আঁধার আমানিশার বুক চিরে কালো জুলমাতের পর্দা সরিয়ে শ্রমজীবীসহ গোটা বিশ্ব মানবতার মুক্তি ও কল্যাণের দিশারী হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)। বিশ্বনবী হচ্ছেন দ্বীন ইসলামের প্রধান ও পবিত্রতম মুখপাত্র। আর এক বাক্যে একমাত্র পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা ইসলাম হলো- কুরআন ও আস-সুন্নাহর সমাহার। বিশ্বনবির মহান সংগ্রামী জীবনে ও কর্মে আল কুরআনের নির্দেশনা মূর্ত হয়ে উঠেছে। তিনি আল কুরআনের মূর্ত প্রতীক।
আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেছেন, “আর নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী” (সুরা আল কলম: ৪)। আল্লাহ আরও ঘোষণা করেছেন, “তোমাদের যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও শেষ দিনের সাফল্যের আশা করে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি যিকির করে তাদের জন্যে আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।” (সুরা আল আহযাব: ২১)
শ্রমজীবীদের হাতের স্পর্শে বিশ্ব সভ্যতা উন্নতির শিখরে আরোহন করেছে। শ্রম ব্যতীত কোনো কিছুই উৎপাদিত হয় না এটি সর্বজনবিদিত। শ্রমের মাধ্যমেই সকল মানুষকে তার জীবন ধারণের সব চাহিদা পূরণ করতে হয়। শ্রম বিমুখ ব্যক্তি কখনোই জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারে না। নিরলস শ্রম সাধনাই মহানবি (সা.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের সাফল্যের একমাত্র কারণ ছিল। শ্রমজীবীদের প্রতি মহানবি (সা.) এর আদর্শ মুসলিম উম্মাহকে প্রেরণা, দিকনির্দেশনা তথ্য প্রেরণার বাতিঘর হিসেবে কাজ করছে।
ইসলামের সর্বশেষ রাসুল মুহাম্মদ (সা.) এর জন্ম থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর জামানার শ্রমজীবীসহ সকল মানুষের সম্মুখে ছিল এবং তাঁর ইন্তেকালের পর বিশ^ ইতিহাসের পাতায় তা পুরোপুরি সংরক্ষিত হয়েছে।
মহানবি (সা.) এর ওঠাবসা, নিদ্রা-জাগরণ, বিয়ে-শাদী, সন্তান-সন্তুতি, বন্ধু-বান্ধব, সালাত-সিয়াম, ২৪ ঘণ্টার ইবাদত, চলাফেরা, যুদ্ধ-সন্ধি, সফর ও অবস্থান, গোসল, মেলামেশা, আচার-ব্যবহার, এমনকি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, একত্রে শয়ন ও পবিত্রতা অর্জন প্রভৃতি প্রত্যেকটা বিষয় সম্পূর্ণ প্রকাশিতম, সর্বজনবিদিত ও সংরক্ষিত আছে। আর তা শ্রমজীবীসহ সকল মানুষের আদর্শ।
নবী চরিত্রের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা, কর্মের দৃঢ়তা, সদব্যবহার, সদাচার ও ইনসাফ, দানশীলতা, ত্যাগ, মেহমানদারী, ভিক্ষাবৃত্তির প্রতি ঘৃণা, কারো অনুগ্রহভাজন না হওয়া, অযথা প্রশংসার প্রতি বিরূপ মনোভাব, সারল্য ও অনাড়ম্বরতা, কর্তৃত্বের বড়াই ও লোক দেখানো ভাব থেকে দূরে অবস্থান, সাম্য, নম্রতা, লজ্জশীলতা, স্বহস্তে কাজ করা, হিম্মত ও দৃঢ়তা, সাহসিকতা, ইসরাফ-অপচয় (Over use) তাবজীর-অপব্যয় (Mis use), অল্পে তুষ্টি, ধৈর্য ও ক্ষমা, শ্রমজীবীদের-অসহায়দের প্রতি ভালোবাসা ও সমবেদনা, সাধারণভাবে সকলের জন্য করুণা ও ভালোবাসার প্রকাশ, অন্তরের কোমলতা, পীড়িতদের দেখাশোনা, নম্রমেজাজ এসব তো সকল মানুষেরই আদর্শ।
শ্রমজীবীদের হাতের স্পর্শে বিশ্ব সভ্যতা উন্নতির শিখরে আরোহন করেছে। শ্রম ব্যতীত কোনো কিছুই উৎপাদিত হয় না এটি সর্বজনবিদিত। শ্রমের মাধ্যমেই সকল মানুষকে তার জীবন ধারণের সব চাহিদা পূরণ করতে হয়। শ্রম বিমুখ ব্যক্তি কখনোই জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারে না। নিরলস শ্রম সাধনাই মহানবি (সা.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের সাফল্যের একমাত্র কারণ ছিল। শ্রমজীবীদের প্রতি মহানবি (সা.) এর আদর্শ মুসলিম উম্মাহকে প্রেরণা, দিকনির্দেশনা তথ্য প্রেরণার বাতিঘর হিসেবে কাজ করছে।
ইসলামী শ্রমনীতি শ্রমজীবীদের যথাযথ মর্যাদা দিয়েছে। আল্লাহ পাক বলেন, “তুমি যাকেই মজুর হিসেবে নিযুক্ত করবে, তন্মধ্যে শক্তিমান ও বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিই সর্বাপেক্ষা উত্তম। আমি তোমার ওপর কোনোরূপ কঠোরতা করতে চাই না, কোনো কঠিন ও দুঃসাধ্য কাজ তোমার ওপর চাপাতেও চাই না, আল্লাহ চাইলে তুমি আমাকে সজ্জন ও সদাচারী হিসেবেই দেখতে পাব।” (সুরা আল কাসাস: ২৬-২৭)।
মহানবি (সা.) বলেছেন, “মানুষের নিজের হাতের উপার্জনের চেয়ে ভালো অন্য কোন উপার্জন নেই।” (সহিহ বুখারি হাদিস: ২০৭১)
মহানবি (সা.) কে জিজ্ঞেস করা হলো, “কোন ধরনের উপার্জন সবচেয়ে পবিত্র ও পছন্দনীয়? তিনি বলেছেন, মানুষের স্বীয় হাত দিয়ে পরিশ্রমের মাধ্যমে উপার্জন।” এই পৃথিবীতে জীবনযাপন ও জীবিকার জন্য পরিশ্রম করা প্রয়োজন। আর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজেই সেই জীবিকা পৃথিবীতে তৈরি করে রেখেছেন।
ইসলামে কাজকে শ্রেষ্ঠ ইবাদত বলা হয়েছে। কায়িক শ্রম ইসলামে সম্মানিত স্থান লাভ করেছে। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) থেকে বর্ণিত মহানবি (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি সারাদিন পরিশ্রম করে দিনান্তে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তার সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে গেছে।”
একদিন মহানবি (সা.) কিছু সংখ্যক সাহাবির নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। এক সাহাবিকে দেখলেন তার হাত থেকে রক্ত ঝরছে। মহানবি (সা.) তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কী হয়েছে? সাহাবি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) আমি খেটে খাওয়া মানুষ, মজদুরী করে সংসার চালাই। আজ মজদুরী করতে গিয়ে হাত রক্তাক্ত হয়েছে। সাহাবির কথা শুনে মহানবি মুহাম্মদ (সা.) এর চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। তিনি শ্রমজীবী সাহাবির আহত হাতকে নিজের হস্ত মোবারকে ধরে চুমা খেলেন আর বললেন, এটাতো ঐ হাত যে হাত মহান আল্লাহর দরবারে সবচেয়ে বেশি প্রিয়।” হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, “উপার্জনকারীর স্বহস্তে উপার্জন হলো সর্বোত্তম, যখন সে তা কল্যাণের জন্য করে।” (মুসনাদে আহমদ)
উপার্জনের মধ্যে ব্যবসায়-বাণিজ্যের মধ্যে রয়েছে বরকত ও সমৃদ্ধি। তিনি মুদারাবা পদ্ধতিতে পুঁজিদাতা খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদের অর্থ নিয়ে সফলভাবে ব্যবসায়-বাণিজ্য পরিচালনা করেছেন। মহানবি (সা.) ইসলামী উম্মাহকে ব্যবসায়-বাণিজ্যে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য উৎসাহ প্রদান করেছেন। হাদিসে এসেছে মহানবি মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, “সত্যবাদী বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী কেয়ামতের দিন নবি, সিদ্দীক ও শহীদগণের সাথে থাকবে।” (মুসনাদে আহমদ: ১৫৮৩৬)
মহানবি (সা.) গবাদিপশু লালনপালন করেছিলেন, তিনি নিজের বকরি নিজেই দোহন করতেন। খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খনন করে মহানবি (সা.) ধুলি ধুসরিত হয়ে পড়েছিলেন। মহানবি (সা.) এর প্রবর্তিত অর্থনীতিতে শ্রমের ধারণা অনেক ব্যাপক। এতে মজুরির বিনিময়ে শ্রম বিক্রয়কারী মাজই ‘আযীর’ (শ্রমজীবী) হিসেবে বিবেচিত। একজন রাষ্ট্র প্রধান, সরকার প্রধানও একজন শ্রমজীবী। বিশেষায়নের বিভিন্নতা সত্ত্বেও ইসলামে আসলে সমগ্র সমাজই শ্রমিক সমন্বয়ে গঠিত।
ইতিহাস সাক্ষী, রাসুল মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনের মতো পরিপূর্ণ কল্যাণময় ও সকল খুঁটিনাটি অনুসরণীয় বিষয়ের তথা প্রকাশ্য আদর্শের আর একটি উদাহরণ কোথাও পাওয়া যায় না। মুক্তিকামী মানবতার সার্বিক জীবনে মহানবি মুহাম্মদ (সা.) এর পরিপূর্ণ জীবন অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। তিনি তো পরশমনি। তার রেখে যাওয়া আদর্শের অনুসরণে সবকিছুই কল্যাণময় হয়ে ওঠে। তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক রাষ্ট্রপ্রধান, ছিলেন শ্রেষ্ঠতম প্রজ্ঞায় বিভূষিত। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রটি সকল বাধা বন্ধন জয় করে জনকল্যাকামী মুক্তিকামী শ্রমজীবী মানুষের জীবনে সৌন্দর্য উদ্ভাসিত করেছে।
আজকের অশান্ত ও সমস্যাসঙ্কুল বিশ্বে শ্রমজীবীদের অধিকারের গিট খুলতে, বিশ্বে কাঙ্ক্ষিত শান্তি ফিরিয়ে আনতে মহানবি (সা.) এর আনীত আদর্শের আর কোন বিকল্প নেই।
লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্যাংকার।