শ্রমিক ও শ্রমিক আন্দোলন
যে কায়িক শ্রম দেয় সেই শ্রমিক। শ্রম আইন অনুযায়ী অর্থের বিনিময়ে অন্যের অধীনে নিযুক্ত হয়ে যে কায়িক শ্রম দেয় সেই শ্রমিক। শ্রম আইনের সংজ্ঞায় কোনো কলকারখানায় বা উৎপাদন ক্ষেত্রে যারা নিয়োগ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ তারা শ্রমিক নন, তারা কর্মকর্তা। ট্রেড ইউনিয়ন আইন অনুযায়ী কর্মকর্তারা ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার রাখে না। কেবল শ্রমিক এবং কর্মচারীরা আইনত ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষমতা রাখেন।
শ্রমিকরা তাদের কর্মক্ষেত্রে নিজস্ব অধিকার আদায়ের জন্য শ্রম আইনের নির্ধারিত পন্থায় সংগঠিত হয়ে দরকষাকষির জন্য যে আন্দোলন করে সেটাই শ্রমিক আন্দোলন। শ্রমিক কর্মচারীদের দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে আইনানুগ আন্দোলনই মূলত শ্রমিক আন্দোলন। তবে একদিকে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা, উৎপাদনশীলতা, অন্যদিকে শ্রমিকের ভাত কাপড় শিক্ষা চিকিৎসা ও বাসস্থানের মত মৌলিক চাহিদা ও তার কর্মক্ষেত্রে আইন দ্বারা নির্ধারিত তার ন্যায্য প্রাপ্য আদায়ের আন্দোলনে ভারসাম্য রক্ষা করা শ্রমিক নেতৃত্বের পবিত্র কর্তব্য। প্রতিটি আন্দোলনের জন্য চাই একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য উদ্দেশ্য, একটি কর্মসূচি, একদল কর্মীবাহিনী ও একজন দক্ষ নেতার নেতৃত্ব।
শ্রমিক আন্দোলনের অধিকারের চারটি ভিত্তি
১. ILO convention ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ILO বা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মোট ১৮৯টি convention আছে। বাংলাদেশে তার ৮টি কোর convention ও ৩৩টি সাধারন convention গৃহীত হয়েছে। এই ILO convention এর ধারা ৮৭তে সংগঠন করার অধিকার এবং convention এর ধারা ৯৮ তে দরকষাকষির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
২. ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে।
৩. বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬, বিধিমালা ২০১৫, ২০১৮ (সংশোধিত) তে শ্রমিক আন্দোলনের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে।
৪. বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৪,৩৫,ও ৩৮ এ শ্রমিকদের সংগঠনের স্বাধীনতা ও সভা সমাবেশের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এ দেশে ৫০ ও ৬০ এর দশক থেকে কমিউনিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক নেতারা ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক আন্দোলনকে সমাজতন্ত্রের দর্শন বোঝানো, সাম্যবাদ বা শ্রমিকরাজ কায়েমের কথা বলে লাল পতাকা এবং দুনিয়ার মজদুর এক হওয়ার মুখোরোচক শ্লোগান দিত। শ্রমিকদেরকে সংগঠিত করে এ দেশে সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে প্রকৃতপক্ষে নাস্তিক্যতাবাদী দর্শনের শিক্ষা দিত। তাদের দর্শন ছিলো Trade union is the school of communism. কিন্তু সমাজতন্ত্রীদের সেই মিশন ব্যার্থ হয়েছে। দেশের দুঃখী বঞ্চিত শ্রমিক সমাজ তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় নতুন নেতৃত্ব ও নতুন আদর্শের সন্ধান করছে। সেই আদর্শ ইসলাম বা ইসলামী শ্রমনীতি। সেই নেতৃত্ব সৎ দক্ষ ও মানবিক গুন সম্পন্ন সাহসী নেতৃত্ব হতে হবে। ফলে ইসলামী আদর্শ ও যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে আমরা ট্রেড ইউনিয়নকে ইসলামী শ্রমনীতি তথা ইসলামী আদর্শের দাওয়াত প্রদান এবং তা বাস্তবায়নের মিশনে পরিনত করতে পারি। অর্থাৎ আমরাও বলতে পারি, Trade union is the school of islam. এজন্য প্রয়োজন সৎ দক্ষ যোগ্য ও শ্রমিকবান্ধব মানবদরদী নেতৃত্ব।
প্রত্যাশিত নেতৃত্ব
নেতৃত্ব বা Leadership হচ্ছে একজন মানুষের সেই ক্ষমতা যা দিয়ে কোনো একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সমাজের মানুষকে বা কোনো দলকে অনুপ্রেরণা ও দিক নির্দেশনা দিয়ে পরিচালিত করতে পারে।
একজন সফল নেতার দায়িত্ব হচ্ছে তার অনুসারীদের মাঝ থেকে ভবিষ্যত নেতৃত্ব দেওয়ার মত যোগ্যতা অর্জনের প্রশিক্ষণ ও সময়োপযোগী নেতৃত্ব গড়ে তোলা। যে কোনো আন্দোলনের নেতৃত্বে প্রয়োজন বিশ্বাস্যযোগ্যতা বা credibility. বিশেষ করে শ্রমিক আন্দোলনে সফল নেতৃত্ব দিতে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এখানে বক্তৃতা ভাষণের চেয়ে বড়ো প্রয়োজন দক্ষতার। শ্রমিকদের কল্যানে কাজ করতে শ্রমিকদের আস্থা অর্জন করা জরুরি। আদর্শিক আন্দোলনে ব্যক্তির চেয়ে আদর্শ বড়। তাই আদর্শের স্বার্থে ব্যক্তির স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। নেতৃত্ব আসলে ক্ষমতা। নেতৃত্বের গুনাবলী প্রধানত জন্মগত, কিন্তু ইসলামী আন্দোলনে বা ইসলামী সংগঠনে উন্নতমানের লোকেরা কম আসে। জন্মগত ভাবে যোগ্য লোকেরা সাধারণত তাদের নেতৃত্বকে সমাজের সুযোগ সুবিধা অর্জনের কাজে লাগায়। আন্দোলন যে ত্যাগ চায় সে ঝুকি তারা নিতে চায় না। অল্প লোকই এ পথে আসে, তাই যোগ্য লোকের অভাব। সাধারণ ভাবে মধ্যম মানের লোকেরা ইসলামী আন্দোলনে আসে। অব্যাহত বাধা, বাস্তব অভিজ্ঞতা ও নিরন্তর সাধনা এবং অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে তার মান উন্নত হয়। সব আন্দোলনেই নেতৃত্ব সবচেয়ে বড়ো factor. অনেক জনপ্রিয় আন্দোলন নেতৃত্বের দক্ষতার অভাবে ব্যর্থ হয় আবার নেতৃত্ব যোগ্য হলে মানবকল্যাণ বিরোধী মতবাদও কায়েম সম্ভব। আবার অযোগ্য হলে ইসলামের মত ভালো আদর্শ কায়েমও অসম্ভব। মূলত যোগ্য নেতৃত্বের অভাবেই আমরা এগোতে পারছি না।
একজন আদর্শ নেতাকে ৩টি চাহিদা পূরণ করা চাই
ক.সাংগঠনিক চাহিদা
খ.ধর্মীয় চাহিদা
গ.রাজনৈতিক চাহিদা
ক. সাংগঠনিক চাহিদা পূরণে গুনাবলী
১. শ্রমিকদের সংগঠনভুক্ত করার যোগ্যতা। (তাদেরকে বুঝানো বা তাদের প্রশ্নের সুন্দর জবাব দিয়ে সুসম্পর্ক তৈরি করা।)
২. সংগঠন ভুক্তদের ভালবাসা অর্জনের যোগ্যতা। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, ভদ্র আচরণ, দরদী মন, শান্ত মেজাজ এবং নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করা।
৩. পরামর্শ ভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভ্যাস।
৪. সমালোচনা ও সংশোধনের সুযোগ দানের সৎসাহস থাকা।
৫.উদ্যোগী ভূমিকা ও নিরলস প্রচেষ্টা চালানো।
খ. ধর্মীয় চাহিদা পূরণে গুনাবলী
১. ইমামতীর যোগ্যতা, সহীহ তেলাওয়াত, মাসয়ালা মাসায়েল সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা, পোশাকের ক্ষেত্রে শরয়ী বৈশিষ্ট্য খেয়াল রাখা।
২.দাওয়াত দানের জন্য উপযুক্ত বক্তব্য।
৩. অধীনদের শিক্ষাদানের যোগ্যতা।
৪.দারসে কুরআন পেশ করার যোগ্যতা।
৫.জনগণের ধর্মীয় প্রয়োজন পূরণে কাজ করা। যেমন : মাদ্রাসা-মসজিদ, ঈদগাহ, কবরখানা, কুরবানি ও বিয়ে ইত্যাদিতে সম্পৃক্ততা।
৬. দ্বীনের ইস্যুতে মানুষ যেন কাছে আসে।
৭. কুরআনের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রাখা।
৮. জ্ঞান লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকা।
৯. কিয়ামুল লাইলের অভ্যাস।
১০.যিকরে ইলাহী।
১১.সবর।
গ. রাজনৈতিক চাহিদা পূরণে গুনাবলী
১. নেতা হিসাবে শ্রমিকদের বিভিন্ন প্রয়োজনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা। (জুলুমের বিরুদ্ধে, ন্যায্যদাবি, সমস্যা নিয়ে, বিপদে-আপদে পাশে থাকা।)
২. রাজনৈতিক/সমস্যা ইস্যুতে ভূমিকা রাখা/জননেতা, শ্রমিকনেতা ও ছাত্রনেতাদের সাথে যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক রাখা।
৩. অন্যদের কাছে নেতা বলে গণ্য হওয়া, ট্রেড ইউনিয়ন সমস্যাকে আইনগত ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় মোকাবেলা করা।
৪. মালিক ও কর্তৃপক্ষের সাথে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখা।
নেতাকে সরাসরি দায়িত্ব নিয়ে ৩টি কাজ করতে হবে
১.পরিকল্পনা করা। (টার্গেট, সাধ্য, সম্ভাবনা, সমস্যা সামনে রেখে)
২.কর্মবণ্টন।
৩.বাস্তবায়ন। (তদারকি, নির্দেশ, নিয়ন্ত্রণ করা)
ভালো নেতৃত্বের আরও কিছু গুনাবলী
১. শ্রমিকদের মনের ভাষা বুঝতে পারা।
২. আত্ম-সচেতনতা, ইচ্ছাশক্তি।
৩. সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা।
৪. যোগাযোগ দক্ষতা।
৫. প্রতিনিধিত্ব।
৬. সৃজনশীলতা।
৭. দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা।
৮. নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা।
৯. মূল্যায়ন ক্ষমতা।
১০. পরিকল্পনা করার দক্ষতা।
১১. অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা।
১২. ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা।
সময়ের সদ্ব্যবহার (আমানত)
★ সব কাজের সময় পূর্বে ঠিক করে নেওয়া।
★ কথা কম বলা, বক্তৃতায় সময় কম হলেই চলে।
★ একই সময়ে একাধিক কাজ করা।
★ দ্রুততার সাথে কাজ করা।
★ সময় অপচয় রোধ করা।
শ্রমিক নেতৃত্বের জন্য বিশেষ কিছু যোগ্যতা অবশ্যই প্রয়োজন
১.শ্রম আইন বুঝা।
২.ট্রেড ইউনিয়ন আইন সম্পর্কে জ্ঞান।
৩. শ্রম মন্ত্রণালয়, শ্রম অধিদপ্তর ও তার সংশ্লিষ্ট অফিস ও কর্মকর্তা সম্পর্কে ধারনা।
৪. এলাকার ট্রেড সেক্টর ও নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে ধারনা রাখা।
৫. যথার্থ ইস্যু সনাক্ত করতে পারা।
৬. মালিক পক্ষের সাথে সুসম্পর্ক রাখা।
৭. সমমনা নেতৃবৃন্দের সাথে সুসম্পর্ক রাখা।
৮. সাহসিকতা।
৯. সরল জীবন যাপন।
১০. শ্রমিকদের আপন করে নেওয়া।
১১. হাসি মুখে কথা বলা।
নেতৃত্বের মানোন্নয়ন
১.ইমান, ইলম ও আমলে অনুকরণ যোগ্য হওয়া।
২.মজবুত সিদ্ধান্ত ও দ্বিধা মুক্ত হওয়া।
৩.উত্তম আমল,কুরআন, নামাজ, নফল ইবাদাত,সাদকা, আখিরাতের চিন্তা, লেনদেন, আমানতদারী, কুপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ, পরিবার গঠন ইত্যাদি বিষয়ে খেয়াল রাখা।
৪. ইকামাতে দ্বীনকে অন্য দায়িত্বের উপর প্রাধান্য দেওয়া।
৫. আত্মগঠন প্রচেষ্টা জোরদার, ব্যক্তিগত পড়াশুনা, সাংগঠনিক সিলেবাস, গুরুত্বপূর্ণ বই নোট করা, যুগ জিজ্ঞাসার জবাব ও সমকালীন জ্ঞান।
৬. সাংগঠনিক তৎপরতা ও সংগঠন সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা।
৭. দুর্বলতা দূর করা, আত্মসমালোচনা।
৮. সময়, শ্রম, আরাম, আয়েশ, কুরবানি।
৯. ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক কাজে ভারসাম্য রক্ষা।
উপসংহার
এসব গুনাবলীতে সমৃদ্ধ নেতৃত্বই আমাদের প্রত্যাশিত। এমন নেতৃত্বের মাধ্যমেই ইসলামী শ্রমনীতির সংগ্রাম ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার অভিন্ন সংগ্রাম বিজয়ী হবে ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ আমাদেরকে সেই যোগ্যতা অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি,বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন