মুসলিম বিশ্বের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী দেশ তুরস্ক। সেলচুক ও উসমানী সালতানাতের শতবছরের ধারক-বাহক দেশটিতে রাজনৈতিকভাবে মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজমান। এজন্যই ইসলামপন্থীরা রাজনৈতিকভাবে বরাবরই এখানে এগিয়ে থাকে। বিশেষত গত তিন দশক ধরে এটাই তুরস্কের বাস্তবতা। প্রসঙ্গত, মুসলিম বিশ্বের যে দেশগুলোতে সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে সে দেশগুলোতে ইসলামপন্থীরা প্রায়ই এগিয়ে থাকে। তাতেই বিশ্ব মোড়লদের সমস্যা। বারবার সেনাশাসন কিংবা অন্য কোনো অবৈধ পন্থায় ক্ষমতায় চেপে থাকা স্বৈরাচারদের পাশে তাদের সমর্থন থাকে। যাই হোক, তুরস্কের রাজনৈতিক যে স্থিতিশীলতা তার পিছনে রাজনৈতিক দলগুলোর ভ‚মিকার পাশাপাশি সিভিল সোসাইটি এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রয়েছে। তুরস্কে শ্রমিক সংগঠনগুলো তথা ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে বড়োদাগে বিশেষত রাজনৈতিকভাবে দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, ইসলাম ও ডানপন্থীদের হাক ইশ (হক ট্রেড ইউনিয়নস কনফেডারেশন) আর দ্বিতীয়ত, কামালিস্ট ও বামপন্থীদের তুর্ক ইশ (তুর্কিয়ে ট্রেড ইউনিয়নস কনফেডারেশন)। এখানে ইশ মূলত ইশচি এর সংক্ষিপ্তরূপ, যার অর্থ শ্রমিক। প্রধান এই দুটি ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন ছাড়াও তুরস্কে আরও বেশকিছু কনফেডারেশন রয়েছে। তবে সেগুলো আকারে ছোটো যারা মূলত জাতীয়তাবাদী দল ও কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন দলের সমর্থক শ্রমিক সংগঠন। এখানে কনফেডারেশন বলতে বুঝায় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর অভিভাবক সংগঠন, আমাদের দেশে যাকে আমরা ফেডারেশন বলি।
তুরস্কের ট্রেড ইউনিয়নসমূহে রেজিস্টার্ড শ্রমিক সংখ্যার দিক থেকে এখনও কামালিস্ট ও বামপন্থীদের তুর্ক ইশ প্রথম অবস্থানে রয়েছে, তাদের রেজিস্টার্ড শ্রমিক সংখ্যা প্রায় তের লাখ। এর পরের অবস্থান হাক ইশের, তাদের রেজিস্টার্ড শ্রমিক সংখ্যা প্রায় আট লাখ। এখানে রেজিস্টার্ড শ্রমিক বলতে যারা নিজেদেরকে কোনো একটি শ্রমিক সংগঠনের সদস্য হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত করায় এবং নিয়মিত চাঁদা পরিশোধ করে। তুরস্কের শ্রম ও সামাজিক নিরাপত্তা মন্ত্রণালয় এগুলোর তালিকা সংরক্ষণ করে এবং প্রতিবছর জানুয়ারি ও জুলাইতে তাদের পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বর্তমানে তুরস্কে এক কোটি ষাট লাখের বেশি শ্রমিক রয়েছে, যাদের মাঝে মাত্র ১৪.৭% শতাংশ কোনো ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্টার্ড সদস্য। এখানে যেহেতু সকল শ্রমিকরাই সরকারি ইন্সুরেন্সের আওতায় সেহেতু এসব তালিকা খুব সতর্কতার সাথেই সংরক্ষণ করা হয়। উল্লেখ্য, বাধ্যতামূলক এসব ইন্সুরেন্সের আওতায় শ্রমিক ও তার পরিবারের সকল সদস্যের যাবতীয় চিকিৎসা ও ঔষধের ৮০% খরচ সরকার বহন করে। পাশাপাশি সকল শ্রমিক এর আওতায় পেনশন সুবিধার অন্তর্ভুক্ত। তবে স্বভাবতই চাকুরি চলা অবস্থায় শ্রমিক/কর্মজীবী এবং তাদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রতিমাসে নির্ধারিত হারে ইন্সুরেন্সের টাকা বাধ্যতামূলকভাবে পরিশোধ করতে হয়। পাশাপাশি ট্রেড ইউনিয়নগুলো তাদের রেজিস্টার্ড শ্রমিকদের মাঝে কর্মরত অবস্থায় মারা গেলে তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে কিছু নগদ অর্থ প্রদান করে।
তুরস্কের রাজনীতিতে এসব ট্রেড ইউনিয়নগুলো বিশেষত কনফেডারেশনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। সরকারি ও বেসরকারি শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি কত হবে সেটা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সাংবিধানিকভাবে কনফেডারেশনগুলো মৌলিক ভ‚মিকা পালন করে। তুরস্কে প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে শ্রমিক তথা কর্মজীবিদের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয় যা পরবর্তী বছরের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। তাতে কনফেডারেশনগুলো ও মালিক সংগঠনগুলো সরকারের মধ্যস্থতায় দরকষাকষি করে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে এটা একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। ফলে শ্রমিকদের সন্তোষজনক মজুরি দিতে মালিকরা বাধ্য হয়। এখানে এটাও উল্লেখ করা জরুরি যে, শ্রমিক সংগঠনগুলোর মাঝে পরস্পর রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নেই বললেই চলে। তারা সবাই শ্রমিকদের নানা অধিকার রক্ষা ও তাদের জীবনমান উন্নয়নে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর মাঝে প্রায়ই সমন্বয় করে কাজ করতে দেখা যায়। যদিও কিছু ব্যতিক্রম নেই এটা বলা ঠিক হবে না। এটা সবজায়গাতেই কমবেশি থাকে।
তুরস্কের শ্রমিক সংগঠনগুলোর ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত এই ভূমিকার পর আমরা মূলত এখানের ইসলামী আন্দোলন তথা মিল্টি গুরুসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হাক ইশের প্রতিষ্ঠা এবং এর কার্যক্রম নিয়ে বিষদ আলোচনা করবো।
হাক ইশ প্রতিষ্ঠার পটভূমি : তুরস্কে ইসলামী আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় মূলত প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানের হাত ধরে; যিনি একজন স্বনামধন্য ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। জার্মানিতে পড়াশোনা শেষ করে ও মোটর তৈরির কারখানায় বৈজ্ঞানিক হিসেবে কাজ করে তুরস্কে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। তবে শুধু গতানুতিক পাঠদান কিংবা গবেষণা তার উদ্দেশ্য ছিল না বরং তিনি দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে চাচ্ছিলেন। তিনি একজন ধর্মপ্রাণ ও নিবেদিত মুসলমান ছিলেন। তুরস্কের হারিয়ে যাওয়া ইসলামী মূল্যবোধ ও উসমানী ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে উনার সংকল্প ছিল পাহাড়সম। জার্মানি থেকে ফিরে তিনি ইস্তান্বুল টেকনিক ইউনির্ভাসিটিতে প্রফেসর হন। পাশাপাশি ধর্মপ্রাণ একদল উলামাদের সার্বিক সহায়তায় স্থানীয়ভাবে গাড়ি তৈরির প্রজেক্ট দাঁড় করাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু নানা বাধায় সে প্রকল্প খুববেশি আগায়নি। তিনি দেখলেন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের সংগঠন এক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দাঁড়াচ্ছে। তিনি দ্রæতই ঐ সংগঠনের নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রথমে সেক্রেটারী জেনারেল ও পরবর্তীতে সভাপতি নির্বাচিত হন। তখনো তিনি রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেননি। কিন্তু যখন সরকার তার দায়িত্ব পালনে বাধা দিল তখন তিনি তুরস্কের ইসলামপ্রিয় কিছু সহকর্মীদের নিয়ে মিল্টি গুরুস আন্দোলন শুরু করলেন।
মিল্টি গুরুস ১৯৬৯ সালে শুরুতে একটি মুভমেন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৯ এর নির্বাচনে তৎকালীন জাতীয়তাবাদী আদালত পার্টি থেকে এমপি প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন কিন্তু মনোনায়ন না দেওয়ায় তিনি কোনিয়া শহর থেকে স্বতন্ত্র এমপি প্রার্থী হন এবং বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে মিল্টি গুরুসের রাজনৈতিক শাখা হিসেবে প্রথমে মিল্টি নিজাম পার্টি গঠিত হয়। এরপর একবছরের মাথায় সেনা মেমোরেন্ডামে পার্টি নিষিদ্ধ হলে মিল্টি সালামত পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। মিল্টি সালামত পার্টি প্রতিষ্ঠার পর পরবর্তী নির্বাচনেই ৪৮ টি আসন পেয়ে তৃতীয় (আসন সংখ্যার দিক থেকে) হয় এবং কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় কামালিস্ট সিএইচপির নেতৃত্বাধীন জোটে অংশ নিয়ে সরকার গঠন করে এবং এরবাকান উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত হোন।
তুরস্কের শ্রমিক সংগঠনের আলোচনায় এতটুকু আমাদের মাথায় রাখাটা জরুরি। ইখওয়ানুল মুসলিমিন এবং জামায়াতে ইসলামীর মতো মূলধারার ইসলামী আন্দোলনগুলোর সাথে তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের একটি বড়ো পার্থক্য এখানে। উভয় সংগঠন (ইখওয়ান ও জামায়াত) একদম নিচ পর্যায় তথা লোক তৈরি থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে রাজনীতিতে এসেছে এবং নির্বাচনগুলোতে অংশ নিয়ে ভালো ফলাফল করার চেষ্টা করছে। আর মিল্টি গুরুসের শুরুটাই রাজনীতি দিয়ে। এরপর তারা ধীরে ধীরে প্রয়োজনের আলোকে বিভিন্ন সেক্টরে সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও লোক তৈরির চেষ্টা করেছে। আবার এখানে লোক তৈরির পন্থাও ভিন্ন। কোনো রাজনৈতিক দল এখানে দাওয়াহ এবং তারবিয়্যাহমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে না। এগুলো মূলত করে ওয়াকফ জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যারা প্রায়ই রাজনীতি থেকে দূরে থাকে। ইস্তান্বুল এবং আনকারাতে এ ধরনের শতশত ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান (ফাউন্ডেশন ও এসোসিয়েশন) রয়েছে।
যাই হোক, মিল্টি গুরুস (মিল্টি সালামত পার্টি) ক্ষমতায় আসার পর শ্রমিকদের মাঝে কাজ বাড়ানোর চিন্তা করলো। এমতাবস্থায় ১৯৭৬ সালে সমমনা ৭ টি ট্রেড ইউনিয়নের সমন্বয়ে হাক ইশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৭ সালে এর প্রথম কাউন্সিলে মিল্টি গুরুসের অন্যতম নেতা ইয়াসিন হাতিবওলু এর প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন।
সংগঠন সম্প্রসারণ ও সমসাময়িক সময়ে হাক ইশ
প্রথমে সংগঠনটি সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের সংগঠিত করতে কাজ করত বিশেষত যেসকল মন্ত্রণালয়ে মিল্টি সালামত পার্টির মন্ত্রী ছিল সেসব মন্ত্রণালয়ে সহজেই সংগঠন সম্প্রসারণ করার সুযোগ পায় । তাতে ১৯৭৬ সালে যেখানে মাত্র বিশ হাজার শ্রমিক যুক্ত ছিল তা এক বছরের ব্যবধানে প্রায় সাড়ে তিন লাখে উন্নীত হয়। যদিও ১৯৭৮ সালে মিল্টিত সালামত পার্টির কোয়ালিশন সরকারের পতন হলে সদস্য সংখ্যা কমতে থকে। ১৯৭৯ সালে অফিসিয়াল শ্রমিক সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ পয়ত্রিশ হাজারে।
এ সময়টাতে একটি সাধারণ শ্রমিকবান্ধব কনফেডারেশন হওয়ার চেয়ে মিল্টি সালামত পার্টির শ্রমিক সংগঠন হিসেবেই হাক ইশের কার্যক্রম চলতে থাকে। ১৯৮০ সালের সেনা ক্যুয়ের পর অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং ট্রেড ইউনিয়নের মতো হাক ইশকেও নিষিদ্ধ করা হয়। তবে এক বছরের মাঝেই হাক ইশের কার্যক্রম শুরুর অনুমতি দেওয়া হয়। এবার হাক ইশ তার কার্যক্রমে অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসে। কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতিতে সাধারণ শ্রমিকদের একটি কনফেডারেশন হওয়ার দিকেই বেশি গুরুত্ব দেয় এবং পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবেও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পৃথিবীর বড়ো বড়ো শ্রমিক কনফেডারেশন ইউনিয়নের সদস্যপদ পেতে নিজেদের সংবিধানে পরিবর্তন নিয়ে আসে। অর্থাৎ শ্রমিক সংগঠন হিসেবে একটি রাজনৈতিক দলের শাখা হওয়ার চেয়ে নিজস্ব পরিচয় বজায় রাখাকেই প্রধান্য দিয়েছে সংগঠনটি।
আশির দশকে ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী তরগুত ওযেলের সরকারের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ও যোগাযোগ রক্ষা করে সংগঠনটি। তবে নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন না দিলেও নব্বয়ের দশকে এসে নির্বাচনগুলোতে কনফেডারেশনের পক্ষ থেকে সেক্যুলারিজমের জুলুমের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়ে মূলত পরোক্ষভাবে রেফা পার্টিকেই সমর্থন দেয়। বিশেষত ১৯৯৭ সালের পোস্ট-মর্ডান ক্যুয়ের (যে ক্যুয়ের মাধ্যমে প্রফেসর এরবাকানকে ক্ষমতা থেকে নামানো হয়েছিল) পর হাক ইশ নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়।
বর্তমান সময়ে এরদোয়ানের সরকারের সাথে নিবিড় সমন্বয় রয়েছে কনফেডারেশনটির। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সময়কালেই সবচেয়ে বেশি স¤প্রসারিত হয় সংগঠনটি। তবে এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি। রাজনৈতিকভাবে তুরস্কে ইসলামপন্থী দলগুলোর মাঝে মতভেদ কিংবা সম্পর্কের টানাপোড়ান দেখা যায় কিন্তু পেশাজীবী ও শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নসহ অন্যান্য সামাজিক সংগঠনগুলো তাদের নিজস্ব পরিচয় নিয়ে সকল ইসলামপন্থী দলগুলোর সাথেই সম্পর্ক রক্ষা করে ও যথাসম্ভব সমন্বয় করে। আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে হাক ইশ কনফেডারেশনকে এখন একে পার্টি কিংবা সাদেত পার্টি অথবা নতুন হওয়া নিউ রেফা পার্টির কোনো সংগঠনের শ্রমিক সংগঠন বলার সুযোগ নেই। তবে এই দলই তাদের সাথে যোগাযোগ রাখে, আবার হাক ইশও তাদের সাথে সমন্বয় করে। নিজেদের প্রয়োজন ও সমস্যাগুলো পরস্পর যোগাযোগের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করে। পরস্পর পরস্পরের বড়ো বড়ো মিটিংগুলোতে যাওয়া-আসা করে বিশেষত কাউন্সিল কিংবা এ ধরনের বড়ো প্রোগ্রামগুলোতে।
হাক ইশ কনফেডারেশনভুক্ত ট্রেড ইউনিয়নসমূহ ও তাদের অবস্থা :
বর্তমানে হাক ইশ কনফেডারেশনভুক্ত ট্রেড ইউনিয়ন সংখ্যা ২১ টি। নি¤েœ ইউনিয়নগুলোর কাজের সেক্টরসমূহ এবং সদস্য সংখ্যাসহ সংশ্লিষ্ট সেক্টরে তাদের অবস্থানের একটি চিত্র তুলে ধরছি:
১. সেবা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : স্থানীয় সরকার তথা সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাসহ অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন এটি। ১৯৭৯ সালে যাত্রা শুরু করে এই সেক্টরের এবং হাক ইশের সদস্য ট্রেড ইনউনিয়নগুলোর মাঝেও এটি সবচেয়ে বড়ো। পাশাপাশি তুরস্কের সবচেয়ে বড়ো ইউনিয়নও এটি। বর্তমানে এর রেজিস্টার্ড সদস্য সংখ্যা ২৭৬৩৬০ জন। এই সেক্টরে ২য় থাকা ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা ১৩৩৩২৯ জন।
২. স্বাস্থ্য শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালসহ সার্বিক স্বাস্থ্য খাত এবং সমাজ সেবা কর্মরত শ্রমিকদের কাজ করে এই ট্রেড ইউনিয়নটি। ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করা ট্রেড ইউনিয়নটি বর্তমানে ২১৪৪৩৮ জন রেজিস্টার্ড সদস্য নিয়ে এই সেক্টরে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই সেক্টরে দ্বিতীয় থাকা ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা ৪৮২৮১ জন।
৩. ব্যাংক (অর্থ) শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : ব্যাংক, বীমাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন এটি। ২০১৩ সালে এটি যাত্রা শুরু করে। ৪৭৪৩৫ জন সদস্য নিয়ে এই ট্রেড ইউনিয়নটিও এই সেক্টরে এক নম্বর অবস্থানের রয়েছে। দ্বিতীয় থাকা ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা ৪০৪৩০ জন।
৪. স্টিল শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : মেটাল, স্টিল এবং মেকানিক সেক্টরের শ্রমিকদের নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন এটি। ১৯৬৫ সালে যাত্রা শুরু করা ট্রেড ইউনিয়নটি ৪৬১১৩ জন রেজিস্টার্ড শ্রমিক নিয়ে এই সেক্টরে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। প্রথমে থাকা ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা ২৬৮৩৮৫ জন।
৫. ডেস্ক (দপ্তর) শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : দোকান ও অফিস ইত্যাদিতে কাজ করা শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন এটি। এই সেক্টরে তুরস্কে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করে। এই ট্রেড ইউনিয়নের যাত্রা শুরু ২০১১ সালে, রেজিস্টার্ড সদস্য সংখ্যা ৪০৬২৯ জন। এই সেক্টরের বড়ো দুটো ট্রেড ইউনিয়ন তুর্ক ইশের আওতাধীন, যে সংগঠনগুলোর প্রত্যেকটির সদস্য এক লাখের বেশি।
৬. খাদ্য শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : ১৯৭৬ সালে এই ট্রেড ইউনিয়নটি প্রতিষ্ঠিত হয়। খাদ্য সেক্টরের সকল পণ্য তথা বিভাগের শ্রমিকদের নিয়ে এরা কাজ করে। ৩৮৬৮০ জন রেজিস্টার্ড শ্রমিক নিয়ে এই সেক্টরের ৬ টি ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে এরা এক নম্বর অবস্থানে রয়েছে।
৭. বন (কৃষি) শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : এটা মূলত বন, কৃষি ও মৎস্য ইত্যাদি সেক্টরের শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে। ২০০৩ সালে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু। ২৬১১৭ জন রেজিস্টার্ড সদস্য নিয়ে সংগঠনটি এ সেক্টরের রেজিস্টার্ড ৭ টি ট্রেড ইউনিয়নের মাঝে সবচেয়ে বড়ো ট্রেড ইউনিয়ন।
৮. নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সেক্টরের শ্রমিকদের নিয়ে সংগঠন এটি। ২০১১ সালে সংগঠনটি কার্যক্রম শুরু করে। তাদের রেজিস্টার্ড শ্রমিক সংখ্যা ২৩৪১৪ জন এবং এই সেক্টরে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। প্রথমে থাকা ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য ২৬১৫৬ জন।
৯. পরিবহন শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : সড়ক পরিবহন খাতের শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন এটি। ২০১৩ সালে এর যাত্রা শুরু এবং বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ১৩৯৮০ জন। এই সেক্টরে প্রথমে থাকা ট্রেড ইউনিয়নে সদস্য সংখ্যা ৩১১৭৭ জন।
১০. ফার্নিচার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : ফার্নিচার শিল্পের সবগুলো সেক্টরের শ্রমিকদের নিয়ে এদের কাজ। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ট্রেড ইউনিয়নটি। বর্তমানে ১২৪৪৯ জন শ্রমিক নিয়ে তারা এই সেক্টরে এক নম্বর অবস্থানে রয়েছে।
১১. হোটেল ও রেস্টুরেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : তুরস্ক যেহেতু পর্যটনের অন্যতম গন্তব্য সেহেতু এই সেক্টরে প্রচুর শ্রমিক কাজ করে। তবে ট্রেড ইউনিয়নে রেজিস্টার্ড শ্রমিক সংখ্যা অনেক কম। ১৯৭৯ সাল কাজ শুরু করে এই সেক্টরে কাজ করা ট্রেড ইউনিয়নটি। বর্তমানে তাদের সদস্য সংখ্যা ৪৬৮৭ জন এবং সেক্টরে দ্বিতীয়। প্রথম অবস্থানে থাকা ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা ৪৬২১৪ জন।
১২. বন্দর শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : ১৯৬৩ সালে এর যাত্রা শুরু। জাহাজ ভাঙা শিল্প ও বন্দর শ্রমিকদের এই সেক্টরে তাদের বর্তমানে ৫৯৬২ জন এবং ১ নম্বর অবস্থানে রয়েছে।
১৩. পেট্রোল শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : পেট্রোল, রসায়নিক দ্রব্য, প্লাস্টিক, টায়ার ও ঔষধ কারখানার শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন এটি। ২০০৩ সালে এর যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে এ সেক্টরে তাদের রেজিস্টার্ড শ্রমিক সংখ্যা ২০৯৭ জন। যেখানে এই সেক্টরে ১ম নম্বর ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা ৪৬৮১৯ জন (তুর্ক ইশের)।
১৪. মাটি শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : সিমেন্ট, মাটি, সিরামিক ও গøাস সেক্টরের শ্রমিকদের নিয়ে ২০১৪ সাল থেকে কাজ করে ট্রেড ইউনিয়নটি। বর্তমানে ৩৬৫৩ জন সদস্য রয়েছে। এই সেক্টরে ১ম স্থানে থাকা ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা ২৭৮৮৭ জন।
১৫. মিডিয়া শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : ৫৮৯০ জন সদস্য নিয়ে মিডিয়া সেক্টরের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মাঝে ১ম অবস্থানে আছে সংগঠনটি। ২০১২ সালে এর প্রতিষ্ঠা।
১৬. তুর্কি সাইপ্রাস সরকারি কর্মচারী ট্রেড ইউনিয়ন : তুর্কি সাইপ্রাসের সরকারি কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়নও এর সদস্য।
১৭. খনি শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : খুব অল্প সময় ধরে এই ট্রেড ইউনিয়নটির যাত্রা, ২০১১ সালে। খনি এবং পাথর সেক্টরে এদের কাজ। এদের রেজিস্টার্ড সদস্য সংখ্যা এখন ৪৫ জন। যেখানে এই সেক্টরে তুর্ক ইশের ট্রেড ইউনিয়ন এক নম্বর অবস্থানে রয়েছে (তাদের সদস্য সংখ্যা ২৯৫১৫ জন)।
১৮. যোগাযোগ শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : পোস্ট অফিস, কুরিয়ার, মোবাইল ও ইন্টারনেট যোগাযোগসহ এই সেক্টরের শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে এই ট্রেড ইউনিয়ন। ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করা সংগঠনটি ৭৩৩৫ জন সদস্য নিয়ে এই সেক্টরে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে (১ম অবস্থানে থাকা সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ১২৩০৭ জন)।
১৯. জ্বালানী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতের শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন এটি। ২০১৩ সালে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা এবং বর্তমানে এর রেজিস্টার্ড সদস্য সংখ্যা ৭৯০৮ জন। এই সেক্টরে প্রথমে থাকা ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা ৬৮৮৪৫ জন।
২০. পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : ১৯৭৮ সালে এদের যাত্রা শুরু। বর্তমানে এই সেক্টরে ৪২৩৩০ জন সদস্য নিয়ে দ্বতীয় অবস্থানে রয়েছে (প্রথম অবস্থান তুর্ক ইশের ট্রেড ইউনিয়নের, সদস্য সংখ্যা ৪৮৮৬৮ জন)।
২১. নির্মাণ শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন : ২০১৫ সালে নির্মাণ শ্রমিকদের নিয় যাত্রা শুরু করে ট্রেড ইউনিয়নটি এবং বর্তমানে সদস্য সংখ্যা ২৮৯ জন। এই সেক্টরে প্রথম অবস্থানে থাকা ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা ৫০৮২৮ জন।
হাক ইশভুক্ত ২১ টি ট্রেড ইউনিয়নের চিত্র আমাদের সামনে রাখলে কিছু বিষয় স্পষ্ট হবে। প্রথমত, সেবা, স্বাস্থ্য, ব্যাংক, বীমা কিংবা ডেস্কের মতো সেক্টরগুলোতে হাক ইশের অবস্থান ভালো এবং প্রথম দিকে রয়েছে। কিন্তু নির্মাণ, খনি কিংবা ভারী কাজের যে ট্রেড ইউনিয়নগুলো রয়েছে সেগুলোতে অবস্থান তুলনামূলক দুর্বল। হাক ইশের কার্যক্রমের পরিধি গত ১০-১২ বছরে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। উপরের বর্ণনা অনুযায়ী অনেকগুলো ট্রেড ইউনিয়নের যাত্রা শুরু এই সময়টাতে। সেক্টরভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়নগুলোতে পিছিয়ে থাকার আরেকটি বড়ো কারণও এটি। দেখা গেছে তুর্ক ইশের ট্রেড ইউনিয়নগুলো অনেক আগে থেকেই কাজ শুরু করে একটা উল্লেখযোগ্য অবস্থান আগেই তৈরি করেছে।
চলবে…………
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, তোকাত গাজী ওসমান পাশা বিশ্ববিদ্যালয়, তুরস্ক