বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেছেন, আমাদের সমাজে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার ও সম্মান থেকে বঞ্চিত। তাদেরকে পদে পদে অবহেলা করা হয়। আমাদের সমাজ পঁচে গেছে। এটি আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য। আমার বিশ্বাস এই সমাজে যদি শ্রমিকদের অবহেলা না করে তাদের মান মর্যাদা বাড়িয়ে দেওয়া হয় তাহলে এই সমাজে আল্লাহর রহমত নাজিল হবে। শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে কোন বিভেদ নেই। ইসলামী শ্রমনীতির আলোকে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের মাঝে ইনসাফের ভিত্তিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে শ্রমিক মালিকের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও মালিকদের উদ্যোগ নিতে হবে। শ্রমিকদের প্রতি যেন কোন অন্যায় না করা হয়। তাহলে শ্রমিকরা তাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে মালিকের উন্নতির জন্য এগিয়ে আসবে।
তিনি আজ বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কর্তৃক ভার্চুয়ালি আয়োজিত “জেলা ও মহানগরী সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক সম্মেলন-২০২২” এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপরিউক্ত কথা বলেন। ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক হারুনুর রশিদ খানের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আতিকুর রহমানের সঞ্চালনায় এই সময় প্রোগ্রামে যুক্ত ছিলেন ছিলেন ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি গোলাম রব্বানী, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের খান, শফিকুল আলম, লস্কর মুহাম্মদ তসলিম, কবির আহমেদ, মুজিবুর রহমান ভূইয়া, মনসুর রহমানসহ ফেডারেশনের সকল জেলা ও মহানগরীর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকবৃন্দ।
অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, রাসূল (সা.) শ্রমজীবী মানুষদের কে অনেক ভালোবাসতেন। রাসূল (সা.) বলেছেন “তোমরা যা খাবে, শ্রমিককে তাই খেতে দিবে। তোমরা যা পড়বে, শ্রমিককে তাই পড়তে দিবে।” হযরত আবু যার (রা.) যে কাপড় দিয়ে নিজের পোশাক বানাতেন, একই কাপড় দিয়ে তিনি তার শ্রমিকের জন্য পোশাক বানিয়ে দিতেন। আমাদের শিশু শ্রম নিষিদ্ধ হলেও অসংখ্য শিশু শিশু শ্রমে জড়িয়ে গেছে। অনেক শিশু শ্রমিকরা এতিম। আমাদেরকে এই সকল শিশুদেরকে শিশু শ্রম থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের পড়ালেখার ব্যবস্থা করতে হবে। আজকের শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদেরকে কাজ করতে হবে। শিশু শ্রমিকের পাশাপাশি অনেক মহিলা শ্রমিক আছে। পিতা মাতা মারা যাওয়ার কারণে এই সকল মহিলারা শ্রমে জড়িয়ে গেছে। এই সমাজ সুন্দর করতে হলে আমাদেরকে তাদের প্রতিও যত্মবান হতে হবে।
তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, জোর করে ক্ষমতা দখল করে রাখলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয় না। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়। রাসূল (সা.) বলেছেন, সত্যিকার অর্থে সেই উত্তম সরকার, যে সরকার জনগণকে ভালোবাসে এবং জনগণও সরকারকে ভালোবাসে। দেশে আজ সাংবিধানিক অধিকার নেই। গণতান্ত্রিক অধিকার নেই। সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার অধিকার নেই। আজ মানুষের কথা বলার অধিকার রুদ্ধ করে দিয়েছে। দেশে আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে। সত্যিকারভাবে দেশে যদি আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার থাকতো তাহলে শ্রমিকরা তাদের অধিকার ফিরে পেতো।
অধ্যাপক মুজিব বলেন, আজকে মানুষের পেটে খাবার নেই। বিশেষ করে করোনা পরবর্তী সময়ে শ্রমিকরা কাজ পাচ্ছে না। কাজ না থাকার কারণে শ্রমিকরা বেতন পাচ্ছে না। শ্রমিকরা সৎ মানুষ। তারা চুরি করতে জানে না। তারা কর্ম করে খেতে চায়। আমরা একদল সৎ ও দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে চাই। যারা আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে ভালো মানের পণ্য উৎপাদন করে দেশের সুনাম বয়ে আনবে। আমাদের প্রচেষ্ঠা থাকবে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা করা ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে যাওয়া। এই জন্য আমাদেরকে ইসলামী শ্রমনীতির আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে। সৎ নেতৃত্ব কায়েম করতে হবে। তাহলে আমরা আল্লাহর রাসূল (সা.) প্রতিষ্ঠিত সোনালী সমাজের দিকে আবার ফিরে যেতে পারব।
আজকের এই সম্মেলনে নিম্মোক্ত প্রস্তাবনা গৃহিত হয়েছে
১. আজকের এই সম্মেলন গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছে যে, চলমান কোভিড-১৯ করোনা পরিস্থিতি সারা দেশে ভয়াবহ রূপলাভ করেছে। গ্রাম ও শহরে সর্বত্র আক্রান্তের হার প্রায় ৪০% ছাড়িয়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এই সম্মেলন শ্রমজীবী মেহনতি মানুষকে ১০০ ভাগ টিকার আওতায় আনার সরকারি, বেসরকারি এবং এনজিও সংস্থাগুলিকে অবিলম্বে সম্বনিত পরিকল্পনার মাধ্যমে করোনা চিকিৎসা ও সেবা সেন্টার প্রতিষ্ঠা, হাসপাতালগুলিতে বেডের পরিমান বৃদ্ধির জোর দাবি জানাচ্ছে।
২. আজকের এই সম্মেলন গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছে যে, দেশের শ্রমশক্তির ৬৫ ভাগ কৃষি খাতে নিয়োজিত। কিন্তু দেশে এখনোও কৃষি ভিত্তিক শিল্প কারখানা গড়ে না উঠার কারণে কৃষক পণ্যের নায্য মূল্য পাচ্ছে না। ফলে তাদের আর্থিক অবস্থার কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। এই সম্মেলন সরকারি ও বেসরকারি ভাবে কৃষি ভিত্তিক শিল্প কারখানা গড়ে তোলার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছে।
৩. এই সম্মেলন বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি আ ন ম শামসুল ইসলাম (সাবেক এমপি) এর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছে এবং তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার পূর্বক শ্রমিকদের স্বার্থে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছে।
৪. শ্রমিক বাঁচলেই শিল্প বাঁচবে, শিল্প বাঁচলে দেশ বাঁচবে এবং দেশের অর্থনীতি সুদৃঢ় হবে। টেকসই উৎপাদন খাতকে মজবুত করতে হলে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তাই এই সম্মেলন সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছে শ্রমিকদের জীবন যাত্রার মান ঠিক রাখার জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করার এবং দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছে।
৫. আজকের এই সম্মেলন গার্মেন্টস শ্রমিকদের সর্বনিম্ম মজুরী ৮০০০/- টাকা নির্ধারণ করা হলেও অধিকাংশ গার্মেন্টস মালিক শ্রমিকদের সর্বনিম্ম মজুরি না দিয়ে বিভিন্নভাবে শ্রমিকদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। এমনকি দাবি আদায়ের আন্দোলনকে দমনের নামে হয়রানি ও গ্রেফতার করে অন্যায়ভাবে শ্রমিকদের চাকুরিচ্যুত করছে। এই সম্মেলন গার্মেন্টস শিল্পে বর্তমানে গৃহিত কালাকানুন টার্মিনেশন এ্যাক্ট বাতিল করে পূর্বের আইন বহাল করার জোর দাবি জানাচ্ছে এবং সর্বনিম্ম মজুরি ১৬০০০/- টাকা ও বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট নির্ধারণ করে মজুরি কমিশন ঘোষণা করতে দাবি জানাচ্ছে। সকল বন্ধ গার্মেন্টস খুলে দিয়ে শ্রমিকদের চাকুরিতে বহাল রাখার জোর দাবি জানাচ্ছে।
৬. আজকের এই অধিবেশন বন্ধকৃত ২৬টি জুট মিলের শ্রমিক-কর্মচারিদের যাবতীয় বকেয়া পাওনাদি অবিলম্বে পরিশোধ করার জোর দাবি জানাচ্ছে এবং বিএমআরই পদ্ধতিতে আধুনিকায়ন করে উক্ত ২৬ট জুট মিলসহ সরকারি ও বেসরকারি বন্ধকৃত সকল কল-কারখানা অবিলম্বে চালু করার জোর দাবি জানাচ্ছে।
৭. এই অধিবেশন আইএলও কনভেনশন মোতাবেক অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের নিয়োগপত্র প্রদান নিশ্চিত করার জোর দাবি জানাচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে সরকার ও শ্রম অধিদপ্তরকে জটিলতা সৃষ্টি না করে সহজ শর্তে ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছে।
৮. এই সম্মেলন গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছে যে, পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি বন্ধ করতে না পারলে পরিবহন শ্রমিকদের দুর্দশা শেষ হবে না। তাই সম্মেলন পরিবহন শ্রমিকদের নিয়োগপত্র প্রদান, চাঁদাবাজি ও হয়রানি বন্ধ করার জোর দাবি জানাচ্ছে। চলমান কোভিড-১৯ করোনা পরিস্থিতিতে পরিবহন শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার লক্ষে সরকারের পক্ষ থেতে প্রত্যেক শ্রমিককে টিকার আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছে।
৯. আজকের এই অধিবেশন মনে করে যে, বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি জাতিয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন অগ্রগতি মানে দেশের উন্নতি। তাই বাংলাদেশ রেলওয়েকে দ্রুত আধুনিকায়নের পাশাপাশি ঢাকা-লাকশাম-ঢাকা কর্ড লাইন, দোহাজারী-কক্সবাজার ও বগুড়া, জামতইলসহ সারাদেশে রেলওয়ে সম্প্রসারণ করার জোর দাবি জানাচ্ছে।
১০. আজকের এই অধিবেশন মনে করে যে, শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত সমস্যার সমাধান কুরআন সুন্নাহর আইন প্রতিষ্ঠা ছাড়া সম্ভব নয়। তাই ইসলামী শ্রমনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষে শ্রমজীবী মানুষসহ সকল স্তরের শ্রমিক জনতাকে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের পতাকাতলে শামিল হওয়ার উদাত্ত আহবান জানাচ্ছে।