আমরা একটি সুন্দর সমাজ চাই। চাই সুন্দর বাসযোগ্য মানবিক পৃথিবী। পৃথিবীকে সুন্দরভাবে গড়তে হলে নিজেদেরকে আগে সুন্দর হতে হবে। একজন মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে আমার চারিপাশকে সুন্দর করে গড়ে যাওয়া। সুন্দর পরিবেশের জন্য চাই সুন্দর প্রকৃতি। সবুজাভ পরিবেশ জনজীবনকে সুন্দর করে। তাইতো প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষা আমাদের দায়িত্ব। পরিবেশের অন্যতম নিয়ামক হলো উদ্ভিদ ও গাছপালা। গাছগাছালি, বৃক্ষতরু ও লতাগুল্ম থেকেই আসে আমাদের জীবনধারণ ও জীবন রক্ষার সব উপকরণ। বৃক্ষহীন পৃথিবী জীবনবিহীন মানুষের মতো। বৃক্ষ না থাকলে মানুষসহ পৃথিবীর কোনো জীবই বেঁচে থাকতে পারবে না। গাছপালা কমে গেলে বায়ুতে অক্সিজেনের অভাব দেখা দিবে। বায়ুতে বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাবে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে। পানির অভাব দেখা দিবে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা মরুভ‚মির ন্যায় হয়ে যাবে। প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে ও অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টির মতো নানান দুর্যোগ দেখা দিবে। তাইতো প্রিয় নবীজি (সা.) নিজ হাতে গাছ লাগিয়েছেন, সাহাবায়ে কেরামকে গাছ লাগিয়ে বাগান করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ব্যক্তিগত ও সামাজিক বনায়নও করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বৃক্ষরোপণকে সদকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বুখারি ও মুসলিম শরিফে সংকলিত হাদিসে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ, পাখি বা পশু যখন তাদের আহার্য গ্রহণ করে, তখন তা তার (রোপণকারী) পক্ষে একটি সদকা হিসেবে পরিগণিত হয়।’
প্রশান্তিময় পরিবেশ ও বনায়ন
আল্লাহ তায়ালা প্রাকৃতিক পরিবেশকে মানুষের সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক বাসোপযোগী করে অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন। প্রচন্ড শীতপ্রধান অঞ্চলগুলোতে যেখানে বছরের প্রায় পুরোটা জুড়ে মাঠ, ঘাট, নদী-নালা সর্বত্রই বরফে ঢাকা থাকে, সেখানেও প্রাকৃতিক উদ্ভিদকুল সবুজের ডানা মেলে এবং বরফ আচ্ছাদিত মৎস্যকুল স্বাভাবিক জীবন পরিচালনা করে। মূলত মহান আল্লাহ আমাদের উপকারের জন্য নানা প্রজাতির পশুপাখি, জীবজন্তু, উদ্ভিদ ও গাছপালা সৃষ্টি করেছেন। পাহাড়-পর্বত রক্ষা করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর পরিবেশের অন্তর্নিহিত প্রাণপ্রবাহ অব্যাহত রাখে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের বনভ‚মি উজাড় হবার কারণে বিশ্ব-পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। বৃক্ষ আবহাওয়ামন্ডলকে বিশুদ্ধ রাখে, জলীয় বাষ্প তৈরি করে বাতাসের আর্দ্রতা বাড়িয়ে বায়ুমন্ডলকে রাখে শীতল। বৃক্ষ বৃষ্টি ঝরিয়ে ভ‚মিতে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি করে, বাড়িয়ে দেয় মাটির জলধারণ ক্ষমতা। এ ছাড়াও গাছপালা মাটির উর্বরতা বাড়ায়, মাটির ক্ষয় রোধ করে। ঝড়-ঝঞা-বন্যা রোধেও পালন করে সহায়ক ভ‚মিকা। মাটির ওপর শীতল ছায়া বিছিয়ে দিয়ে ঠেকায় মরুকরণের প্রক্রিয়াকে।
নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রভাবে প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য বিরাণ ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। মূলত মানুষ অবিবেচকের মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার পরিবেশগত বিপর্যয়কে আরো বেশি ত্বরান্বিত করেছে। তা ছাড়া পরিবেশবাদীরা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা চিহ্নিত করতে গিয়ে প্রথমেই প্রাকৃতিক পরিবেশের দূষণকেই দায়ী করছেন। এ ক্ষেত্রে পরিকল্পিত নগরায়ণ এবং পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নই পারে আমাদের প্রাণসত্তার লীলাভ‚মি প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষিত রাখতে। আর বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে ছোট আয়তনের একটি দেশ হয়েও প্রাণবৈচিত্র্য এবং ভিন্ন রকম পরিবেশ ও জটিল বাস্তুসংস্থানে ভরপুর এক অনন্য পরিসর। কিন্তু দিন দিন দেশের এই বৈচিত্র্যময় প্রাণ ও পরিসর নিশ্চিহ্ন হয়ে এক সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি করছে।
পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য রক্ষা ও দূষণমুক্ত পরিবেশ তৈরিতে বৃক্ষ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। পরিবেশ সংরক্ষণে মানুষের সর্বপ্রধান দায়িত্ব হলো, দূষণের যথার্থ কারণ চিহ্নিত করে তা রোধকল্পে কার্যকরী ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বায়ু, পানি, বৃক্ষরাজি ও পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি। প্রাকৃতিক পরিবেশের উল্লিখিত উপকরণগুলোর মধ্যে নির্মল বায়ু ও সুপেয় পানিপ্রাপ্তি সব সৃষ্টজীবেরই প্রত্যাশিত। বিশ্বব্যাপী মানুষই শিল্পায়ন ও নগরায়ণের আড়ালে প্রাকৃতিক পরিবেশ তুলনামূলক নষ্ট করছে বেশি। শিল্পায়নের যুগে কল-কারখানার নির্গত কালো ধোঁয়া একদিকে যেমন বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বাড়িয়ে জীবনকে করে তুলছে দুর্বিষহ। অন্যদিকে কল-কারখানার নির্গত শিল্পবর্জ্য পানিতে মিশে পানিকে করছে দূষিত, যা মানুষের স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও মৎস্য প্রজাতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী আবু আলী ইবন সিনা বলেছেন, পৃথিবীর এত ধূলি, ধোঁয়া ও গ্যাস যদি মানুষের ফুসফুসে না ঢুকত, তাহলে মানুষ হাজার বছর ধরে সুস্থ অবস্থায় জীবিত থাকত।
বৃক্ষ তার ছায়া দিয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। বড় বৃক্ষ ছায়া দিয়ে পুকুর ও জলাশয়ের পানিকে সহজে বাষ্প হতে দেয় না। গাছের পাতা তার অতিরিক্ত পানি পাতার মাধ্যমে বাষ্পাকারে বায়ুমন্ডলে ছেড়ে দেয় যা বৃষ্টিপাতে সহায়তা করে। তাছাড়া বৃক্ষ নিজে কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্রহণ এবং অক্সিজেন ছেড়ে দেবার মাধ্যমে মানুষ ও অন্যান্য জীবের অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করে থাকে। এভাবে গাছপালা অন্যান্য জীবের নিঃশ্বাসের বায়ু গ্রহণের মাধ্যমে আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। অন্যদিকে গাছপালা মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে ও নদীভাঙ্গন রোধে ভূমিকা পালন করে।
মানুষের খাদ্য যোগানের জন্য বৃক্ষ প্রধান ভ‚মিকা পালন করে। মানুষ উদ্ভিদের ফল, লতাপাতা খেয়ে বেঁচে থাকে। গাছ মানুষের বেঁচে থাকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান অক্সিজেন এর একমাত্র উৎস। একটি পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষ বছরে যে পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করে, তা কমপক্ষে ১০ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা মেটায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টি এম দাস ‘১৯৭৯ সালে পূর্ণবয়স্ক একটি বৃক্ষের অবদান আর্থিক মূল্যে বিবেচনা করে দেখান যে ৫০ বছর বয়সী একটি বৃক্ষের অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় এক লাখ ৮৮ হাজার মার্কিন ডলার।’ এই জীবন রক্ষাকারী উপাদান ছাড়া মানুষ এক মুহূর্তও বেঁচে থাকতে পারে না। মানুষ তাপ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ও রান্নার জ্বালানির জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বৃক্ষের উপর নির্ভরশীল। তাছাড়া ঘরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থাপনার জন্য ব্যবহৃত কাঠ আমরা বৃক্ষ থেকেই পেয়ে থাকি। বৃক্ষ থেকে বিভিন্ন পণ্য তৈরি হয়। বনভ‚মি থেকে মধু ও মোম পাওয়া যায়। জীবন রক্ষাকারী নানান ঔষধ তৈরিতেও উদ্ভিদের দরকার হয়। গাছপালা নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পরিবেশকে রক্ষা করে। মাটির উর্বরতা ঠিক রাখে। তাছাড়া নদী ভাঙন, পানি স্ফীতি ও বৃষ্টিপাত নিয়ন্ত্রণেও গাছ মুখ্য ভ‚মিকা পালন করে। তাই গাছ লাগানোর মাধ্যমের আমাদের জীবন রক্ষায় উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
বনায়নে ইসলামী দৃষ্টিকোণ
পরিবেশ বৈচিত্র্যের অন্যতম কারিগর উদ্ভিদ। পৃথিবীর মোট উদ্ভিদ প্রজাতির ভেতরকার ২৫ ভাগই বৃক্ষ। আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ অমূল্য বৃক্ষ ছাড়া কল্পনা করা অবান্তর। তাই ইসলাম এই প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণে জনসচেতনতা তৈরিতে কালজয়ী নির্দেশনা প্রদান করেছে। সদকায়ে জারিয়ার জন্য ছায়াদানকারী ফলবান বৃক্ষই তুলনামূলক বেশি উপকারী। বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা করতে নির্দেশ দিয়ে মহানবী (সা.) বলেন, যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে কিয়ামত এসে গেছে, তখনও হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে, যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি রোপণ করবে। একদা নবী করিম (সা.) হজরত সালমান ফারসিকে (রা.) মুক্তির জন্য তাঁর মালিকের কাছে গেলেন। মালিক মুক্তিপণ হিসেবে ১০০ খেজুর গাছ রোপণের শর্তারোপ করলে রাসুল (সা.) তাতে রাজি হলেন এবং নিজ হাতে ১০০ খেজুর গাছের চারা রোপণ করে তাঁকে মুক্ত করলেন।
আল্লাহ তাআলা প্রকৃতিকে মানুষের জন্য জীবনধারণের অনুকূল, বাসযোগ্য, সুস্থ, সুন্দর, স্বাভাবিক ও ভারসাম্যপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন। বৃক্ষলতা না থাকলে এ জগতে মানুষের বসবাস অসম্ভব হতো। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআন মাজিদে বলেন, ‘তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন। তাতে তোমাদের জন্য রয়েছে পানীয় এবং তা থেকে জন্মায় উদ্ভিদ, যাতে তোমরা পশুচারণ করে থাকো। তিনি তোমাদের জন্য তা দিয়ে জন্মান শস্য, জইতুন, খেজুরগাছ, আঙুর ও বিভিন্ন ধরনের ফল। অবশ্যই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ১০-১১। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন, অতঃপর তা মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে, অতঃপর তিনি মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তা স্তরে স্তরে রাখেন। এরপর তুমি দেখতে পাও, তার মধ্য থেকে বারিধারা নির্গত হয়। তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা তা পৌঁছান, তখন তারা আনন্দিত হয়।’ (সুরা রুম, আয়াত: ৪৮)।
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে প্রকৃতির যতগুলো নিয়ামত দান করেছেন, তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছে বৃক্ষরাজি। ইসলামে হালাল জীবিকা উপার্জন ও জনকল্যাণমূলক বিষয় হিসেবে কৃষিকাজ তথা ফলবান বৃক্ষরোপণ ও শস্যবীজ বপনের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত রয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তারা কি লক্ষ্য করে না, আমি উষর ভূমির ওপর পানি প্রবাহিত করে তার সাহায্যে উদগত করি শস্য, যা থেকে তাদের গবাদি পশু এবং তারা নিজেরা আহার গ্রহণ করে, (সূরা সিজদাহ, ২৭)। মানবসভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ আগুন। আগুনের অন্যতম উৎস বৃক্ষ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যিনি তোমাদের জন্য সবুজ বৃক্ষ থেকে অগ্নি উৎপাদন করে দিয়েছেন, সে মতে তোমরা তা থেকে আগুন জ্বালিয়ে নিতে পারো।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত: ৮০)। ‘তোমরা যে অগ্নি প্রজ্বালিত করো, তা লক্ষ্য করে দেখছ কি? তোমরাই কি অগ্নি উৎপাদন বৃক্ষ সৃষ্টি করো, না আমি? আমি একে করেছি নিদর্শন এবং মরুচারীদের প্রয়োজনীয় বস্ত্র।’ (সুরা ওয়াকিয়া, আয়াত: ৭১-৭৩)। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক। আমিই প্রচুর বারি বর্ষণ করি, অতঃপর আমি ভ‚মিকে প্রকৃষ্টরূপে বিচূর্ণ করি এবং আমি উৎপন্ন করি শস্য, আঙুর, শাকসবজি, জইতুন, খেজুর এবং বহু বৃক্ষবিশিষ্ট উদ্যান, ফল ও গবাদিপশুর খাদ্য, এটা তোমাদের এবং তোমাদের পশুগুলোর জীবনধারণের জন্য।’ (সুরা আবাসা, আয়াত: ২৪-৩২)। ‘তারা কি লক্ষ করে না, আমি ঊষর ভ‚মিতে পানি প্রবাহিত করে তার সাহায্যে উদ্গত করি শস্য, যা থেকে তাদের গবাদিপশু এবং তারা নিজেরা আহার করে। তারা কি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হবে না?’ (সুরা সেজদা, আয়াত: ২৭)।
রাসুলুল্লাহ সা. বৃক্ষরোপন ও বনায়নে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি বৃক্ষরোপণ করে তা ফলদার হওয়া পর্যন্ত তার পরিচর্যা ও সংরক্ষণে ধৈর্য ধারণ করে, তার প্রতিটি ফল যা নষ্ট হয়, তার বিনিময়েও আল্লাহ তাআলা তাকে সাদকার নেকি দেবেন।’ মুসনাদে আহমাদের ২৩৫৬৭ হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষ রোপণ করে, আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তাকে ওই বৃক্ষের ফলের সমপরিমাণ প্রতিদান দান করবেন।’ গাছের প্রতিটি পাতা আল্লাহর জিকির করে। সেই জিকিরের সওয়াব রোপণকারীর আমলনামায় লেখা হয়। তাই আমাদের বেশি করে বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন করা উচিত।
বাংলাদেশে বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন প্রসঙ্গ
পরিবেশের দূষণ ও বিপর্যয়সহ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর একটি। উষ্ণায়ন বৃদ্ধির ফলে জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে ভুগছে দেশ। ফলে নানাবিধ ক্ষতির সঙ্গে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগও। বাংলাদেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হলেও এখন গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত এ তিনটি ঋতু ছাড়া অন্যান্য ঋতু এখন আর দৃশ্যমান হয় না। বিজ্ঞানীদের মতে প্রতিটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় কমপক্ষে ২৫ ভাগ বনভূমির প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে মাত্র ১৬ ভাগ অঞ্চল বনভূমির অন্তর্গত। সরকারি হিসাব মতে বাংলাদেশে বনভ‚মির পরিমাণ মাত্র ৯ ভাগ। আবার অন্য একটি জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৩.৫ ভাগ।
বাংলাদেশের বনাঞ্চলকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বনভূমি, শালবন বনভূমি ও স্রোতজ বনভূমি। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম, পার্বত্য জেলাসমূহ ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ১৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বনভ‚মি। তাছাড়া ভাওয়াল ও মধুপুর গড় এর প্রায় এক হাজার বর্গ কিলোমিটার এবং ময়মনসিংহ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, রংপুর, দিনাজপুর, কুমিল্লার একটি বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে শালবন। আর দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের সমুদ্রের উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিরাজমান সুন্দরবন-ই হচ্ছে স্রোতজ বনভূমি।
বাংলাদেশকে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বলা হয় একমাত্র বাংলাদেশের সবুজ ফসলের ক্ষেত ও বনভূমির জন্য। একসময় ছিল যখন বিদেশ থেকে অনেক পর্যটক আসতো শুধুমাত্র আমাদের দেশের সবুজ বনভ‚মি দেখতে। কিন্তু মানুষের অসচেতনতার কারণে ক্রমেই কমে যাচ্ছে বনভ‚মির পরিমাণ। ক্রমাগত বৃক্ষ কমে যাওয়ায় নানান বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটছে আমাদের দেশে। প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ এখন বাংলাদেশে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমাগত বৃক্ষ নিধনের ফলে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বেড়ে যাচ্ছে গ্রীনহাউস প্রতিক্রিয়া। আগের দিনের সেই আম, কাঁঠাল, সুপারি ও নারিকেলের বাগান আর তেমন দেখা যায় না। মানুষ গাছপালা কাটছে ঠিকই কিন্তু গাছপালা লাগানোর ক্ষেত্রে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। গাছের বদলে মানুষ এখন গড়ছে বড় বড় ইমারত। গাছপালা থেকে এখন মানুষের নিকট ইমারতের মূল্য বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বর্তমানে এই অবস্থার কারণে পৃথিবী ক্রমেই হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
বাংলাদেশে বনায়নের এক বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। সামাজিকভাবে এই বনায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে জনগণ বৃক্ষরোপনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারবে। জনগণকে নানান জাতের গাছের বীজ প্রদান করা যেতে পারে যার ফলে সাধারণ জনগণ ও গ্রামবাসীরা নতুন নতুন ও বাহারি জাতের ফল, শস্য, খাদ্য, জ্বালানি পেয়ে গাছ লাগাতে উৎসাহী হবে। তাছাড়া জনগণের মাঝে বিনামুল্যে বীজ সরবরাহ, সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি ও সার সরবরাহের মাধ্যমে জনগনকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। জনগণকে বৃক্ষরোপণের উপকারিতা ও বৃক্ষনিধণের অপকারিতা জানিয়ে সচেতন করা যেতে পারে। গ্রাম, মহল্লার সাধারণ জনগণকে প্রশিক্ষন ও বেতন প্রদানের মাধ্যমে এলাকা ও মহল্লার রাস্তার পাশে, মসজিদ-স্কুলের আঙিনায়, নদীর পাড়ে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই কর্মকান্ড দেখে সাধারণ জনগণও উৎসাহিত হবে। আর সেসব গাছ থেকে যা আয় হবে তা গ্রামবাসীদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে। তাছাড়া টিভি, পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদির মাধ্যমেও সচেতনতা সৃষ্টি ও বৃক্ষরোপনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ বিষয়ে বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে হবে। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিশু-কিশোরদের বৃক্ষপ্রেমী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বৃক্ষরোপণের প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। বৃক্ষরোপণে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী হতে হবে। বিশেষ বিশেষ দিনগুলোকে উপলক্ষ করেও বৃক্ষরোপণ করা যেতে পারে। সেটা হতে পারে প্রত্যেক ব্যক্তির স্মরণীয় কোন দিনে, সন্তানের প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিন, বিবাহবার্ষিকীতে, বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্মরণে, পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের নামে, পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিনে কিংবা অন্য কোনো বিশেষ কারণে গাছ লাগানো যেতে পারে।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করে আসছে। বনায়ন কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন-সংস্থা জ্বালানি কাঠের বাগান, বন-বাগান, স্ট্রিপ-বাগান তৈরি করছে। বনায়ন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যে ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। জনসাধারণের মধ্যে চারা বিতরণ করা হচ্ছে। উপকূলীয় চরাঞ্চলে, মহাসড়কের দুপাশে, রেলসড়কের উভয় ধারে এবং বাঁধ এলাকায় বনায়ন করা হচ্ছে। বন অধিদপ্তরকৃত কমিউনিটি বনায়ন কর্মসূচি, বিভিন্ন থানায় বনায়ন ও নার্সারি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহণ, বনায়ন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদানসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে গাছের চারা বিতরণ করা হয়। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ইতোমধ্যে ম্যানগ্রোভ জাতীয় গাছের চারা লাগানো হয়েছে।
সারা বছরেই গাছ লাগানো যায়। তবে জুলাই-আগস্ট মাস বসচেয়ে উপযুক্ত সময়। দেশের ছোট-বড় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, রেললাইন ও সড়কের পাশে, সরকারি-বেসরকারি অফিস, রাস্তার দুই পাশে, পতিত ও খাসজমিতে, উপকূলীয় এলাকায়, গৃহস্থালির আঙিনায় ও বাড়ির ছাদসহ অন্যান্য জায়গায় ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ লাগানোর ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। দরকার শুধু চেষ্টা ও রক্ষণাবেক্ষণের যথাযথ উদ্যোগ। ওয়ার্ড মেম্বারের নেতৃত্বে এবং শিক্ষক, সমাজকর্মী, মসজিদের ইমাম প্রমুখের সমন্বয়ে গঠিত গ্রাম সংস্থা গঠন করে বনায়নের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এ সংস্থার কাজ হবে সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের সাথে সামাজিক বনায়ন-বৃক্ষায়ণ সম্পর্কিত সকল বিষয় তদারক করা এবং গ্রামের জনসাধারণকে পরিবারভিত্তিতে বনায়নের কাজে সম্পৃক্ত করা। বাঁধ, সড়ক, রেলপথ, রাজপথ, খালের পাড়, পুকুর পাড়, খাস জমি ইত্যাদির আশেপাশে যেসব পরিবার বাস করে তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা বরাদ্দ দেওয়া। তারা বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যার ভার গ্রহণ করবে এবং এ থেকে যে আয় হবে, নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী সে আয়ের অংশ তারা পাবে। এভাবে যেসব পরিবার খালি জায়গা বা পাহাড়-পর্বতের আশেপাশে থাকে তাদের সেখানে বনায়নে সম্পৃক্ত করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায় যে, বন ও বন্য পশুপাখি আল্লাহ পাকের দান ও প্রাকৃতিক নেয়ামত। নবী করিম (সা.) এগুলোর সংরক্ষণের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি মক্কা মুকাররমা ও মদিনা মুনাওয়ারার বিশেষ এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা বলে ঘোষণা করেছেন। ওই এলাকায় গাছপালা কাটা এবং সেখানে পশুপাখি শিকার করা আজও নিষিদ্ধ। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনে রিও তে পরিবেশ বিষয়ক এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যা ধরিত্রী সম্মেলন নামে পরিচিত। সারা বিশ্বের ১৭০ টি দেশের প্রতিনিধির অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে বৃক্ষ নিধন ও এর বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে তারা আশঙ্কা করেছিলেন যে, বিশ্বে যেভাবে বৃক্ষ নিধন চলছে এভাবে চলতে থাকলে পৃথিবী একটি বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হবে। মূলত, বৃক্ষরোপনের উদ্দেশ্যই হলো বনায়ন তৈরি এবং সেই বনভূমিকে টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে বিশ্বকে রক্ষা করা। আজকাল অনেক অসাধু ব্যবসায়ীরা অসাধু উপায়ে গাছপালা নিধন করছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেসব অসাধু ব্যবসায়ীদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ এবং অধিক হারে বৃক্ষরোপণের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। দেশের নাগরিকদের প্রত্যেককে কর্মস্থলে-বাসস্থানে বনজ, ফলদ ও ভেষজগাছ লাগানোর আহ্বান জানানো হচ্ছে। বৃক্ষমেলাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আঙিনা, ছাদ, সড়কসহ অফিস-আদালতের যেখানে পরিত্যক্ত জায়গা আছে, সেখানেই গাছ লাগানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। দেশের শহরাঞ্চলে জায়গার অভাবে গাছ লাগানো যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে ‘ছাদবাগান’ কর্মসূচির মাধ্যমে গাছ লাগানো যেতে পারে। শহরগুলোকে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হলে সবুজায়ন করা জরুরী। নগরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং মানুষের প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য বিভিন্ন পার্কে-উদ্যানে, সড়কের চারপাশে, নদী কিংবা খালের পাশে ও বিভিন্ন ফাঁকা জায়গায় গাছ লাগাতে হবে। প্রাকৃতিক বন বৃদ্ধি, সংরক্ষণ ও টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি সামাজিক ও গৃহস্থালি বনায়নের প্রতি আরো জোর দিতে পারলে বনভূমির পরিমাণ ২৫ শতাংশে আনা অসম্ভব নয়। সবুজাভ বাংলাদেশ গড়তে পারলেই একটি মানবিক সমাজ তৈরি করা সহজতর হবে।
[লেখক: কবি ও গবেষক, প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।]