বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা ও সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন দেশের প্রতিটি সেক্টরে শ্রমিকদের সুসংগঠিত করে নৈতিকতা সম্পন্ন যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে শ্রমিক আন্দোলনে গণভিত্তি রচনা করতে হবে।গতকাল বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ-ই কথা বলেন। ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি আ ন ম শামসুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমানের পরিচালনায় এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এসময় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা মাওলানা এ টি এম মাসুম ও আফম আব্দুস সাত্তার প্রমুখ।
সম্মেলনে প্রধান অতিথি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের পরিচালনায় ২০২১ ও ২০২২ সেশনের জন্য ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে আ ন ম শামসুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান পুনরায় নির্বাচিত হন।

প্রধান অতিথি তার বক্তব্য আরও বলেন, আমরা ইসলামী শ্রমনীতির সংগ্রামে মাঠ পর্যায়ে কল, কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে অসহায় মজলুম শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার প্রতিজ্ঞা করেছি এবং আমরা যদি এ-র মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের গণভিত্তি রচনা করতে পারি তাহলে ইনশাআল্লাহ আল্লাহর সাহায্যে আমাদের জন্য অনিবার্য। তিনি বলেন, ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং ইসলামী শ্রমনীতির সংগ্রাম এক এবং অভিন্ন সংগ্রাম। আমাদের এই সংগ্রামকে অভিন্ন লক্ষ্যে পরিচালনা করতে হবে এবং সর্বোপরি মহান আল্লাহর সাহায্যে কামনা করতে হবে।
তিনি নবনির্বাচিত দায়িত্বশীলদের উদ্দেশ্য করে বলেন, দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আখেরাতের জবাবদিহি ও অনুভূতি রেখে কাজ করতে হবে। আমাদেরকে অবশ্যই আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়ে জীবন পরিচালনা করতে হবে।তাহলেই শ্রমিক অঙ্গনে একদল নৈতিকতা সম্পন্ন যোগ্য নেতৃত্ব তৈরী করতে পারবো।
নবনির্বাচিত সভাপতি আ ন ম শামসুল ইসলাম বলেন, আমারা যদি ইসলামি শ্রমনীতি বাস্তবায়ন করতে চাই তাহলে সকল সেক্টরে শ্রমিকদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং তাদেরকে ইসলামী শ্রমনীতি বাস্তবায়নের অনিবার্যতা তুলে ধরে তাদের সমর্থন আদায় করতে হবে।আমাদেরকে শ্রমিকদের মাঝে সেবার মানসিকতা নিয়ে যেতে হবে। যেখানেই শ্রমিকরা সমস্যায় পড়বে সেখানেই শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের নেতা কর্মীদের ছুটে যেতে হবে,তাদের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রতিটি পাড়ায় মহাল্লায়,ওয়ার্ডে,ইউনিয়নে শ্রমিকদের সুসংগঠিত করে তাদের মাঝে ইসলামী শ্রমনীতির দাওয়াত পৌঁছাতে হবে এবং মজবুত ও গতিশীল সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে হলে নিজেদের মানউন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি দায়িত্বশীলদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন ফেডারেশনের প্রতিটি কর্মসূচি বাস্তবায়নে যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে।
পরে নবনির্বাচিত সভাপতি নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক সহ ৩৫ সদস্য বিশিষ্ট কার্যকরী পরিষদের সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করান। সম্মেলনে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সহ সারাদেশে বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল জেলা ও মহানগরীর এবং ট্রেড ইউনিয়নের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ডেলিগেট অংশগ্রহণ করেন। পরে সকলের সম্মতিতে ১২ দফা প্রস্তাব গৃহীত হয়।
কেন্দ্রীয় দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন-২০২০ এর গৃহীত প্রস্তাবাবলী:
১. আজকের এই সম্মেলন গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, চলমান কভিড়-১৯ করোনা পরিস্থিতিতে সারাদেশের শ্রমজীবি মানুষ চাকুরী এবং কাজ কর্ম হারিয়ে বেকার অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাদের পূর্নবাসন, চিকিৎসা, সরকারী সহায়তার উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এই সম্মেলন দাবী জানাচ্ছে যে, ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তা, অসুস্থদের যথাযথ চিকিৎসা এবং বেকার হয়ে পড়া শ্রমিকদের কর্মসংস্থানসহ আর্থিক পূর্ণবাসন করতে হবে।
২. করোনাসহ বিভিন্ন কারণে ২০২০ সালে ফেডারেশনের অনেক নেতাকর্মী এবং উপদেষ্টা ইন্তেকাল করেছেন। বিশেষ করে ফেডারেশনের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি বিশিষ্ট আইনজীবি এ্যাড.শেখ আনছার আলী, চট্টগ্রাম বন্দর ইসলামী সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং ফেডারেশনের সাবেক কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গণি, ফেডারেশনের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি বৃহত্তর খুলনা বিভাগের সাবেক সভাপতি, সাবেক কাউন্সিলর মাওলানা এ বি এম হাবিবুর রহমান, সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি বৃহত্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এবং ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ এর সহ-সভাপতি এম এ তাহের, ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় মহিলা কমিটির অন্যতম সদস্যা এবং ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সভানেত্রী আমেনা খাতুন, সিলেট বিভাগের সাবেক সহ-সভাপতি আব্দুল মতিন, বাগের
হাট জেলা সভাপতি শেখ জাকির হোসাইন, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের শ্রমিক নেতা শামসুদ্দিন জহির, মতিউর রহমান শিকদার, শাহ আলম মিয়াজী, রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার সভাপতি তাজুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা দক্ষিণ এর চৌদ্দগ্রাম উপজেলা সভাপতি জয়নাল আবেদীন, লক্ষীপুর জেলার কমলনগর উপজেলার কালকিনি ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান, বরিশাল মহানগরী কোতয়ালী থানা প্রচার সেক্রেটারী সেলিম হাওলাদার ইন্তেকাল করেছেন। আজকের এই সম্মেলন তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করছে এবং তাদের পরিবার পরিজনের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছে এবং সবরের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করছে। বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের প্রধান উপদেষ্টা মুহতারাম ডা: শফিকুর রহমান, হামিদুর রহমান আজাদ, মোবারক হোসাইন এবং ফেডারেশনের চট্টগ্রাম মহানগরী সাধারণ সম্পাদক এস এম লুৎফর রহমানসহ করোনা আক্রান্ত ভাইদের আশু রোগমুক্তির জন্য আজকের এই সম্মেলন মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করছে।
৩. আজকের এই সম্মেলন গার্মেন্টস শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরী ৮,০০০/- টাকা নির্ধারন করা হলেও অধিকাংশ গার্মেন্টস মালিক শ্রমিকদের সর্বনিন্ম মজুরী না দিয়ে বিভিন্নভাবে শ্রমিকদেরকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে এমনকি দাবি আদায়ের আন্দোলনকে দমনের নামে হয়রানি ও গ্রেফতার করে অন্যায়ভাবে শ্রমিকদেরকে চাকুরীচ্যুত করছে। এই সম্মেলন গার্মেন্টস শিল্পে বর্তমানে গৃহীত কালাকানুন টার্মিনেশন এ্যাক্ট বাতিল করে পূর্বের আইন বহাল করার জোর দাবী জানাচ্ছে এবং ১৬,০০০/- টাকা সর্বনিন্ম মজুরী নির্ধারণ করে মজুরী কমিশন ঘোষনার জোর দাবী জানাচ্ছে।
৪. আজকের এই সম্মেলন চাল-ডাল, তৈলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসার জন্য সরকারের নিকট জোর দাবী জানাচ্ছে।
৫. আজকের এই সম্মেলন বন্ধকৃত ২৫টি জুট মিলের শ্রমিক কর্মচারীদের যাবতীয় বকেয়া পাওনাদি অবিলম্বে পরিশোধ করার জোর দাবী জানাচ্ছে এবং বিএমআরই পদ্ধতিতে আধুনিকায়ন করে উক্ত ২৫টি জুট মিলসহ বন্ধকৃত সকল কল-কারখানা অবিলম্বে চালু করার জোর দাবী জানাচ্ছে।
৬. আজকের এই সম্মেলন সরকারী, বে-সরকারী ও গার্মেন্টসসহ সকল শিল্প, কল-কারখানায় শ্রম আইন অনুযায়ী মহিলাদের প্রসূতিকালীন ছুটি ও ভাতা প্রদানসহ নারী শ্রমিকদের সন্তানের জন্য শিশু যত্মাগার স্থাপনের জন্য জোর দাবি জানাচ্ছে।
৭. আজকের এই সম্মেলন হোটেল শ্রমিক ও দোকান কর্মচারীসহ মালিকানা নির্বিশেষে বিরাজমান জীবনযাত্রার ব্যয়ের নিরিখে জাতীয় ন্যূনতম মজুরী কাঠামো পূর্ননির্ধারণের ও বাস্তবায়নের জোর দাবী জানাচ্ছে এবং পরিবহন, রিক্শা-ভ্যান, নির্মাণ, কৃষি, চাতাল শ্রমিকসহ সর্বস্তরের শ্রমিকদের জন্য ট্রেড ভিত্তিক সমস্যা সমূহ চিহ্নিত করা ও সমাধানের উদ্যোগ গ্রহনের আহবান জানাচ্ছে।
৮. এই সম্মেলন আইএলও কনভেনশন মোতাবেক অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের নিয়োগপত্র প্রদান নিশ্চিত করার জোর দাবী জানাচ্ছে।
৯. এই সম্মেলন গভীর উদ্বেগের সাথে বলছে যে, পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি বন্ধ করতে না পারলে পরিবহন শ্রমিকদের দুর্দশা শেষ হবে না। তাই এই সম্মেলন পরিবহন শ্রমিকদের নিয়োগপত্র প্রদান, চাঁদাবাজি ও হয়রানি বন্ধ করার জোর দাবী জানাচ্ছে।
১০. আজকের এই সম্মেলন মনে করে যে, বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন অগ্রগতি মানে দেশের উন্নতি। তাই বাংলাদেশ রেলওয়েকে দ্রুত আধুনিকায়নের পাশাপাশি ঢাকা-লাকশাম-ঢাকা কর্ড লাইন, দোহাজারী-কক্সাবাজার ও বগুড়া, জামতইলসহ সারাদেশে রেলওয়ে সম্প্রসারণ করার জোর দাবী জানাচ্ছে।
১১. আজকের এই সম্মেলন গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, ৯২ ভাগ মুসলমানের এই দেশে কুরআন সুন্নাহের আলোকে সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা চলার কথা। অথচ বর্তমানে দেশে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সুদ-ঘুষ, হত্যা-ধর্ষন মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে। সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তথাকথিত পীর-মাজার পূজা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা নাস্তিক এবং ইসলাম বিরোধী শক্তির মদদে ভ্যাস্কর্যের নামে সারাদেশে মূর্তিপূজা আয়োজনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আজকের এই সম্মেলন অবতিবিলম্বে ভ্যাস্কর্যসহ সকল ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধের জোর দাবী জানাচ্ছে।
১২. আজকের এই সম্মেলন মনে করে যে, শ্রমজীবি মানুষের প্রকৃত সমস্যার সমাধান কুরআন, সুন্নাহর আইন প্রতিষ্ঠা ছাড়া সম্ভব নয়। তাই ইসলামী শ্রমনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষে শ্রমজীবি মানুষসহ সকল স্তরের শ্রমিক জনতাকে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের পতাকাতলে শামিল হওয়ার জোর দাবী জানাচ্ছে।