মাছ আমাদের প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস। কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন এবং পুষ্টি সরবরাহে মাছের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। যারা মাছ ধরার উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে, তারা জেলে বা জালিয়া হিসেবে স্বীকৃত। তাদেরকে মৎস্যজীবী, ধীবর কিংবা ইংরেজিতে ফিশারম্যান নামেও আখ্যায়িত করা হয়। বর্তমানে বেশিরভাগ জেলে মাছ চাষে জড়িত। অনেক জেলে আবার গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। কিছু অঞ্চলে জেলেরা ছোট নৌকা করে মাছ ধরে অথবা শেলফিশ এবং সামুদ্রিক শৈবাল সংগ্রহ করে। অনেক জেলে পরিবারে, মহিলা বা পুরুষরা জাল তৈরি এবং মেরামতের কাজ করে। মাছ ধরাই জেলেদের প্রধান কাজ হিসেবে বিবেচিত হতো এক সময়। কারণ অতীতে উৎপাদিত মাছের বেশিরভাগই প্রাকৃতিকভাবে খাল-বিল, নদী-নালায় বিপুল পরিমাণে পাওয়া যেতো। মাছের চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে জেলেদের কাজের পরিধিও বেড়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু সেই তুলনায় নদী, খাল-বিল কিংবা প্রাকৃতিক খাঁড়ি ও জলাধার কমেছে। ফলে প্রাকৃতিক মাছের পরিবর্তে এখন চাষকৃত মাছেই ভরসা বেশি। মাছের প্রজননকাল থেকে শুরু করে মাছ চাষের প্রতিটি ধাপ যত্মসহকারে পরিচালনা করতে হয়। এখন জেলে শব্দের ব্যবহার কমে গিয়ে ‘মাছ চাষী’ বা ‘মৎস্য চাষী’র শব্দের ব্যবহার-ই বেশি হচ্ছে।
মাছ শিকারের ইতিহাস
মূলত মেসোলিথিক যুগ থেকে খাদ্য প্রাপ্তির উপায় হিসেবে মাছ ধরার প্রমাণ পাওয়া যায়। মেসোলিথিক যুগ বলতে বুঝায় মধ্যপ্রস্তর যুগ। অর্থাৎ প্রাচীন প্রস্তর যুগ বা প্যালিওলিথিক, মেসোলিথিক বা মধ্যপ্রস্তর যুগ, নিওলিথিক বা নব্যপ্রস্তর যুগ। এই তিনযুগের মধ্যখানে যে যুগ সেটাই মেসোলিথিক। সেই সময় থেকেই খাবারের জন্য মানুষেরা মাছ শিকার করত। পরে মাছ ধরা ব্যবসায়িক উদ্যোগের পাশাপাশি বেঁচে থাকার একটি প্রধান উপায় হয়ে ওঠে।
মাছ শিকারী জেলেরা প্রাচীন মিশরীয় ধর্মকেও প্রভাবিত করেছে। বন্যা আগমন ঋতুর একটি চিহ্ন হিসাবে মুলেট (মাছ)-এর পূজা করা হতো। প্রাচীন মিশরীয় ধর্মের দেবী বাস্টেট বা বাস্টকে প্রায়শই একটি ক্যাটফিশ (মাগুর জাতীয় মাছ)-এর আকারে অনুমান করা হতো। প্রাচীন মিশরীয় সাহিত্যে প্রাচীন মিশরীয় দেবতা আমুন যে প্রক্রিয়ায় বিশ্ব তৈরি করছিলেন তাতেও মাছের উল্লেখ পাওয়া যায়।
বাংলার জনপদেও মাছ শিকারীদের জীবনযাত্রা নতুন নয়। প্রাচীনকাল থেকেই এ প্রক্রিয়ার সাথে মানুষ যুক্ত ছিলেন। একটা সময় ছিল যখন মাছ শিকারে জেলেদের অতি প্রয়োজনীয় নৌকা তৈরি হতো জেলেপাড়ার ভেতরেই। আর তাই জেলেদেরকে দেখা যেত নানা ধরনের নৌকা ব্যবহার করতে। যখন নদীতে মাছের প্রাপ্যতা কমে যেত তখন জেলেরা নিজেদেরকে নদীর মাধ্যমে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত করতো। আবার বর্ষা মওসুমে প্রাপ্ত অতিরিক্ত মাছ বিশেষভাবে শুকিয়ে ও মটকিতে প্রক্রিয়াজাত করে শুটকি তৈরি করতো। চাষীপল্লীর এ ঐতিহ্য দীর্ঘ দিনের পুরোনো।
জেলে সম্প্রদায়ের অনেকে মাছ ধরাকে শুধুমাত্র খাদ্য এবং কাজের উৎস বলে মনে করে না। এটি তাদের সম্প্রদায় এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ও প্রদান করে। যেহেতু নদীর উপরই জেলেদের নির্ভরশীলতা তাই জেলে পাড়াগুলো নদীর পাড় ঘেষেই তৈরি হতে দেখা যায়। আবার নদীর বারবার পাড় ভাঙাগড়ার ব্যাপার থাকায় জেলেপাড়ার ঘর বাড়িগুলো হতো সাধারণত অস্থায়ী কাঠামোর। অধিকাংশ জেলে পরিবার নিম্নমানের জীবনধারায় অভ্যস্ত। সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল কিংবা কোন কোন নদীতীরবর্তী অঞ্চলে জেলে পাড়ার অস্তিত্ব কিছুটা পাওয়া গেলেও সমতল বাংলার জনপদে জেলে পল্লী বলে তেমন কোন পাড়ার আর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। চাষপদ্ধতির মাধ্যমে মৎস্যশিকার এখন মৎস্যশিল্পে পরিণত হয়েছে।
মাছে ভাতে বাঙালি
নদীমাতৃক এই বাংলায় ঐতিহাসিক কাল থেকেই মাছের সাথে আমাদের সম্পর্ক। মাছ আমাদের প্রিয় খাবার। তাইতো প্রবাদ প্রচলিত আছে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। আমাদের দেশের নদী কিনারায় বসবাসরত জনগণ বিশেষ করে দরিদ্র জেলেগোষ্ঠি শুধুমাত্র নদী থেকে প্রাকৃতিক মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষাপটে নদী-জলাধারের সংকট দেখা দিলে প্রাকৃতিক মাছ চাহিদার চেয়ে প্রায় দুস্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। তখন দেখা দেয় মাছ চাষের প্রয়োজনীয়তা।
মাছচাষ এখন একটি অর্থনৈতিক শিল্প হিসেবে পরিগণিত। শিক্ষিত হাজারো যুবক এখন এই পেশাকে শিল্প ও অর্থনীতির মৌলিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রহণ করেছে। সময়ের ব্যবধানে মাছ চাষের নতুন নতুন প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করা হচ্ছে। গবেষণা হচ্ছে মৎস্য বিভাগ নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ফিশারিজ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে উচ্চতর গবেষণায় মৎস্যসম্পদকে উন্নত প্রক্রিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
মাছ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের আধুনিক পদ্ধতি
আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় মাছ হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মাছের অনেক চাহিদা থাকার কারণে স্থানীয়ভাবে মাছ চাষ করে ভালো আয় করা সম্ভব। তাছাড়া বিদেশে মাছ রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। মাছ চাষে বাংলাদেশ এখন চতুর্থ।
আমাদের দেশের স্বাদু পানিতে ২৬০টিরও বেশি প্রজাতির মাছ আছে। এছাড়া খাঁড়ি অঞ্চলে ও লোনা পানিতে কয়েকশ‘ প্রজাতির মাছ আছে। তবে চাষযোগ্য মাছগুলো হলো রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস, সিলভারকার্প, মিররকার্প, গ্রাসকার্প, কমনকার্প, বিগহেড, রাজপুঁটি, নাইলোটিকা, তেলাপিয়া, বিদেশি মাগুর, থাই পাঙ্গাশ এসব। এসব মাছের কিছু বিশেষ গুণাগুণ আছে। এসব মাছ খুব দ্রুত বাড়ে; খাদ্য ও জায়গার জন্য একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে না; পুকুরে বেশি সংখ্যায় চাষ করা যায়; পানির সব স্তর থেকে খাবার গ্রহণ করে, পুকুরের পরিবেশ ভালো থাকে; খেতে খুব সুস্বাদু; বাজারে এসব মাছের প্রচুর চাহিদা আছে; সহজে রোগাক্রান্ত হয় না, চাষে লাভ বেশি হয়। এজন্য লাভজনকভাবে এসব মাছে চাষ করা যায় অনায়াসে।
বিভিন্ন পদ্ধতিতে একই পুকুরে নানা জাতের মাছ চাষ করা যায়। খাল, ডোবার পাশাপাশি চৌবাচ্চা এবং খাঁচাতেও মাছের চাষ করা যায়। জলাশয়ে পরিকল্পিত উপায়ে স্বল্পপুঁজি, অল্পসময় ও লাগসই প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছের উৎপাদন ক্রমশ বৃধি পাচ্ছে।
প্রথমত, সনাতন পদ্ধতিতে পুকুরে আলাদা কোনো পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা ছাড়াই মাটি এবং পানির উর্বরতায় পানিতে যে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয় মাছ তাই খেয়ে জীবন ধারণ করে।
দ্বিতীয়ত, আধানিবিড় পদ্ধতিতে নিয়মমতো পুকুর প্রস্তুত করে আংশিক সার ও খাদ্য সরবরাহ করে মাছের খাদ্য উৎপন্ন করা যায়।
তৃতীয়ত, নিবিড় পদ্ধতিতে অল্প জায়গায়, অল্প সময়ে বেশি উৎপাদনের জন্য সুপরিকল্পিতভাবে সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে হয়।
চতুর্থত, মিশ্রচাষের মাধ্যমে পুকুরের বিভিন্ন স্তরে উৎপন্ন খাবার সম্পূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে নানা প্রজাতির মাছ একসাথে চাষ করা যায়। এ ক্ষেত্রে পুকুরটি খোলামেলা রোদ্রউজ্জ্বল জায়গায় এবং বাড়ির আশপাশে হতে হবে যেন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। সাধারণত দো-আঁশ, এঁটেল দো-আঁশ ও এঁটেল মাটি পুকুরের জন্য ভালো। ৩০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ আকারের পুকুর মাছ চাষের জন্য বেশি উপযোগী। পুকুরের গভীরতা ২-৩ মিটার রাখতে হবে এবং বছরের পুরো সময় পানি থাকতে হবে। পুকুর পাড়ে বড় গাছ বা ঝোপঝাড় থাকা যাবে না। বিশেষ করে পাতাঝরা গাছ রাখা যাবে না।
পঞ্চমত, একই আকার ও বয়সের রোগমুক্ত পোনা সংগ্রহ করতে হবে। তারপর তা সঠিক নিয়মে যথার্থভাবে পুকুরে অবমুক্ত করতে হবে। পোনা রোগমুক্ত কিনা ছাড়ার আগে তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতি ৩-৪ বছর পরপর পুকুর শুকিয়ে ফেলে নতুন করে পুকুর প্রস্তুত করে নিতে হবে। বর্ষার শেষে পুকুরের পানিতে লাল বা সবুজভাব কমে গেলে অবশ্যই পরিমাণ মতো সার দিতে হবে। মাঝে মাঝে জাল টেনে মাছের অবস্থা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখতে হবে। পুকুরে জাল ও দড়ি টেনে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ানো এবং মাছের ব্যায়াম করাতে হবে।
ষষ্ঠত, লাভজনক মাছ চাষের জন্য মানসম্মত খাবার অন্যতম প্রধান শর্ত। কেননা মাছ চাষে শতকরা ৭০ ভাগের বেশি খরচ হয় খাদ্য সরবরাহে। সঠিক পুষ্টিমান সম্পন্ন এবং মাছের আকার ও বয়স উপযোগী খাবার সরবরাহ না করলে লাভ হবে না। কম খাবার সরবরাহ করলে যেমন মাছের প্রত্যাশিত উৎপাদন পাওয়া যায় না তেমনি বেশি পরিমাণে খাবার সরবরাহে লোকশান হয়। এতে খাবার ও অর্থ দুই-ই অপচয় হয় এবং পানি দূষণের জন্য মাছ মারা যায়। সাধারণত মাছের পোনার সংখ্যা অজানা থাকায় খাদ্য প্রয়োগের হিসাবে গড়মিল হয়। সঠিক মাত্রায় খাবার সরবরাহ করতে পারেন না। এজন্য মাছের সংখ্যা এবং গড় ওজন জেনে পানির গুণাগুণের দিক বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পরিমাণে খাবার সরবরাহ করা দরকার। অনিয়মিতভাবে খাবার সরবরাহ করলে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করা সম্ভব নয়। মাছ চাষে পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনে জৈব ও অজৈব সারের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। অনেক চাষি কেবল সার প্রয়োগের মাধ্যমে মাছ চাষ করতে চান। এ ধারণা থেকে অতিরিক্ত সার প্রয়োগে বিপদ ডেকে আনেন। পানিতে প্লাংক্টন বুম বেশি হয়ে সমস্যার সৃষ্টি করে এক পর্যায়ে পানি নষ্ট হয়ে যায় এবং পুকুরে গ্যাস সৃষ্টি হয়ে মাছ মারা যায়। সুতরাং মাছের সঠিক খাদ্য ব্যবস্থাপনা একান্ত জরুরি।
সপ্তমত, পোলট্রি লিটার ব্যবহারের কারণে মাছ চাষিরা নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। পোলট্রি লিটারে কাঠের গুঁড়া ব্যবহার করা হয় যা মাছ খেয়ে পরিপাক হয় না এবং তা থেকে বদহজম হয়। পেট ফুলে মাছ মারা যায়। আবার লিটারে কেবল তুষ থাকার কারণে একই সমস্যা হয়। বেশি পরিমাণে লিটার পানির গুণাগুণ নষ্ট করে। পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাসের কারণে ব্যাপকহারে মাছ মারা যায়। তাছাড়া এ লিটারের মাধ্যমে মাছে অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া যায় যা স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
অষ্টমত, প্রতি ১০-১৫ দিন পর পর মাছের গড় ওজন নেয়া আবশ্যক। তা না হলে খাবারের সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করা যায় না। মাছের ওজন না নিলে চাষিও বুঝতে পারেন না যে মাছের বাড়তি সন্তোষজনক নাকি হতাশাব্যঞ্জক। পোনা ছেড়ে এবং খাবার সরবরাহ করেই চাষির দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। মাছের স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণ একটি বড় কাজ। মাছের অস্বাভাবিক আচরণ বা দেহে অস্বাভাবিক কোনো কিছু দেখা গেলে বা ক্ষত হলে মৎস্য বিশেষজ্ঞ বা মৎস্য কর্মকর্তার শরণাপন্ন হতে হবে। তবে মাছের রোগ হলে চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধে অধিক মনোযোগী হলে মাছচাষি ক্ষতি এড়াতে পারেন। মৎস্যবিদ বা অভিজ্ঞ চাষির পরামর্শে সঠিক ওষুধ, সঠিক মাত্রায়, সঠিক সময়ে এবং প্রয়োগ বিধি অবশ্যই মেনে চলতে হবে।
নবমত, একই পুকুর থেকে একাধারে কয়েক দিন মাছ ধরলে চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। কেননা পরপর কয়েক দিন জাল টানলে অন্য মাছ খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে দেয় বলে মাছের ওজন কমে যায় এবং আঘাতজনিত কারণেও কিছু মাছ মারা যেতে পারে। এ কারণে একটানা কয়েক দিন মাছ না ধরে মাঝে বিরতি দেয়া উচিত। মাছ ধরে সঠিকভাবে বাজারজাত করতে না পারলে মাছ চাষি চাষের শেষ দিকে এসে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। যেসব মাছ জীবিত পরিবহন করা হয় সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে অধিক সময় পরিবহন বা অন্য কোনো ক্রটির কারণে মারা যায়। এ ক্ষেত্রে প্লাস্টিক ড্রামে পরিষ্কার পানিসহ পরিমিত মাছ পরিবহন করা উচিত। আজকাল ড্রামসহ গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। শিং, মাগুর, কৈ মাছ এভাবে পরিবহন করা হয়। ড্রামে নেয়ার আগে কিছু সময় হাপায় রাখা আবশ্যক। মাছ ধরার ৮-১০ ঘণ্টা আগে খাবার দেয়া বন্ধ রাখলে মাছ অধিক সময় জীবিত থাকে। অন্যান্য মাছ দূরত্ব ভেদে বরফজাত করা উচিত।
দশমত, মাছ প্রক্রিয়াজাতের সময় হাত দিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করা যাবে না। মাছ ধরার পর মাছের আকৃতি অনুযায়ী আলাদা করে ফেলতে হবে। পাত্রে বরফ দিয়ে স্তরে স্তরে মাছ সাজাতে হবে; শুকনোভাবে অথবা ভেজা অবস্থায় লবণ দিয়ে মাছ সংরক্ষণ করা যায়। মাছ কেটে নাড়িভুঁড়ি ও মাথা ফেলে দিয়ে চাক করে সেগুলো সিদ্ধ করতে হবে। এরপর লবণ, তেল, মসলা চাকের সাথে মেখে টিনের পাত্রে সুন্দর করে স্তরে স্তরে সাজিয়ে পাত্রটি বায়ুশূন্য করে মুখবন্ধ করতে হবে। একে ফিশকেনিং পদ্ধতি বলে। বরফ ছোট ছোট টুকরা করে ঝুড়ি বা প্যাকিং বাক্সের তলায় ঘন করে স্তরে স্তরে বরফ দিয়ে মাছ প্যাকিং করে দিতে হবে। ব্যবসাভিত্তিক মাছ কোল্ড স্টোরেজে কমদামে একসাথে অনেক সংরক্ষণ করা যায়। বালির ওপর মাছ ছাড়িয়ে দিয়ে অথবা দড়ি টানিয়ে রোদের তাপে ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়।
মৎস্য চাষের সম্ভাবনা
বিপুল জলসম্পদের এই দেশে অগনিত মানুষ মৎস্য আহরণ, চাষ ও বেচা-বিক্রিসহ এ সংক্রান্ত নানা কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। পুষ্টিমান উন্নয়ন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার্জন, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাছ চাষের ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে প্রাণীজ আমিষের উত্তম উৎস হিসেবে মাছের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বৈদেশিক মুদ্রার্জনের পাশাপাশি মৎস্য চাষ করে অনেক বেকার স্বাবলম্বী হচ্ছে। পরিবেশিক ও প্রাকৃতিক কারণে মৎস্য চাষে বাংলাদেশ বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশের অধিক বা ১ কোটি ৮৫ লক্ষ লোক হ্যাচারি পরিচালনা, মৎস্য চাষ, মৎস্য আহরণ, বিক্রি, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি কাজের সাথে নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে। এসব কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অংশগ্রহণ করে। প্রাপ্ত তথ্যানুসারে প্রায় ১৫ লক্ষ নারী মৎস্যখাতের বিভিন্ন কার্যক্রমে নিয়োজিত।
প্রচলিত হ্যাচারির ব্যবহার আধুনিকায়ন করে পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও চাহিদা-মাফিক মানসম্পন্ন পোনার উৎপাদন ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। সেইসাথে সম্ভাব্য সকল জলাশয়কে আধুনিক চাষ ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। একই সাথে উৎপাদিত মৎস্য বিপণন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থারও ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাতে হবে যাতে করে মাছের গুণগত মান ঠিক থাকে এবং মাছ ও মাছজাত পণ্যের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত হয়। এসকল ক্ষেত্রে দক্ষ জনবলের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। বেকার নর-নারীদেরকে খাতওয়ারী প্রশিক্ষণের আওতায় এনে দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলোতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে গ্রামে গঞ্জে অসংখ্য পুকুর ডোবা ছড়িয়ে আছে। এসব পুকুরের সিংহভাগ মাছ চাষের আওতায় আনা হলেও একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও পতিত। পতিত বা আপাত মাছ চাষ অযোগ্য এসব পুকুরের মালিকানা দেশের প্রান্তিক চাষী বা বিত্তহীনদের হাতে। সংস্কারের মাধ্যমে এ সমস্ত পুকুরে মাছ চাষ করে বিত্তহীন লোক এবং বেকার যুবকদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।
বাংলাদেশে হাঁস-মুরগির চাষ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে এদের খাদ্যের চাহিদা। মাছের অব্যবহৃত অংশ যেমন-আঁইশ, কাটা, নাড়িভুঁড়ি ইত্যাদি দ্বারা হাঁস-মুরগির জন্য উত্তম সুষম খাদ্য তৈরী করা সম্ভব। এসব আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য হাঁস-মুরগিকে খাওয়ালে ডিম ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এ ক্ষেত্রে পতিত বা অব্যবহৃত জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করলে পারিবারিক মাছের চাহিদা মেটানোর সাথে সাথে আর্থিকভাবেও কিছুটা সুফল পাওয়া যেতে পারে।
জীবন-জীবিকার ঝুঁকিতে জেলেরা
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের জেলেরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছেন। নদীর তীরে ঝড়ের প্রলয়ে বিক্ষুব্ধ জনপদে শত শত জেলের বসবাস। নদী আর সমুদ্রে জাল ফেলা, জালে ওঠা মাছ বাজারে বিক্রি এভাবেই চলে নিত্যদিনের জীবিকা। পরিবার পরিজন নিয়ে বছরের পর বছর তারা এভাবেই জীবিকা নির্বাহ করছে। সেই জীবিকায় এখন নানামুখী সংকটের সম্মুখীন। বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন ৪-৫ গুণ বাড়লেও জেলেদের জীবন-মানের কোনো উন্নতি হয়নি। সামগ্রিকভাবে জেলেরা বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। কিন্তু তাঁদের মধ্যে যাঁরা সমুদ্রে মাছ ধরেন, তাঁদের অবস্থা আরও শোচনীয়। অনেকের স্থায়ী ঘরবাড়িও নেই। কোনোভাবে অন্যের জায়গায় মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন। সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নের নিরিখে জেলেদের জীবনমান উন্নয়নের বিষয়টি দেখতে হবে।
প্রথমত, সমুদ্রগামী জেলেদের জীবনের নিরাপত্তা নেই। মাঝেমধ্যেই জলদস্যুদের আক্রমণের শিকার হয়ে নৌকা, জালসহ সহায়-সম্পদ হারান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জীবনহানির ঘটনাও ঘটে। কিন্তু বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার নিরাপত্তার দায়িত্ব কোস্টগার্ডের। প্রতিবছর তাদের পেছনে বরাদ্দও বাড়ছে। কিন্তু জলদস্যুদের উৎপাত কমছে না। এটি খুবই উদ্বেগজনক। এ বিষয়ে আরো দায়িত্ববান হওয়া দরকার।
দ্বিতীয়ত, জেলেকে বছরের একটা বড় সময় বেকার বসে থাকতে হয়। কিন্তু এ সময়ে তাঁদের সঞ্চয় বলে কিছু থাকে না। ফলে মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে তাঁদের জীবন বাঁচাতে হয়। অনেকে জাল-নৌকা সংগ্রহ করেন ধার-দেনা করে। ফলে কাঁধে বাড়ছে ঋণের বোঝাও। তাই অনেক সময় তাঁরা কম দামে মাছ আগাম বিক্রি করে দেন। অনেকেই জেলেদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ‘উপরি’ কামাই করেন। এ সময় জেলেদের সহায়তায় সরকারি পদক্ষেপ জরুরী।
তৃতীয়ত, জেলেদের জীবিকা সরাসরি হুমকির মুখোমুখি। বিচ্ছিন্ন মাছ ধরার জায়গা, প্রবল বাতাস, মৌসুমী অন্ধকার, খুব ঠান্ডা পানি, বরফ বা কুয়াচ্ছন্ন জায়গায় কাজ করতে হয়। আবার অনুকূল পরিস্থিতির সময় তাদেরকে খুব দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে হয়। বেশিরভাগ জেলের জীবিকার দিনগুলিতে ক্লান্তি, শারীরিক এবং আর্থিক চাপের মুখোমুখি হয়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব, জোয়ারের তীব্রতা, নদী-ভাঙন, নদীতে মাছ কমে যাওয়া ছাড়াও নানামুখী কারণে বহু জেলে এ পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। বিকল্প জীবিকা কিংবা এদের নিররাপত্তায় বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের বিকল্প নেই।
চতুর্থত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জীবিকার ধরন বদলে যাচ্ছে অনেকের। ঝড়-বন্যায় এখন আর নদীতে বেশি সময় মাছ ধরা যায় না। ঝড়ের সিগন্যাল পেলে মাছধরা ফেলে কিনারে চলে আসতে হয়। আবার কখনো কখনো নিম্নচাপের সংকেত আছে বলে জাল-নৌকা নিয়ে নদীতে যাওয়া সম্ভব হয় না। ঝড়-জলোচ্ছাসে নদীর পাড়ে বাসবাসকারী এ জেলের জীবন ওলট-পালট করে দেয়। বাড়িঘরে পানি ওঠে। প্রবল বাতাসে ঘর উড়িয়ে নেয়। তখন মাছধরা তো দূরের কথা, ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র ছুটতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে জেলে পরিবারগুলো প্রতিনিয়ত তাদের অবস্থান বদল করছে। অধিকাংশ জেলে পরিবার বছরে একাধিকবার বসতি বদলাতে বাধ্য হয়। ধর্মীয় বিধিবিধান পালন করা তাদের জন্য কষ্টকর। শিক্ষার সুযোগের অভাব এবং উপযোগ স্বল্পতা দৃশ্যমান। স্বাস্থ্য সুবিধাসমূহ নেই বললেই চলে। বাড়িঘরের অবস্থাও বসবাসের উপযোগী নয়। সুপেয় পানির সুবিধা এখনো অপর্যাপ্ত। পয়ঃনিস্কাশন সুবিধা এখনো সৃষ্টি হয়নি। বিদ্যুৎ সুবিধা এখনো আওতার বাইরে। ঋণ সুবিধা নেই বললেই চলে। সুধি মহাজনদের বেড়াজালে তাদের জীবন-যাত্রা বন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের মানবিক উন্নয়নে দৃষ্টি দেওয়া অত্যাবশ্যক।
পঞ্চমত, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে প্রাকৃতিক মাছের অভাব ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। চাষের উপর নির্ভর করছে মৎস্য সম্পদ। ক্ষুদ্র পরিসরে মৎস চাষের সাথে সম্পৃক্ত অধিকাংশ মানুষই স্বল্প পুজির। তাঁরাও নানা রকম প্রতিকুলতা এবং রাজনৈতিক পরিবেশের কাছে অসহায়। পুজিপতি মৎস্যচাষীদের কাছে মৎস্য শ্রমিকরা এখনো মর্যদার আসনে যেতে পারেনি। মৎস্যশ্রমিকগণ শ্রমবাজারে এখনো সামাজিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারে নি। প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধার অভাব রয়েছে। আয়-রোজগারে অনিশ্চয়তা মাথার উপর চেপে বসে আছে। জীবনের ঝুঁকির কোন ইনসিওরেন্স নেই। মানবিক মৌলিক অধিকার থেকে তারা অনেকাংশে বঞ্চিত। এ ধরনের সহায়ত্ব ও দুরবস্থার মধ্যে হাজারো সমস্যা মাথায় নিয়ে নতুন জীবনের স্বপ্নে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকারি সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগিয়ে এলে তাদের জীবন জীবিকায় সুখের পালে হাওয়া লাগতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, মাছ আমাদের অমূল্য প্রাণিজ জাতীয় সম্পদ। নিজেদের একান্ত প্রয়োজনে পরিকল্পিতভাবে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি পদ্ধতি অনুসরণ এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করলে মাছ চাষে কম খরচে বেশি লাভবান হওয়া যায়। মাছ নামক রূপালি সম্পদ দ্বারা দেশকে টইটম্বুর করতে পারব। পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে কৃষি নিয়ে দাঁড়াতে পারব। আমাদের পারিবারিক সামান্য জলসীমাকেও পরিকল্পিত উপায়ে মাছ চাষ করতে হবে। এক্ষেত্রে নদীতীরের মৎসজীবীকে সংগঠিত করেও মাছের উৎপাদন বাড়াতে হবে। সে সাথে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ নিধন বন্ধ করতে হবে। সারা বছর খাঁচায় মাছ চাষ করে মাছের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। দেশে-বিদেশেও মাছের প্রচুর চাহিদা আছে। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মৎস্য বাজারে প্রবেশের জন্য নীতিনির্ধারণী মহলসহ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ঠ সকলের এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন। সেইসাথে সমুদ্রগামী জেলে তো বটেই, সব মৎস্যজীবীর জীবনমান উন্নয়নে শুধু খাদ্য সহায়তা নয়, আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। জেলেরা যাতে মহাজনদের ঋণচক্রে আবদ্ধ না থাকেন, সে জন্য তাঁদের আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। উপকূল ও চরাঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে। মৎস্য সম্পদের উন্নয়নে সরকারের আরো বেশি দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।
লেখক: কবি ও গবেষক; প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।