মানুষকে কেনো সৃষ্টি করা হয়েছে সে উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদেরকে জানানো।
২. মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে তাদের অবহিত করা।
৩. স্রষ্টার অস্তিত্ব, স্রষ্টার পরিচয় এবং আল্লাহর উলুহিয়াত ও রবুবিয়াত সম্পর্কে জানানো।
৪. আল্লাহর সৃষ্টি রাজ্য সম্পর্কে মানুষকে জানানো।
৫. মানুষকে তাদের ভালো কাজের পুরস্কার সম্পর্কে সুসংবাদ প্রদান করা।
৬. খারাপ কাজের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা, সাবধান করা।
৭. জাতিকে মহাসত্যের দিকে আহ্বান জানানো।
৮. কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দান।
৯. মানব রচিত সকল মতবাদের ওপর আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করা।
১০. জান্নাতের সুসংবাদ দান এবং জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, “আর আপনার নিকটাত্মীয়দের জাহান্নামের ভয় দেখান” (সুরা শুয়ারা: ২১৪)। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘‘যেদিন শাস্তি এসে যাবে, সেই দিন সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করুন।’’ (সুরা ইবরাহিম: ৪৪)
১১. আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত ওহির বাণী মানবজাতির কাছে যথাযথভাবে পৌঁছে দেওয়া। নবি-রাসুলদের কাজ হলো আল্লাহ তায়ালার নাজিলকৃত বিধান মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়া। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘‘হে রাসুল! আপনার মহান রবের পক্ষ হতে আপনার প্রতি যা নাজিল করা হয়েছে তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিন, যদি না করেন তবে তো আপনি রিসালাতের দায়িত্ব পালন করলেন না।’’ (সুরা মায়েদা: ৬৭)
১২. এক আল্লাহর দাসত্ব করার ও তাগুতকে বর্জন করার আহ্বান। আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে তাঁর ইবাদত করার ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেওয়ার জন্য নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘‘আল্লাহর ইবাদত করার ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেওয়ার জন্য আমি প্রত্যেক জাতির নিকট রাসুল পাঠিয়েছি।’’ (সুরা নাহল: ৩৬)
১৩. মানুষ যা জানে না সে সম্পর্কে জানানোর জন্য নবিদের আগমন। এখানে পৃথিবীর প্রতিটি রহস্য সম্পর্কে নবি (সা.) এর মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের জানিয়েছেন। যেহেতু আল্লাহ সরাসরি কোনো মানুষের সাথে কথা বলেন না। তাই তিনি নবির মাধ্যমে এ সকল বিষয় মানুষকে জানিয়েছেন। সৃষ্টি রাজ্যের প্রতিটি গ্রহ উপগ্রহ নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এ কথা মানুষ জেনেছে আজ থেকে হাজার বছর আগে, অথচ আমরা আধুনিক যে সৌরবিজ্ঞানের মাধ্যমে মহাবিশে^র তথ্য জানার চেষ্টা করছি, তার বয়স তিন শতাব্দীর বেশি হয়নি। সমুদ্রের শো শো অশান্ত গর্জন ঠেলে বাতাসকে কাজে লাগিয়ে মানুষ পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যেতে পারবে তা ওহির জ্ঞানের মাধ্যমে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন কয়েক হাজার বছর আগে। সমুদ্রের দুই ধরনের পানি পাশাপাশি বয়ে চলে অথচ একটি স্রোতের সাথে অপর স্রোত মিশে যায় না। সেখানেই আবার পাওয়া যায় নানা মূল্যবান মনিমুক্তা। আধুনিক সমুদ্র গবেষণার যে বিজ্ঞান তার যাত্রা শুরুর হাজার বছর আগে এটা আল্লাহ মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। এভাবে জ্ঞানের যত শাখা আছে সকল বিষয় আল্লাহ বহু পূর্বেই মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। এ সকল জানা মানুষের জন্য অতি আবশ্যক ছিলো। আর এটা জানানোর জন্য নবির আগমনও অতি আবশ্যক ছিলো।
নবির আগমনের আবশ্যকতা গোটা মানব জাতির জন্য যেমন অপরিহার্য একইভাবে নবির আদর্শকে অনুসরণ করা, জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁকে অনুসরণ, অনুকরণ এবং তার আদর্শ বাস্তবায়নও অপরিহার্য। মানবতার মুক্তির জন্য নবি (সা.) এর আদর্শ অনুসরণের বিকল্প কোনো পথ নেই। আল্লাহ যে অসংখ্য নবি পাঠিয়েছেন, তাদের মধ্যে সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ হচ্ছেন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)। তাঁর আদর্শ অনুসরণই আমাদের মুক্তি ও কল্যাণের একমাত্র গ্যারান্টি। যা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘‘তোমাদের জন্য রাসুলের জীবনেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ; এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ ও শেষ দিনের আশা রাখে এবং বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করে।’’ (সুরা আহযাব: ২১)
লেখক: কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন।