শ্রমিকের মজুরি, ছুটি, বোনাস, গ্র্যাচুয়িটি, পেনশন, ক্ষতিপূরণ ওভারটাইম বকেয়াসহ চুক্তিভিত্তিক ও আইনসঙ্গত সকল প্রাপ্য আদায় শ্রমিকের জন্য শোভন কাজ ও কর্ম ক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ শ্রমিককে সাংগঠনিক ও আইনি সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন সেতুবন্ধনের ভূমিকা পালন করে।
ট্রেড ইউনিয়ন হল শিল্প, কলকারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও পেশায় নিয়োজিত শ্রমিক কর্মচারীদের দ্বারা গঠিত একটি আইনস্বীকৃত সংগঠন যেটি শ্রমিকদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায়, জীবনমান উন্নয়নে, জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা বিধানে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করে এবং মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখে।
১। ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের দাবি নয় অধিকার:
যেকোনো পেশায় নিয়োজিত শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন করার সাংবিধানিক অধিকার আছে। জন্মগতভাবে যেকোনো মানুষ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে ভোটাধিকার পায় তেমনিভাবে প্রত্যেক শ্রমিক সাংবিধানিকভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবে। শ্রম আইনের ১৭৯ নং ধারায় প্রত্যেক শ্রমিককে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দেওয়া হয়েছে।
২। ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের সুসংগঠিত করে:
একেই পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে শ্রমিকেরা পরস্পরের সাথে পরিচিত হয়। মনের ভাব আদান প্রদান করার সুযোগ পায়। পরস্পরের সমস্যা ও সুবিধা-অসুবিধা আলোচনা করতে পারে। শ্রমিকদের দাবি আদায়ে ট্রেড ইউনিয়ন ভূমিকা পালন করে বলে শ্রমিকেরা সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পায়।
৩। সুষ্ঠু শিল্প সম্পর্ক ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে:
ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে মতের আদান প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি হয় শ্রমিক সুবিধা অসুবিধা মালিক বা কর্তৃপক্ষ জানতে পারে এবং সমাধানের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে শ্রমিকদের মাঝে আস্থা সৃষ্টি করে যাতে শিল্প কারখানায় সুষ্ঠু শিল্প সম্পর্ক বজায় থাকে এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
৪। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিকাশ:
রাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও টেকসই করতে শ্রমজীবী মানুষের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শ্রমজীবী মানুষ তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থা ঠিক রাখে বলে দেশ ও রাষ্ট্র এগিয়ে যায়। আর ট্রেড ইউনিয়ন রাষ্ট্রের উৎপাদিকা চালিকা শক্তি শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক মর্যাদা ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করে।
৫। কর্মঘণ্টা নির্ধারণ ও চাকুরির নিশ্চয়তা:
সাধারণত দৈনিক ৮ ঘণ্টা করে এবং সাপ্তাহিক ৪৮ ঘণ্টা কর্ম সময় হিসেবে ধরা হয়। বিশ্রাম ও খাবার সময় ব্যতিত যে পরিমাণ সময় শ্রমিকেরা তাদের নিয়োগকর্তার অধীনে কাজের জন্য দিয়ে থাকে সেই সময়কে কর্ম সময় বা কর্মঘণ্টা বলে। শ্রম আইন ১০৮ ধারা ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের কাজের ঘণ্টা ও চাকরির নিশ্চয়তাসহ বিভিন্ন বিষয় মালিকদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে শ্রমিকদের কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ কর্মঘণ্টা নির্ধারণ ও চাকরি নিশ্চিত করণে ভূমিকা রাখে।
৬। শ্রমিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা/সুবিধা প্রাপ্তি:
সর্বনি¤œ মজুরির হার নির্ধারণ, মজুরি পরিশোধ, দুর্ঘটনাজনিত কারণে ক্ষতিপূরণ, উৎসব বোনাস, পেনশন, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, চাকরির অবস্থা ও পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ট্রেড ইউনিয়ন ভূমিকা পালন করে।
৭। সামাজিক নিরাপত্তা:
বাংলাদেশ উচ্চ আয়ের দেশে পৌঁছতে হলে শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। দেশে প্রায় ৬ কোটি ৮২ লাখ শ্রমিক আছে। রাষ্ট্রকে সকল শ্রমিকের সামাজিক সুরক্ষার নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য মালিক শ্রমিক সরকার সকলের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। শ্রমিকদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি ও নিরাপত্তায় ট্রেড ইউনিয়ন কার্যকর ভূমিকা রাখে।
৮। শ্রমিকদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা:
সমাজ ও রাষ্ট্র শ্রমিকদেরকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ইসলাম শ্রমিকদের সম্মান মর্যাদা নিশ্চিত করেছে। ইসলামী সমাজে একথা বাস্তবায়ন করেছে যে, আল্লাহর বান্দা হিসেবে সবাই সমান। এতে কোন ভেদাভেদ নাই। হাদিসে শ্রমিক ও মালিক পরস্পরকে ভাই সম্বোধন করে মূলত ইসলাম শ্রেণি বৈষম্যের বিলোপ করেছে। ট্রেড ইউনিয়ন করার মাধ্যমে একজন শ্রমিক একা থাকে না। সংঘবদ্ধ বা সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হয়। তাই ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় ভূমিকা পালন করে।
৯। শ্রমিকদের প্রতি সহানুভুতিশীল আচরণ নিশ্চিত করণ:
মানবতার কল্যাণ নৈতিক উন্নয়ন সৃষ্টির সেবা ও উৎপাদনে নিয়োজিত সকল কায়িক শক্তিকে শ্রম বলে। সভ্যতার এই চালিকা শক্তির বেশীরভাগেই শ্রমিকেরা পরিচালনা হয়। তাই শ্রমিকদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দিতে হবে এবং তাদের সাথে সম্মানজনক আচরণ করতে হবে। কথায় কথায় শ্রমিকদেরকে হয় প্রতিপন্ন করা বা তাদের কাজকে ছোট করে দেখার সুযোগ নাই। ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে শ্রমিকেরা সংঘবদ্ধ শক্তিতে পরিণত হয়। তাই শ্রমিকদের সাথে যেমন তেমন আচরণ করতে যে কেউ ভয় পায়। তাই ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ নিশ্চিত হয়।
১০। শ্রমিক ছাড়াই মজুরি কর্তনের পরিমাণ কমে:
বাংলাদেশে শ্রমিকদের চাকরি হারানো কোন ব্যাপারই নয় এমন একটি অভিযোগ রয়েছে। শ্রমিকের সামান্য একটু দোষে অথবা মালিকের পছন্দ অপছন্দের কারণে শ্রমিকের জীবিকা নাই হয়ে যেতে পারে। বিভিন্ন অজুহাতে কর্তৃপক্ষ শ্রমিকের মজুরি কর্তন করে ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিক ও মালিক কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে এই পদ্ধতির অবসান করে। তাই যেখানে ট্রেড ইউনিয়ন থাকে সেখানে ঠুনকো অজুহাতে শ্রমিককে চাকরিচ্যুত ও মজুরি কর্তন করতে পারে না।
১১। শ্রমিকদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করে:
ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে শ্রমিকদের দাবি দাওয়া সমস্যা সমাধান অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করণ হয় বলে ট্রেড ইউনিয়নের প্রতি শ্রমিকদের আস্থা সৃষ্টি হয়। শ্রমিকেরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে উৎসাহী হয়।
১২। সৎ যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব সৃষ্টি:
ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে সেতু বন্ধনে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ ভূমিকা পালন করে। তাই কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার মোকাবেলা করতে হয় ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকে। এই সব কাজ করার কারণে ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে সৎ, দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়।
উপসংহারে বলতে হয় এতকিছুর পরেও যেখানে বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এমন শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে গেছে যে রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অথচ আমাদের দেশে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে রাষ্ট্র দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। শিল্প উন্নয়নশীল বাংলাদেশে রাষ্ট্র সরকার ও শ্রম অধিদপ্তরের প্রতি আহ্বান ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে সমস্যা বা জটিলতা সৃষ্টি না করে অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে সহযোগীতা করুন। দেশের চালিকাশক্তি শ্রমিকদের সম্মান, সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।
লেখক: কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন