পাট ও পাট শিল্প বাংলাদেশের জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা এবং উন্নতির দ্বার প্রান্তে নিয়ে যাওয়া একটি জাতীয় গুরু দায়িত্বও বটে। এই শিল্পের সাথে বর্তমানে দেশের প্রায় ৪ কোটি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত। পাটকে এক সময় সোনালী আঁশ বলা হতো। কেননা এক সময় পাট সোনার দামে বিক্রি হতো। পাট শিল্প এক সময় ভারতের হুগলী এলাকায় গড়ে ওঠে। তারপর পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫১ সালের পরে এ শিল্প হু হু গড়ে ওঠে। এক সময় বৈদেশিক মুদ্রার ৮০% আয় হতো আমাদের স্বর্ণ সূত্র পাট থেকে। বিশ্বের ৭০% পাট বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হতো। এই শিল্পকে নিয়ম মত ধরে রাখলে, পরিচর্যা করলে বিশ্বের ১নং শিল্পে রূপান্তরিত হতো।
গার্মেন্টস শিল্প ও পাট শিল্পের পার্থক্য বিরাট। গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল সম্পূর্ণ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু পাট শিল্পের কাঁচা মাল সম্পূর্ণভাবে এ দেশেই উৎপাদিত হয়। পাট শিল্পের উত্থান ও পতন নিয়ে আলোচনা করলে একটা বড়ো বই লেখা যাবে। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা দেশকে বাঁচায় রাখার সমতুল্য। মানুষ যৌবন কে ভালোবাসে বৃদ্ধকে পছন্দ করে না, পাটের যৌবন এ দেশে ফুরানোর কথা নয়। কিন্তু সার্বিক অযত্ম, অবহেলা, চাটার দলের কারণে এ শিল্পে আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। দেশ প্রেমিক জনতাকে এটা নিয়ে ভাবেতে হবে এবং পাট শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে।
১। পাট উৎপাদনের জেলা/স্থান সমূহ
বাংলাদেশ, ভারত ও চীনে পাট জন্মায়। তবে বাংলাদেশে; সিংহভাগ এবং সর্বোত্তম পাট জন্মায়। বাংলাদেশে বিশেষ করে ময়মনসিংহ, ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুর, পাবনা, রংপুর, রাজশাহী জেলায় পাট অধিক জন্মায়। বিশ্বের ৮০ ভাগ পাট বাংলাদেশে উৎপন্ন হত। ফরিদপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, কুড়িগ্রাম, নওগাঁ, রাজশাহী, জামালপুর, ময়মনসিংহ (দেশি পাট), যশোর, কুষ্টিয়া, নড়াইল, সাতক্ষীরা (নর্দান পাট), মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদাহ (কালাপাট), ফরিদপুর এলাকা (ডিস্টিক বা লাল পাট)।
২। পাট কল সমূহ (জুট মিল)
১৯৫০ সাল পর্যন্ত এদেশে কোন পাটকল গড়ে ওঠেনি। ১৯৫১ সালে ১০০০ তাঁত নিয়ে নারায়ণগঞ্জের আদমজী নগরে প্রথম ও প্রধান পাটকল প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল। প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক এই পাট কলের শ্রমিক ছিল। খুলনা, যশোর, কানাইপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, চিটাগাং,ভৈরব, রংপুর, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, ঢাকা জেলায় পাটকল গুলি গড়ে ওঠে।
৩। পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, ভারত, পাকিস্তান, চায়না, রাশিয়া, ইরান, নেপাল, শ্রীলংকা, সুদান, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ সমূহসহ বিভিন্ন দেশ পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করা হয়।
৪। পাট থেকে উৎপন্ন পণ্য
দড়ি, কাছি, চটের বস্তা, ব্যাগ, কার্পেট, মসৃণ বস্ত্র, রবারের সঙ্গে পাট মিশিয়ে নানা ধরনের শিল্প দ্রব্য প্রস্তুত করা হয়। বাংলাদেশী বিজ্ঞানীর আবিস্কৃত পলি ব্যাগ, এছাড়া (১) হেশিয়ান, (২) স্যাকিং, (৩) সিবিসি (কার্পেট ব্যাকিং ক্লথ), (৪) জিও জুট ইত্যাদি তৈরি ও বিদেশে রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের বর্তমানে প্রায় ২৫/৩০ ভাগ পাট ও পাটজাত দ্রবের মাধ্যমে অর্জিত হয়। আরও তৈরি হয় হেসিয়ান কাপড় ও ব্যাগ, স্যাকিং কাপড় ও ব্যাগ/বস্তা, ভেজিটেবল ওয়েল ট্রিয়েটিড (VOT) জিও জুট (নদী ভাঙ্গন রোধে) সুতলী, ডিডিএফ, পলিথিনের বিকল্প ব্যাগ তৈরির পাইলট প্লান্ট, পাট পলিমার ইউনিট, জুট জিও টেক্সটাইল (মাটি ক্ষয়), নদী ভাঙ্গন রোধ, পরিবেশ সুরক্ষা, কাচা রাস্তার ধস রোধে জিও জুটের গুরুত্ব অপরিসীম।
পাট শিল্পের লোকসানের কারন ও প্রতিকারের উপায়
১.বি জে এম সি নামক শ্বেতহস্তীকে সংস্কার করতে হবে, ঢেলে সাজাতে হবে, জনবল কমাতে হবে। সর্ব প্রকার দুর্নীতি মুক্ত করতে হবে ও সৎ যোগ্য, দক্ষব্যক্তিদের দ্বারা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে হবে।
২.উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য চায়না মেশিন স্থাপন করা, BMRE করা, সময়মত ওভার হলিং করা, মেইনটেনেন্স করা, বয়লারের আধুনিকায়ন করা, জেনারেটরের ব্যবস্থা করতে হবে। ঋন মওকুফ অথবা ফ্রিজ করতে হবে। বিদ্যুৎ বিল কমাতে হবে। পারফরমেন্স মিটিং সিবিএ নেতাদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বপ্রকার অপচয় রোধ করে উৎপাদন খরচ কমিয়ে উৎপাদন (টার্গেট প্রডাকশন) করার জন্য সকলে মিলে চেষ্টা করতে হবে।
৩.সৎ ও দক্ষ লোক নিয়োগ : দুর্নীতি লুটপাট, চুরি ও অপচয় রোধের জন্য মিল ব্যবস্থাপনায় সৎ, অভিজ্ঞ ও দক্ষ লোকদের নিয়োগ করতে হবে। তাদের কঠিন জবাবদিহির ব্যবস্থা করতে হবে। অলস কর্ম বন্ধ করতে হবে। কাজ না করে বিল করা ও পাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। নেতাগিরি করে কাজ না করে মজুরি-বেতন দেওয়া যাবে না।
৪.কাঁচা পাট ক্রয় : সকল প্রকার ক্রয় ক্ষেত্রে দুর্নীতি মুক্ত থাকতে হবে। এজেন্সীতে সৎ, যোগ্য লোক দিতে হবে। রাজনীতি করলে সব শেষ হয়ে যাবে, মন্ত্রণালয় ও বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে মিলকে পাট ক্রয়ের ক্ষমতা দিতে হবে। মৌসুমে সময় মত পাট ক্রয় করতে হবে তার জন্য সঠিক সময়ে সময়মত প্রয়োজনমত Spar Parts সরবরাহ করতে হবে।
৫.আন্তর্জাতিক মার্কেট: উৎপাদিত পন্য বিক্রির জন্য আন্তর্জাতিক মার্কেট সৃষ্টি করতে হবে। উৎপাদনের সাথে সাথে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে।
৬.ব্যাংক ঋনের সুদ : ব্যাংক ঋনের উপর সুদের হার ১৪% থেকে ৫% এর আনতে হবে।
৭.বিদ্যুৎ বিল : বিদ্যুৎ বিলের হার সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে।
৮.লোকবল কমানো : মিল সুষ্ঠুভাবে চালানো ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ লোক রেখে অতিরিক্ত জনবল স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এক কালীন পাওনা পরিশোধ করতে হবে।
৯.উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সময়মত মজুরি বেতন দিতে হবে, সপ্তাহের মজুরি সপ্তাহে দিলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
১০.ভারতীয় পাট বীজ : ভারতীয় পাট বীজ দিয়ে পাট চাষ বন্ধ করতে হবে। ভারতীয় পাট বীজ দিয়ে খারাপ পাট উৎপাদন হয়, তাতে পাট শিল্পে উৎপাদন কমে যায়, সুতা ছিড়ে উৎপাদন ঘাটতি হয়, চোরা চালানী বন্ধ করতে হবে।
১১.আভ্যন্তরীণ ভাবে পাট ও পাট জাত দ্রব্যের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, সকল প্রকার কৃত্তিম রশি আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে, পলিথিন জাতীয় সকল বস্তা, থলে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। উৎপাদিত প্রচলিত ও বহুমুখী পাটজাত পণ্য উৎপাদন করা, নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন, দ্রুত বাজারজাত করণের গুরুত্ব ব্যবস্থা করা। পলিথিনের ন্যায় পাট দিয়ে ব্যাগ তৈরী করতে হবে।
১২.পাটপণ্য বিক্রিত অর্থ সরাসরি মিল গুলোতে জমা দিতে হবে।
১৩.দেশপ্রেম : সকল মিল ও কল কারখানায় কর্মকর্তা/কর্মচারী ও শ্রমিকদের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করার ব্যবস্থা করতে হবে। “কোম্পানী মে মাল দরিয়া মে ডাল” এটার কবর রচনা করতে হবে। পাট কলই যদি চালাইতে না পারি, তা হলে আমরা আর কি পারবো? চোর, চোট্রা দিয়ে ভাল কিছু হয় না। একজন মিল ম্যানেজার বলে ছিলেন, পাটে যদি চুরি বন্ধ হয় তাহলে এই কালো পিচের রাস্তা মিলের ভিতর তা সোনা দিয়ে রাস্তা করা যাবে। কিন্তু কি হয়েছে?
১৪.দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা/কর্মচারী/নেতৃবৃন্দের লুটপাটকারীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দিতে হবে।
১৫.একশ্রেণির অসাধু জুটমিল মালিক ফটকাবাজী ব্যবসায়ী জুট মিলের জন্য বারবার লোন নিয়ে অন্য ব্যবসায় খাটিয়ে মিল গুলোতে লোকসান দেখিয়ে মিল বন্ধ করে সরকারের নিকট হতে সুবিধা আদার করার ধান্দায় থাকে এদেরকে চিহ্নিত করে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
পাট বাংলাদেশের গর্ব। এক সময় পাট দিয়েই বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল। দেশের বৈদেশিক মূদ্রার ৮৫% শতাংশ পূরণ করেছে এ পাট। এই পাট ও পাট শিল্পের সাথে এ দেশের ৪ কোটি লোক জড়িত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। এ শিল্পকে বাঁচায় রাখতে না পারলে আমরা এমন কি পারলাম? কি আমাদের যোগ্যতা, দক্ষতা, শুধু কি চাটার ধান্ধা। কোন এক সময় জাতির কাছে জবাব দিতে হবে, জাতির যখন হুশ ফিরবে। বিদেশি ফরমুলা নয়, দেশিয় চিন্তা চেতনা দিয়ে এ শিল্পকে নিয়ে ভাবতে হবে দেশ যতদিন স্থিতিশিল, স্বাভাবিক অবস্থা, সুষ্ঠু নিয়মতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক অবস্থায় ফিরে না আসবে ততদিন জোড়া তালি দিয়ে সব কিছু চলবে। দেশ ধীরে ধীরে রসাতলে যাবে। এক সময় পাট দিয়েই সুপরিচিত ছিল এ দেশ।
পাট ও পাটশিল্প এর সমস্যা ও সমাধান নিয়ে কত বক্তৃতা বিবৃতি লেখা দিলাম তেমন কোন হয়নি, মরার সময় মুখে পানি দিলে যা হয় তাই। সময়মত পাট ক্রয়, মজুরি বেতন দেওয়া, পার্টস ক্রয়, দুর্নীতি বন্ধ হলে এ শিল্পকে বাঁচায় রাখা যাবে। পাট শিল্প ধ্বংসের বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত রুখতে হবে। দলীয় প্রভাব মুক্ত হয়ে ব্যবসায়ী ও দেশপ্রেমিক চিন্তা নিয়ে এ শিল্পকে ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে।
সৎ, দক্ষ লোক দিয়ে মিল পরিচালনা করলে-মিল বাঁচবে, শ্রমিক বাঁচবে, দেশ বাঁচবে। তাই আসুন আমরা শ্রমিক ও দেশ বাঁচাতে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে আত্মনিয়োগ করি।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন, খুলনা মহানগরী