স্বাধীনতা জীবনের অন্যতম অনুসঙ্গ। মুক্ত বিহঙ্গে ডানা মেলে ওড়া হরিয়ালকে খাঁচায় বন্দি রেখে পৃথিবীর সবচেয়ে বিশাল অট্টালিকায় রাখলেও সে তার জীবনের সুখকে অনুভব করতে পারে না। বনের পোকা মাকড় আর গাছের ডালে তার জীবনের প্রকৃত স্বাধীনতা। আমরা স্বাধীন জনপদের অধিবাসী। বিজয়ের লাল পতাকা তেপ্পান্ন বসন্ত পার করেছে। সাত কোটি মানুষ এখন প্রায় বিশ কোটি; যদিও কাগজে কলমে ষোল কোটি। মানুষ বাড়ার সাথে সাথে খাদ্যের উৎপাদনও বেড়েছে। বেড়েছে শিল্প কল কারখানা, বিশাল বিশাল অট্টালিকা। পাকা রাস্তার পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। অবকাঠামো উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে। দেশের বাজেটের পরিমাণ প্রতি বছরই বেড়ে চলছে। বিলাসবহুল দ্রব্য ব্যবহারের পরিমাণ হু হু করে বাড়ছে। গ্রামে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ। মোবাইল, টেলিভিশন, কম্পিউটার অতি সহজলভ্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে। পরিবহন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। প্রবাসীদের রেমিটেন্স অর্থনীতির চাকাকে সচল করে রেখেছে। পোশাক শিল্পের কল্যাণে দরিদ্র শ্রেণির একটি অংশের কর্মসংস্থান হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্প বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের এখন সেকেন্ড পিলার। বৃটিশ আমলের ঘুট ঘুটে অন্ধকার রাস্তাগুলোতে এখন বাহারী আলোর ঝলকানি। এতো কিছুর পরও আমরা স্বাধীনতার কতটুকু ফল ভোগ করছি? সর্বত্র হতাশা, নিরানন্দ আর বেদনার প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট।
কল কারখানা আর শিল্পের উন্নতি হয়েছে বৈকি। কিন্তু জনসংখ্যার তুলনায় কর্মসংস্থান বেড়েছে কি? বেসরকারি খাতে বড়ো বড়ো কিছু শিল্প কারখানা হলেও বন্ধ হয়ে গেছে আদমজী, বাওয়ানীসহ রাষ্ট্রায়ত্ব সব পাটকল। বস্ত্র খাতেও সরকারি অনেক মিল বন্ধ হয়ে গেছে, বাকিগুলোর অবস্থা ভালো নয়। সরকারি উদ্যোগে প্রথম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ কার্যক্রম চালু হয় ১৯৮৩ সালে। এরপর ঢাকার সাভারে দ্বিতীয় ইপিজেড স্থাপন করা হয়। এখন দেশে বেপজার অধীনে নয়টি ইপিজেড রয়েছে। একইভাবে সরকারি বেসরকারি অনেকগুলো শিল্প পার্ক স্থাপিত হয়েছে। বিসিকের অধীনে জেলায় জেলায় ছোট ও মাঝারী অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে। এ সকল কারখানা দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশী মুদ্রা অর্জন করেছে। সরকার আরও একশতটি নতুন ইকোনোমিক জোন করার ঘোষণা দিয়েছে। পাটের বাজার হাতছাড়া হওয়ার পাশাপশি তৈরি পোশাক শিল্প এবং ঔষধ রপ্তানিতে সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এত কিছুর পরেও প্রশ্ন থেকে যায় জনসংখ্যার তুলনায় কতটুকু কর্মসংস্থান হয়েছে? আদমশুমারীর অনুযায়ী ১৬ কোটি মানুষের দেশে প্রায় দুই কোটি বেকার। দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকরা কাজ পাচ্ছে না। বেসরকারি খাতের বড়ো বড়ো পদে সব বিদেশী কর্মকর্তারা চেয়ার দখল করে আছে। বিদেশীরা এদেশে চাকুরি করার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড়ো অংশ চলে যাচ্ছে। অথচ এগুলো আমাদের রেমিটেন্স যোদ্ধা প্রবাসী শ্রমিক আর গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকদের কষ্টের ফসল।
শিক্ষা খাতেও চোখ ধাঁধানো উন্নতি আমাদের চোখে পড়ে। দেশে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৯টি। এর মধ্যে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় ১৩টি। শিক্ষার হারও চোখে পড়ার মতো। প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদরাসা সব কিছুই বেড়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে কিন্ডার গার্টেন একটি বৈপ্লবিক অবস্থা বলা যায়। এর বাইরে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলসহ আছে নানান ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দিনমজুর পিতার সন্তান মেডিকেল আর বুয়েটে পড়ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে শিক্ষার মান কি বেড়েছে? প্রতি বছর পাশের হার বাড়ছে। ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা পূর্বের তুলনায় কমেছে। অদম্য মেধাবীদের অভাবনীয় ফলাফল আমাদের আশা আর প্রত্যাশার মিনারকে উঁচু করে ধরে। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থা যে মানের নাগরিক তৈরি করার কথা, তা কি পারছে? শিক্ষার মানের কতটুকু উন্নতি হয়েছে, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। জীবন এবং মূল্যবোধের প্রশ্নে শিক্ষা কি আদর্শ নাগরিক তৈরি করতে পারছে? কর্মমুখী শিক্ষার হার কত? শিক্ষা সনদের পরিসংখ্যানের পাশাপাশি শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা আমাদের হতাশার তিমিরকে আরও প্রলম্বিত করে। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস নিয়মিত ব্যাপার। আগে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হতো। এখন একদলীয় এবং ফ্যাসিবাদী তাÐব গোটা জাতিকে হতাশার দিক চক্রবালে নিক্ষেপ করছে। সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা অধ্যয়ন করে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিকেল স্কুলগুলোতে। এখানে আমরা কি দেখছি? বুয়েটে আবরার ফাহাদকে হত্যার বীভৎস গোটা জাতিকে আতঙ্কিত করে। একই কায়দায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে চারজন ছাত্রকে সারা রাত নির্যাতন করা হয়েছে। নির্যাতকরা বলছে তারা নাকি কোন ছাত্র সংগঠনের সাথে সম্পর্কিত। এ জন্য তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনকে এই দায়িত্ব কে দিয়েছে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রদের জীবন এবং স্বাভাবিক শিক্ষা জীবনের নিরাপত্তা চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সরকারি হাসপাতাল যা ছিলো তা বেড়েছে। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ-সব কিছুই বৃদ্ধি পেয়েছে। বেসরকারি খাতেও হাসপাতালের সংখ্যা কম নয়। ডাক্তারের সংখ্যা বেড়েছে। স্বাস্থ্য খাতে কিছু উন্নতি তো অবশ্যই হয়েছে। বেসরকারি খাতে অসংখ্য হাসপাতাল হয়েছে। সরকারি বাজেট এবং বরাদ্দে টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন নতুন নার্সিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ডাক্তারদের গ্রামে গিয়ে সেবা দেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কথা শোনা যাচ্ছে। সেবার মান কতটুকু বেড়েছে? এখনো বিনা চিকিৎসায় মানুষ মারা যাচ্ছে। করোনাকালীন সময়ে আমরা দেখেছি স্বাস্থ্য সেবার বেহাল দশার অবস্থা। বলা হয়েছিলো আমাদের সব আছে। পরবর্তীতে মানুষ অক্সিজেনের অভাবে ধুকে ধুকে মরেছে। সরকারি হাসপাতালগুলোর সেবার মান এবং সেবা পাবার অধিকার খুবই শোচনীয়। বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত ডাক্তারগণ সুযোগ পেলে রোগীদের গলাকাটা ফি আদায় করে। কিছু ভালো ডাক্তার অবশ্যই আছেন, তবে তাদের সংখ্যা অতি সামান্য। সরকারি বেসরকারি খাতে এ্যাম্বুলেন্স সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু কতজন দরিদ্র মানুষ অ্যাম্বুলেন্স সেবা পাচ্ছে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। আমরা শুধু উন্নয়নের ডুগডুগ শুনতে পাই কিন্তু দরিদ্র অসহায় নিরন্ন শ্রমজীবী মানুষের চিকিৎসা সেবা তাদের নাগালে আসেনি। অথচ স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং যুদ্ধের ময়দানে এই শ্রমিক শ্রেণি তাদের জীবন দিয়ে লড়াই করেছে।
পরিবহন খাতের প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে। সড়কে গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখনো নদী পথে যাতায়াত সহজতর। অনুমোদিত অথবা অননুমোদিত ব্যাটারি চালিত ইজিবাইকের কারণে গ্রামীণ জনগণের যাতায়াত সহজতর হয়েছে। পাঠাও, উবারসহ বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সুবাদে অনেক ক্ষেত্রে যাতায়াত সহজতর হয়েছে। অনলাইনে ট্রেন এবং বাসের টিকেট কাটার ব্যবস্থা অবশ্যই প্রশংসা পেতে পারতো যদি তা জনগণের নাগালের মধ্যে হতো। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই কালো বাজারে টিকেট চলে যাচ্ছে। বড়ো বড়ো শহরের কর্মজীবী নারীদের জন্য পৃথক বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জনসংখ্যার তুলনায় তা কতুটুকু? সড়কের পরিধি এবং যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার পরও বড়ো শহরগুলোতে মানুষের যাতায়াতের কষ্ট এবং ভোগান্তি মারাত্মক। যানজটের কারণে মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা এক ভয়াবহ ব্যাধির আকারে স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। কঠিন এবং কঠোর আইন করা হয়েছে কিন্তু দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না। বছরের এমন কোনো দিন নেই, যেদিন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে না। যাতায়াত এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্গতি আমাদের উন্নয়নের ¯েøাগানকে প্রতিনিয়ত বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে।
প্রাকৃতিক পরিবেশ স্বাধীনতা পরবর্তীকালে উন্নতির চেয়ে অবনতির দিকে ধাবিত হয়েছে। বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। বসবাসের অনুপযোগী শহরের মধ্যেও ঢাকা শহর তালিকার শীর্ষে। বিশ্ব ধরিত্রি সম্মেলনে আমাদের কর্তাব্যক্তিরা অনেক লম্বা বক্তব্য দিয়ে এসেছেন। জাতিসংঘ অধিবেশনে আমাদের সরকার প্রধানের পক্ষ হতে পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষায় অনেক চমৎকার প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। সেই বক্তব্যের বাস্তব রূপায়ণ আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। বন উজাড় হচ্ছে। কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। নদী দখল হয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য দিন দিন নষ্ট হচ্ছে। প্রতিনিয়ত কল কারখানা বৃদ্ধির সাথে সাথে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসারণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কল কারখানার বর্জ্য প্রতিনিয়ত নদী খাল বিলের পানি নষ্ট করছে। জৈব অজৈব আবর্জনা রিসাইক্লিনিংয়ের অনেক প্রকল্প এবং পরিকল্পনার কথা আমরা শুনতে পাই কিন্তু ঢাকা শহরের প্রতিটি রাস্তার মোড়ে এমনকি রাস্তা দখল করে ময়লার ভাগার তৈরি করে রাখা হয়েছে।
আবসান খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। নতুন নতুন উপশহর তৈরি হয়েছে। বস্তিবাসীদের জন্য ফ্লাটের কথা শোনা যাচ্ছে। নতুন নতুন ইমারত তৈরি হয়েছে। বিলাশ বহুল একটি একটি এ্যাপার্টমেন্ট একটি গ্রামের সম পরিমাণ মানুষের বসবাসের স্থান করে দিয়েছে। গ্রামেও বহুতল ভবন তৈরি হচ্ছে। দরিদ্র মানুষকে সরকারি উদ্যোগে ঘর করে দেওয়ার সংবাদ আমরা প্রতিনিয়ত মিডিয়ার সুবাদে জানতে পারছি। যদিও এতে অনেক ক্ষেত্রে দরিদ্রের চেয়ে সামর্থ্যবান প্রভাবশালীরাই জায়গা পাচ্ছে। বাস্তব চিত্র আরও বেশি করুণ। গুলশানের অভিজাত এলাকার পাশেই বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করছে হাজারো বনি আদম। রাস্তার ধারে অসহায় ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা শহরাঞ্চলে বেশি। নিম্ম আয়ের শ্রমিকরা অল্প ভাড়ায় যে পরিবেশে বসবাস করে তা সত্যিই বেদনার। ঢাকা শহরের রিকশা এবং ভ্যানের গ্যারেজগুলোতে শ্রমজীবী মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা চরম অমানবিক। অর্থনীতির সেকেন্ড পিলার গার্মেন্টস সেক্টরের শ্রমিকরা যে অল্প বেতনে চাকুরি করে বাসা ভাড়া দেওয়ার পর তাদের হাতে তেমন অবশিষ্ট আর কিছু থাকে না। যাদের বসবাসের এমন করুণ পরিণতি তারা স্বাধীনতার স্বপ্নসাধ কতুটুক ভোগ করতে পারছে তা মোটা দাগের প্রশ্ন।
ব্যবসায় বাণিজ্যের পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশী অনেক ব্যক্তি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে। অসংখ্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এ দেশে বিনিয়োগ করেছে, যদিও এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি দিকই আছে। আমাদের আমদানি এবং রপ্তানি বাণিজ্যের পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা কতটুকু নিরাপদ তা আজ প্রশ্ন সাপেক্ষ। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে কতটুকু স্বাধীনভাবে তারা ব্যবসায় করতে পারছে। ক্ষমতাসীন মহলের চাঁদাবাজি আর আধিপত্য ব্যবসায় বাণিজ্যের এক চরম হুমকি। একদিকে ক্ষমতার ছায়ায় থেকে বড়ো বড়ো শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা প্রসারের নামে সকল সেক্টরকে নিজেদের করায়ত্বে নিয়ে নিচ্ছে অপরদিকে পুঁজিপতিদের দৌড়াত্ম ছোট ছোট ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসাকে গ্রাস করছে। কৃষিপণ্যগুলোও বহুজাতিক কোম্পানির পেটের মধ্যে চলে গেছে। পুঁজিবাদের একচেটিয়া আধিপত্য শুধুমাত্র বড়ো পুঁজির মালিকদের সম্পদ বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে আর ছোট ব্যবসায়ীরা পুঁজিহীন হয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার স্লোগান সাম্য এখানে শুধু স্লোগান হিসেবে থাকছে।
স্বাধীনতা পূর্বকালের চেয়ে দেশে মিডিয়ার সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ। এক সময়ে একটিমাত্র টেলিভেশন চ্যানেল ছিলো, যার সংখ্যা এখন ২৫ এর অধিক। জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিকের সংখ্যা সব মিলিয়ে কয়েকশত। আছে স্থানীয় পর্যায়ে অসংখ্য দৈনিক সাপ্তাহিক পত্রিকা। সাহিত্য পত্রিকা, কিশোর পত্রিকা, বিজ্ঞান পত্রিকা, গবেষণা জার্নালসহ অসংখ্যা পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। ইন্টারনেট দুনিয়ায় প্রবেশ করার পর অনলাইন পোর্টালগুলোর সংখ্যা দিন দিন শুধু বাড়ছে। প্রশ্ন হচ্ছে মিডিয়ায় বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পরিবেশ কতটুকু? এম্বেডেডেড জার্নালিজমের নতুন নাম দেওয়া হয়েছে শিকারি সাংবাদিকতা। মিডিয়া এখন পুঁজির মালিক আর ক্ষমতাসীনদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কখনো স্বপ্রণোদিত, কখনো ভয়ে, কখনো অসত্য তথ্যের শিকার হয়ে মিডিয়া সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রকাশ করছে। পুঁজির মালিক কিংবা সরকার যাদের প্রভাব আছে তাদের অনেক দুষ্কর্ম মিডিয়া বেমালুম চেপে যায় আবার একজন দুর্বল ভালো মানুষকে অপরাধী হিসেবে উপস্থিত করা হচ্ছে। মিডিয়ায় পুঁজি এবং রাজনীতির আগ্রাসন এর শ্রেণিচরিত্র পুরোপুরি পাল্টে ফেলেছে। স্বাধীনতার প্রত্যাশা এটা ছিলো না, কিন্তু আমরা তাই ভোগ করছি।
জাতীয় অর্থনীতিতে পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তান আমলের বাইশ পরিবার এখন হাজার পরিবারে রূপ নিয়েছে। আগে কোটি টাকার মালিক কতজন হিসেব করা হতো, এখন হাজার কোটি টাকার মালিক আছে সহ¯্রাধিক। এক সমীক্ষামতে দেশের পুঁজির ৮৫% শতাংশ মাত্র উনত্রিশ জনের কাছে। পাকিস্তান আমলের সেই বুর্জোয়া সিস্টেমের কতটুকু উন্নতি হয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে। আগে ধনীরা তাদের সম্পদ দেশেই বিনিয়োগ করতো এখন দরিদ্র মানুষের টাকা লুট করে বিদেশে সম্পদের পাহাড় তৈরি করা হচ্ছে। অধিকাংশ বড়ো ব্যবসায়ীদের মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর আর কানাডায় ব্যবসা এবং প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য বিনিয়োগ রয়েছে। দেশে ব্যাংকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে ডিজিটাল ব্যাংক ডাকাতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাধীনতার স্বপ্নসাধ এবং চেতনা এগুলো ছিলো না। তিক্ত সত্য হচ্ছে, যারা স্বাধীনতার চেতনার কথা বলছে, তারাই এ কাজে এগিয়ে আছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা ভূমি আর লাল সবুজের পতাকা পেয়েছি। কিন্তু আজও আমাদের সীমান্ত নিরাপদ হয়নি। ফেলানীরা বার বার কাঁটাতারে ঝুলে থাকে। নিরীহ কৃষক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাবার পর তাকে গরু ব্যবসায়ী কিংবা চোরাচালানী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মায়ানমার আমাদের সীমান্তে মর্টার সেল বিদ্ধ করে। সীমান্তের ওপার হতে প্রতিনিয়ত মাদক আসে, যা আমরা প্রতিরোধ করতে পারি না। আমাদের সমুদ্র কতটুকু অরক্ষিত তা প্রশ্নসাপেক্ষ। চীন, রাশিয়া আর পরাশক্তির লাভ আর লোভের রশি টানাটানি চলে আমাদেরকে নিয়ে। মাঝে মাঝে আমরা ভুলেই যাই আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। কেউ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কেউ ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য পরাশক্তি আর আধিপত্যবাদী শক্তিকে ভূমির মালিকানা দেওয়ার অলিখিত দাসখত প্রদান করে।
জীবনের নিরাপত্তা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। গুম, খুন, হত্যা, রাহাজানির পরিমাণ দিনে দিনে বেড়েছে বৈ কমেনি। যখন তখন মানুষ নিখোঁজ হয়ে যায়। গভীর রাতে কারো বাড়ির দরোজায় পোশাকধারী লোকের পরিচয়ে কেউ কড়া নাড়লে তারা জীবন নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। কে নিহত হয়েছে আর কে আত্মহত্যা করেছে বোঝার কোনো উপায় নেই। ফারদিন আর আবরাররা তাই জানতেও পারে না, কেন তাদের হত্যা করা হলো। আত্মহত্যার পরিমাণও দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। ইভটিজিং আর পাশবিকতার শিকার হয়ে অসংখ্য কিশোরী তরুণী আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। একটি সমাজ এবং পরিবেশে স্বাভাবিক জীবনযাপনের গ্যারান্টি না থাকলে সেখানে আত্মহত্যার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সন্তানদের আহার যোগার করতে না পেরে সন্তানদের নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেয় এই স্বাধীন দেশের নাগরিক কোনো এক মা। ঋনের বোঝা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে দরিদ্র কৃষক। দরিদ্র শ্রমিক পিতার সন্তান মেডিকেলে পড়ার পাশাপাশি টিউশন করে সংসার চালায়-এমন মেধাবীকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো হয় সারা রাত নির্যাতন। এরই নাম কি স্বাধীন বাংলাদেশ?
চিন্তা, বিশ্বাস ও কাজের স্বাধীনতা, মনের প্রশান্তি ও নির্মল পরিবেশ বেঁচে থাকার জন্য সবার আগে প্রয়োজন। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে প্রতিটি নাগরিকের এটি আশা, প্রত্যাশা এবং চাহিদার বিষয়। মতাদর্শিক রাজনীতির বীভৎস শিকার এ দেশের প্রতিটি নাগরিক। তুমি আমার দলের লোক তোমার চাকুরি পাবার স্বাধীনতা আছে, কথা বলার, সভা সমাবেশ করার স্বাধীনতা আছে। তুমি আমার দলের লোক নও তোমার মত প্রকাশের, সভা সমাবেশ করার স্বাধীনতা নেই, এমনকি ঘরের মধ্যে চার-পাঁচজন একত্রে বসে কথা বলার অধিকার নেই। তুমি নাশকতাকারী। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে এটা প্রত্যাশার বিষয় ছিলো না।
নৈতিক উৎকর্ষতার পরিবর্তে অনৈতিকতার জয় জয়কার সর্বত্র। স্বৈরাচার ও অন্যায় অনাচারের মূলোৎপাটন ছিলো স্বাধীনতার মূল চেতনা। দুঃশাসন দূর করে একটি সুন্দর দেশ গড়ার স্লোগান ছিলো, কিন্তু আজ প্রতিনিয়ত আমরা দুঃশাসনের মুখোমুখি। সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা তিরোহিত। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও সমাজ সংগঠন বিদূরিত হয়ে দুর্নীতি ডালাপালা বিস্তার করেছে বহুদূর। স্বাধীন ইনসাফভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা কথা আর বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ন্যায়ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা ওপর মহলের নির্দেশের ঘণ্টাধ্বনির আওয়াজের মধ্যে বন্দি। সহযোগিতা ও সহমর্মিতামূলক কল্যাণমুখী ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সর্বাগ্রে জরুরি। রাজনৈতিক সংঘাত, সহিংসতা, জুলুম স্বাধীন দেশের স্বকীয়তার সাথে বেমানান। নিরন্ন অসহায় শ্রমিক শ্রেণি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। তাদের স্বপ্ন ছিলো একটি স্বাধীন ভূমির মালিক হিসেবে জীবনের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে কোনো কলোনিয়াল শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বসবাস করবে না। জীবনের প্রকৃত স্বাদ পেতে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা দরকার তা তারা ভোগ করবে। শ্রমিকের অধিকার কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে? এক বাক্যে বলা যায়, না তা নিশ্চিত হয়নি। কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই, ন্যূনতম মজুরি না দেওয়া, প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক নির্যাতন শ্রমিক শ্রেণির জীবনের সাথে মিশে গেছে। স্বাধীনতার প্রকৃত স্বপ্নসাধ পূরণে এ সকল সমস্যা দূর করতে হবে। নচেৎ, স্বাধীনতার প্রকৃত তাৎপর্য বক্তব্য আর স্লোগানের মাঝেই লুকায়িত থাকবে।
একটি কল্যাণমুখি, ন্যায়বিচারপূর্ণ, আদর্শ ও নৈতিকতাসমৃদ্ধ সমাজই কেবল একটি জনপদের নাগরিকদের স্বাধীনতার প্রকৃত মর্যাদা উপহার দিতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন কৃষক, শ্রমিক, মুটে মজুর, ছাত্র-ছাত্রী, পুরুষ মহিলা সকলের অধিকারের কথা সে ব্যবস্থাপনার কাছে ফিরে যাওয়া। যেখানে গোষ্ঠী সংঘাত, রাজনৈতিক শত্রুতা এবং স্বার্থের দ্বন্দ্বকে উপজীব্য করে মানুষের উপর জুলুম করা হবে না। মানুষের মৌলিক ও মানবিক অধিকারগুলো আজ ভূলুণ্ঠিত। মানুষের অধিকার হরণ করে, গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে, বাক স্বাধীনতাকে স্তব্ধ করে দিয়ে স্বাধীনতার চেতনা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এ দেশের প্রতিটি মানুষের আঙিনায় স্বাধীনতার নব প্রভাতের আলো বিকীরণ করুক। স্বাধীনতার সুবাস বিকীরণ করুক গোলাপ, জবা জুই চামেলীরা-এ প্রত্যাশাই করছি।
লেখক: প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন।