ইসলামী জীবনব্যবস্থা পাঁচটি মৌলিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। সিয়াম তথা রোজা পাঁচটি মৌলিক ভিত্তির অন্যতম। সিয়াম প্রতিটি মুমিনকে বিশেষ সাওয়াব অর্জনের সুযোগ করে দেয়। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মুমিনের উপর আরোপিত ইবাদাতের মধ্যে সিয়াম অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সিয়াম পালনের দুটি বিধান রয়েছে। এক-পবিত্র রমাদান মাসে পুরো একমাস সিয়ম পালন করা। যা প্রতিটি মুমিনের জন্য ফরজ। দুই-বছরের অন্যান্য সময়ে সিয়াম পালন করা। যা নফল হিসেবে গণ্য হয়। তবে ফরজ হোক কিংবা নফল হোক উভয় ক্ষেত্রেই ব্যক্তির তাকওয়া বিকশিত হয় সিয়ামের মাধ্যমে। আর তাকওয়াসম্পন্ন মুমিন ব্যক্তিই আল্লাহ তায়ালার নিকট অধিক মর্যাদার অধিকারী। ফলে মুমিন-সিয়াম-তাকওয়া শরীয়াতের মৌলিক এ তিনটি বিষয় একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
সিয়াম কীভাবে তাকওয়ার বিকাশ ঘটায়:
সিয়াম/সাওম আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো বিরত থাকা। যে কোন বিরত থাকাকেই সাওম বলা হয় না। শরীয়াতের পরিভাষায়, বিশুদ্ধ নিয়তসহ সুবহে সাদিকের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাবার, পানীয় ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকাকে সাওম বলা হয়। এ বিরত থাকাকে সরলভাবে সাওম হিসেবে অভিহিত করা হলেও এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আরও ব্যাপক ও গভীর। যদি কোন ব্যক্তি খাবার, পানীয় বর্জন করে থাকে অথচ মিথ্যা, প্রতারণার কাজ ছাড়তে পারে না; তাহলে তার এ সিয়ামের কোন ফায়দা নেই। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই’ (বুখারী: ১৯০৩, ই.ফা)। এ হাদিসের মাধ্যমেই অনুমিত হয় সিয়াম মুমিন ব্যক্তির মাঝে তাকওয়ার বিকাশ ঘটাতে কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে!
আল্লাহ তায়ালা মুমিন বান্দার উপর রমাদান মাসে সিয়াম পালন করাকে ফরজ তথা আবশ্যক ঘোষণা করেছেন। তাকওয়া অর্জনের বিষয়কে সে বিধানের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনি ভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল, আশা করা যায় তোমরা তাকওয়া অর্জন করবে।’ (সুরা বাকারা: ১৮৩)
তাকওয়া ইসলামী শরীয়াতের একটা অনবদ্য গুণ ও বিশেষ পরিভাষা। এ ভিত্তির উপরই দাঁড়িয়ে আছে ইসলামী নৈতিকতার অমূল্য প্রাসাদ। তাকওয়া শব্দের শাব্দিক অর্থ আত্মরক্ষা করা, বেঁচে থাকা। কিন্তু পরিভাষায়, মহান আল্লাহর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার প্রতি অগাধ বিশ্বাস রেখে তাঁর নির্দেশিত কাজ পালন করা, তাঁর নিষিদ্ধ বিষয় থেকে আত্মরক্ষা করা, এমনকি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অপরাধকেও জবাবদিহির অনূভূতি নিয়ে বর্জন করা। পৃথিবীর অগণিত চক্ষুকে ফাঁকি দিয়ে অন্যায় অপরাধ করে সাময়িকভাবে পার পেয়ে গেলেও সূক্ষ্মদর্শী আল্লাহর দৃষ্টি থেকে মুক্তি পাওয়া কস্মিনকালেও সম্ভব নয়; অন্তরের এমন ভীতিই তাকওয়ার মূল কথা।
তাকওয়া বিষয়টি বাহ্যিক কোন ব্যাপার নয় বরং নিতান্তই এটা একটা অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। রাসুল (সা.) এর অমীয় বাণী আমাদেরকে সে দিকেই ইঙ্গিত করে। হাদিসে এসেছে, তাকওয়া এখানে, তাকওয়া এখানে-এ কথা বলে তিনি তিন বার তাঁর বক্ষের দিকে ইংগিত করেছেন।
তাকওয়া মামুলী ব্যাপার নয় বরং সেটা খুবই নাজুক ব্যাপার। একবার হযরত ওমর (রা.) উবাই বিন কাবকে তাকওয়ার ব্যাখ্যা দিতে অনুরোধ করেছিলেন। উত্তরে তিনি বলেছেন, আপনি কখনও কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করেছেন? ওমর (রা.) হ্যাঁ বলায়, তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, আপনি কীভাবে সে রাস্তা অতিক্রম করেছেন? ওমর (রা.) বলেন, আমি অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করে অতি দ্রুত অতিক্রম করেছিলাম; যাতে কাঁটা আমার কাপড়ে কোনভাবেই না বিঁধে। উবাই (রা.) বলেন, এটাই তাকওয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
জীবন চলার পথে চতুর্দিক থেকে জাহিলিয়াতের অশ্লীল কার্যাবলী মনস্তাত্ত্বিক আঘাত হানতে পারে। আর এ আঘাতকে পরাজিত করে নিঃশঙ্ক চিত্তে সামনে এগিয়ে যেতে পারলেই তাকওয়ার যথার্থতা ফুটে ওঠবে। তার জন্য প্রয়োজন একেবারে নগন্য গুনাহ থেকেও বেঁচে থাকা। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হে আয়েশা! তোমার নিজেকে একেবারে তুচ্ছ অপরাধ থেকেও বিরত রাখ, কেননা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সেটারও হিসাব চাওয়া হবে।’ (ইবনে মাজাহ: ৪২৪৩)
বাস্তবিক অর্থে, তাকওয়ার বৈশিষ্ট্যে মুমিন নিজেকে সুসজ্জিত করতে সিয়াম খুবই চমৎকার ও কার্যকরী পন্থা। সিয়াম নামীয় ইবাদাতের পদ্ধতিই এমন, যা তাকওয়ার বিকাশ ঘটাতে যথেষ্ট উপযোগী। আল্লাহ তায়ালার প্রতি একান্ত শ্রদ্ধা, দায়িত্ববোধ, সাওয়াবের প্রত্যাশা ও জবাবদিহির অনূভূতি ছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে পানাহার থেকে বিরত থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। প্রকৃত সিয়াম পালনকারী ব্যক্তি লোক চক্ষুর অন্তরালে, গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপদাহ সত্ত্বেও, সূর্যাস্তের এক মিনিট পূর্বেও এক ঢোক পানি পান করতে রাজি হবে না। কিন্তু কেন? কে তাকে এভাবে এত কষ্ট করতে অনুপ্রাণিত করল? প্রচণ্ড ক্ষুধা ও পিপাসা সত্ত্বেও কার ভয়ে সে এত ত্যাগ স্বীকার করতে সন্তুষ্ট হলো? তা শুধুই আল্লাহর ভয়। আর সেটাই হলো তাকওয়া।
সিয়াম যেভাবে তাকওয়ার বিকাশ ঘটায়:
১। অদৃশ্যের বিশ্বাসের মাধ্যমে-সিয়াম নেহায়েতই একটা আধ্মাতিক বিষয়: অন্যান্য ইবাদাত তথা সালাত, যাকাত, হজ, দান সদকা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ন্যূনতম লৌককতার আশঙ্কা থাকলেও সিয়াম সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। যেখানে দুনিয়াবী নগদ স্বার্থ হাসিল বা খ্যাতির কোন সুযোগ নেই। প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহ তায়ালার অদৃশ্য সত্ত্বার প্রতি প্রচণ্ড বিশ্বাস, জান্নাতে যাওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা, জাহান্নাম থেকে বাঁচার ভীতিকর অনূভূতি ছাড়া সিয়াম পালন করা প্রায় অসম্ভব। আর এতেই একজন মুমিন তার তাকওয়াকে শাণিত করার চরম প্রশিক্ষণ লাভ করে থাকে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন থেকে হেদায়াত লাভে আগ্রহী ব্যক্তির জন্য তাকওয়া তথা মুত্তাকি হওয়ার শর্তারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, হুদাল লিল মুত্তাকিন। আর সে সকল মুত্তাকির সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো-তারা অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস করে। প্রকান্তরে সিয়াম পালন অদৃশ্যের বিশ্বাসকে পোক্ত করে মুমিন ব্যক্তির তাকওয়ার বিকাশেই ভূমিকা রাখে।
২। কুরআনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির মাধ্যম: সিয়ামের সাথে কুরআনের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সিয়ামের মাস রমাদান, আর কুরআন নাজিলের মাসও রমাদান। রমাদানের রাতে তারাবীহ, কিয়ামুল লাইল, তাহাজ্জুদ ইত্যাদির মাধ্যমে সিয়াম পালনকারী ব্যক্তি কুরআনের সাথে মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সিয়াম ও কুরআন কেয়ামতের দিন বান্দার পক্ষে সুপারিশ করবে, আল্লাহ তায়ালা বান্দার পক্ষে সিয়াম ও কুরআনের এ সুপারিশ গ্রহণ করবেন’ (মুসনাদে আহমাদ)। বস্তুত কুরআনের সাথে এ জাতীয় সম্পর্ক উন্নতির মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তির তাকওয়া উত্তরোত্তর বিকশিত হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আসলে এটি (কুরআন) মুত্তাকিদের জন্য নসিহত।’ (সুরা আল হাক্কাহ: ৪৮)
৩। ক্ষুধার্ত মানুষের কষ্ট অনুধাবন: সিয়াম পালনকারী ব্যক্তি খাবার পানির সংকটে পড়ে এমন ইবাদাত করে ব্যাপারটা তা নয়; বরং আল্লাহ তায়ালার প্রেমে মশগুল হয়ে তাঁর সান্নিধ্য লাভের প্রত্যাশায় তাঁর হুকুম পালন করে। এতে দীর্ঘ সময় ধরে পিপাসার কৃত্রিম কষ্ট ভোগ করতে হয়। সমাজের যে সকল অভাবী মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হয়, সিয়াম পালনকারী ব্যক্তি সে সকল মানুষের ক্ষুধার কিঞ্চিত যাতনা উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়। ফলে মুমিন ব্যক্তির হৃদয় হু হু করে কেঁদে ওঠে। অসহায় মানুষের প্রতি তার তীব্র দায়িত্ববোধ জেগে ওঠে। এ দায়িত্ববোধই তার তাকওয়াকে বিকশিত করে। কারণ আল্লাহ তায়ালার নিকট পূর্ণ জবাবদিহির অনূভূতি ও তাকওয়া ব্যতীত, কোন ব্যক্তি তার কষ্টার্জিত সম্পদ অন্যের জন্য খরচ করার প্রকৃত প্রেরণা পেতে পারে না। তাই কেন যেন সিয়াম-ই ব্যক্তির তাকওয়া বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর মুত্তাকি ও জান্নাতের নেয়ামতের যোগ্য বিশেষ বান্দাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘আর তারা আল্লাহর মহব্বতে মিসকিন, এতিম এবং বন্দিকে খাবার দান করে, এবং তাদেরকে বলে আমরা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই তোমাদের খাবার দিচ্ছি। আমরা তোমাদের কাছে এর কোন প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা পেতে চাই না।’ (সুরা দাহর: ৮-৯)
৪। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ের সচেতনতার মাধ্যমে: সিয়াম পালনকারী মুমিন ব্যক্তিকে অত্যন্ত সূক্ষ্ম বিষয়েও সচেতন হতে হয়, যা তাকে উত্তরোত্তর বড়ো বিষয়গুলোতে আরও অধিক মাত্রায় সতর্ক হতে প্রেরণা যোগায়। যেমন একজন সিয়াম পালনকারী ব্যক্তি অজু করার সময় খুব সতর্ক থাকে, যাতে এক ফোঁটা বা অর্ধ ফোঁটা পানিও তার গলায় না নামে, তাকে সচেতন থাকতে হয় যাতে এক কণা খাবারও তার পেটে না চলে যায়, সারাদিনের প্রচণ্ড ক্ষুধা ও পিপাসা সত্ত্বেও তাকে খুব সচেতন থাকতে হয় যাতে সূর্য ডোবার এক মিনিট পূর্বেও তার সাওম না ভেঙে যায়। সুবহানাল্লাহ! কল্পনা করা যায়! তাকওয়ার কত চমৎকার প্রশিক্ষণ, উন্নত চরিত্র তৈরির কত বিজ্ঞানসম্মত আয়োজন! এক মিনিট (তথা সূর্যাস্তের পর) পর যা বৈধ তাই সাময়িকভাবে অবৈধ! একজন সিয়াম পালনকারী যখন সাময়িক নিষিদ্ধ বিষয়ে এত সিরিয়াস হতে পারে, সে কি কখনও চূড়ান্ত নিষিদ্ধ বিষয়ে তথা চুরি, ডাকাতি, সুদ, ঘুষ, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ, ওজনে কম দেওয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া ইত্যাদি কর্মে লিপ্ত হতে পারে? প্রকৃত সিয়াম পালনকারীর পক্ষে এমন গর্হিত কাজ প্রায় অসম্ভব। আর এটাই বিকশিত তাকওয়ার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত।
৫। আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাকওয়ার বিকাশ: মুত্তাকি ব্যক্তি কখনও অন্যের ইজ্জত ও সম্পদ হরণ করতে পারে না। রাসুল (সা.) বলেছেন, এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার ভাইয়ের উপর জুলম করবে না, তার ইজ্জত হরণ করবে না; আর এটাই তাকওয়ার দাবি। প্রকৃতপক্ষে সিয়াম পালন একজন মুমিনকে তার নিজের রাগ দমন করে অপরের প্রতি সহনশীল হতে প্রেরণা যোগায়। আর এটাও তাকওয়া বিকশিত হওয়ার অন্যতম একটা উপায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সিয়াম হলো ঢাল স্বরূপ। সুতরাং অশ্লীলতা করবে না এবং মূর্খের মত কাজ করবে না। যদি কেউ তার সাথে ঝগড়া করতে চায়, তাকে গালি দেয়, তবে সে যেন বলে, আমি একজন রোজাদার ব্যক্তি।’ (বুখারী: ১৮৯৪)
সাওম পালন এমন এক তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদাত যা মুমিন বান্দাকে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির পথে এগিয়ে দেয়। মুমিনের প্রতি আল্লাহ তায়ালার অতীব প্রত্যাশিত বৈশিষ্ট্য হলো, মুমিন তাকওয়ার রঙে নিজেকে রাঙাবে; আর সিয়াম পালন সে রঙে রাঙাতেই প্রতি বছর ফরজরূপে ফিরে আসে মুমিনের মাঝে। নফল সিয়াম তো সারা বছরই মুমিনকে আল্লাহর জন্য ত্যাগ স্বীকারে অনুপ্রাণিত করে। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সিয়ামের যথাযথ হক আদায়ের মাধ্যমে তাকওয়া বিকশিত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: ইসলামী চিন্তাবিদ