আমরা সবাই শ্রমিক। কেননা যারাই শ্রম সাধনায় মত্ত তারাই শ্রমিক। সে কারণে পৃথিবীর সব মানুষই শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে গণ্য। বাংলাদেশের সরকারি চাকরির বড় পজিশন হলো বিসিএস কর্মকর্তা। বিসিএস মানে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস। যারা বিসিএস কর্মকর্তা তারা হলেন সিভিল সার্ভেন্ট। সিভিল সার্ভেন্ট মানে জনগণের সার্ভেন্ট। সার্ভেন্ট মানে সেবক, কর্মাচারী, আদেশ পালনকারী। আরো সহজ কথায় বলতে গেলে চাকর। সুতরাং আমরা যে যতো বড়ো পদেই অবস্থান করি না কেনো আমরা প্রকারান্তরে সার্ভেন্ট। প্রত্যেক মানুষকে তাঁর মর্যাদা দেয়া হয় শ্রমের ভিত্তিতে। যিনি যতো উচ্চমানের কল্যাণমুখি শ্রম বিনিয়োগ করতে পারেন তিনি ততো বেশি সম্মানী এবং মর্যাদাবান। শ্রম মানেই কাজ। কাজের মধ্যেই মানুষের জীবনের সফলতা বিফলতা নির্ভর করে।
ভাষা থেকে স্বাধীনতা : আগ্রাসন ও প্রতিরোধ
প্রবাহমান নদীর মতো ভাষাও গতিশীল। একটি ভাষা অন্য ভাষার ভেতর প্রবেশ করে নিজের গতিময়তাকে অব্যাহত রাখে। আবার কখনো অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দ সংগ্রহ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করে। যেমন বাংলা ভাষার ভেতর আরবি, উর্দু, ফারসি, ইংরেজিসহ বহু ভাষা-শব্দের সমন্বয় ঘটেছে। লেখা কিংবা কথা বলার ফাঁকে উদৃতি হিসেবে অন্য ভাষার ব্যবহার দোষের নয়। রাশিয়ার সাহিত্যিক তলস্তয় বা দস্তয়ভস্কি বা অন্যান্য লেখকের লেখাতেও ফরাসি উদ্ধৃতি চোখে পড়ে। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় আতলামি ভাষাকে অবমাননার দিকে ঠেলে দেয় বৈকি। মূলত আধিপত্য, বাণিজ্য, যাযাবরবৃত্তি প্রভৃতি কারণে একটি ভাষা অন্য ভাষার ভেতর প্রধাণ্য বিস্তারের সুযোগ পায়। বর্তমানে বিশ্বায়নের বদৌলতে পণ্যায়নের মতো ভাষাও বিনিময় হচ্ছে ব্যাপক হারে। এই ব্যাপকতাই আতঙ্কের কারণ। কেননা বিশ্বায়নের আধিপত্য এখন ভাষাভিত্তিক হিসেবেও চিহ্নিত হচ্ছে। ভাষা স্রেফ মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যমই নয় বরং একটি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির ধারক বাহক। তাই ভাষা পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের মানসিকভাবে গোলাম বানানোর প্রক্রিয়া চালানো হয়ে থাকে। প্রভাব বেশি হলে তারা মানুষকে নীতি, ভাষা ও সংস্কৃতিহীন করে ফেলছে। বাণিজ্যিক পণ্যের মতো ভোক্তাকে সাংস্কৃতিক শেকড়হীন করে তোলার বাণিজ্য বিস্তারের রাজনীতি এখন ওপেন সিক্রেট বিষয়। বাংলাভাষা এখন সেই আগ্রাসনের মুখোমুখি।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য দেশের মানুষকে গর্বিত করে তোলে। মাতৃভাষাচর্চা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে জাতি ঐতিহ্যশূন্য হয়ে পড়ে। তাই আধিপত্যবাদী শক্তি তাদের ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াসে সচেষ্ট থাকে। সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার হিসেবে ভাষাকে ব্যবহার করা হয়েছে সবসময়ই। বিদেশি সেন বংশীয় শাসকরা অন্যায়ভাবে দখল করেছিল বাংলার সিংহাসন। তারা বাংলা ভাষার ওপর আঘাত হেনেছিলো। এদেশের সাধারণ বাঙালিকে শূদ্র বর্ণভুক্ত করে তাদের জন্য বাংলাভাষাচর্চা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলো। পরবর্তীতে বিদেশাগত মুসলমান সুলতানদের মতো উদার শাসকদের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি সেখানেই মুখ থুবড়ে পড়তো। মুসলিম শাসনের ছয় শতাধিক বছর রাষ্ট্রভাষা ফারসি হিসেবে পরিচালিত হলেও তাদের আন্তরিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই বাংলাভাষা ও সাহিত্যচর্চায় উৎকর্ষ সাধিত হয়। ইংরেজ শাসকরাও শোষণচিন্তা মাথায় রেখে এদেশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারাও বুঝেছিল বাঙালিকে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যিক শক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হলে মাতৃভাষা বিচ্ছিন্ন করতে হবে। কিন্তু ইংরেজরা ছিল বুদ্ধিমান জাতি। তারা বুঝেছিল, নানা ভাষায় কথা বলা জাতি বাংলাসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। হঠাৎ করে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ইংরেজি চাপিয়ে দিলে নানা অঞ্চলেই মানুষ ক্ষুব্ধ হতে পারে। তাই তারা একদিকে ফারসিতেই সরকারি কাজকর্ম চালানোর ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে সরকারি অফিসে ইংরেজি জানা লোকদের চাকরির ব্যবস্থা করে। সরকারি চাকরি পাওয়ার আশায় অনেকেই ইংরেজি শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হয়। জনমত তৈরির মাধ্যমে অনুক‚ল পরিবেশ এলে ১৮৩৫ সালে ইংরেজিকে সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় অভিন্ন উদ্দেশ্য থাকলেও বুদ্ধির দৌড়ে পিছিয়ে পড়ে পাকিস্তানি শাসকরা। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের পূর্ব এবং পশ্চিম অংশের মধ্যে ভাষাকে কেন্দ্র করেই বিবাদ লেগেছিল। জাতীয় ভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার আগ্রাসী রাজনীতি মেনে নিতে পারেনি পূর্ব পাকিস্তান। যার ফলে জন্ম নেয় নতুন আবেগ এবং তার ফলশ্রুতি হিসেবে নতুন বাংলাদেশ।
ইংরেজি আগ্রাসন এখন আভিজাত্যের ঘরানায়। আঠার-উনিশ শতকের ইংরেজ ঔপনিবেশিক নেতাদের মতো ধীরে ধীরে প্রজন্মকে বাংলাভাষা ও সাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস চলছে। বাংলা ভাষার তুলনায় ইংরেজি ভাষা মর্যাদা ও কার্যকারিতায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। এই ভাষার পেছনের শক্তি হল নব্য ধনিক শ্রেণি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মফস্বল শহর থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকা শহর পর্যন্ত সর্বত্র কতিপয় নব্যধনিক শ্রেণির বিস্তৃতি ঘটেছে। এই শ্রেণিটি ইংরেজি ভাষার সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক। এ ধনিক শ্রেণিটি রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত থেকে দেশে ইংরেজি ভাষা প্রতিষ্ঠিত করার কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে ব্যক্তি মালিকানায় যেসব বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার প্রায় সবগুলোই ইংরেজি মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। দেশের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক-বীমা ইত্যাদির দাপ্তরিক কাজকর্ম ইংরেজিতে সম্পন্ন হচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সব বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। শুধু উচ্চবিত্ত নয় মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত অনেক পরিবারের মধ্যে ইংরেজি মাধ্যমে সন্তানকে পড়ানোর মিথ্যা আভিজাত্যের লোভ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মাধ্যম রাখা হয়েছে ইংরেজি। মেধা ও পরিচর্যা দুই বিচারেই এসব শিক্ষার্থীর বড় অংশ না বাংলা বা ইংরেজি কোনো ভাষাতেই দক্ষ হয়ে উঠতে পারছে না। ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষায় দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানার সুযোগ নেই বললেই চলে।
অবাধ ইন্টারনেটের যুগে ভিনদেশি কৃষ্টি-সংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের বাংলা ভাষার নিজস্ব ব্যবহারবিধি ও স্বকীয়তা থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে। ডিজিটাল মানদÐের মাধ্যম হিসেবে আমরা বাংলা ভাষাকে এখনও বেশি দূর এগিয়ে নিতে পারিনি। এখনও বাংলায় কেউ ই-মেইল করতে আগ্রহ দেখায় না। মোবাইল ফোনের মেসেজটাও বাংলা হরফে না লিখে ইংরেজি হরফে লিখে থাকে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সাহিত্যে ইংরেজিকেন্দ্রিক এক ধরনের দাম্ভিকতা লক্ষ্য করা যায়। ইংরেজি লিখতে-পড়তে না পারলে যেন জাতে ওঠা যায় না। ফলে ইংরেজি না জানা সত্তে¡ও এক ধরনের সাহিত্য চর্চাকারীকে দেখা যায় ইংরেজি বই হাতে নিয়ে ঘুরতে। কথায় কথায় তারা বলে এদেশের সাহিত্যে কিচ্ছু নাই। কিছু হচ্ছে না। এ ধরনের বিদঘুটে ধারণা নিজেদের অজান্তেই প্রায় সংক্রমিত। বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষা প্রতিষ্ঠায় যারা ওকালতি করেন, তারা এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন যে, ইংরেজি ভাষা ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে বিশ্বের জ্ঞান ভান্ডারে প্রবেশের মাধ্যম এটি। বিশ্বের চাকরির বাজারে প্রবেশের মাধ্যম ইংরেজি।
সাংবিধানিক নিয়ম রক্ষার স্বার্থে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের দাপ্তরিক কাজকর্ম বাংলা ভাষার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ইংরেজি ভাবধারার অভিজাত শ্রেণি। তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু উন্নয়ন করে বেসরকারি খাত। তারা দেশের সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালায়, কিন্তু এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের নিজেদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য পাঠায় না। কাজেই অভিজাত শ্রেণির কল্যাণে দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ইংরেজিতে পরিচালিত হচ্ছে। এভাবে দাপ্তরিক কার্যকারিতায় ইংরেজি পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে।
বাংলা একটি সমৃদ্ধ ভাষা। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। তাদের মধ্যে বৃহৎ অংশই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ভালোবাসে। আর এক উদ্ভট শ্রেণির মানুষ আছে যারা মনে করে থাকে একটু আধটু হিন্দি বলতে পারলে নিজেকে স্মার্ট, আধুনিক, ইন্টারন্যাশনাল পার্সোনালিটি হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে। সংস্কৃতির বিকাশে আজকের দিনে টেলিভিশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শক্তিশালী গণমাধ্যম। বেসরকারি গণমাধ্যমসমূহে চিবিয়ে চিবিয়ে, ভুলভাল উচ্চারণে বাংলা ইংরেজির শব্দ-বাক্যগুলোর বেহাল দশা বানিয়ে ফেলেছে। নাটকের চরিত্রদের মুখে বিকৃত বাংলা, ভাঙা ইংরেজি, খোঁড়া হিন্দি ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে এফএম রেডিও, টিভি- সবখানেই মিশ্রভাষা ব্যবহার করা হয়; যেটা বাংলা ভাষার নিজস্ব ব্যবহার বিধি ও মর্যাদাকে নষ্ট করছে। পাশ্চাত্য শক্তির এই অশুভ তৎপরতার সহায়ক বন্ধু হয়ে দেখা দিয়েছে আমাদের এ সকল টিভি-রেডিও চ্যানেল। এখানে তারুণ্যের ক্রেজ বলে এক অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলা ‘দর্শক’ শব্দ ভুলিয়ে ‘হাই ভিউয়ার্স’ সংস্কৃতির কর্ষণ করা হচ্ছে।
শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃর্থিবীতে ইংরেজি এক ভয়াবহ দানবে পরিণত হয়েছে। ইংরেজি ভাষা বিশ্বব্যাপী শুধু দখলদারিত্বই কায়েম করেনি বরং, বিভিন্ন কায়দায় পুরোপুরিভাবে ইংরেজিতে লিখতে পড়তে চিন্তা ও জীবনযাপন করতে প্রলুব্ধ করছে। মাইক্রোসফট এনকার্টা ওয়ার্ল্ড ডিকশনারি প্রকাশনার উদ্বোধনী ভাষণে বিল গেটস বলেই ফেলেছেন, ‘এক পৃথিবী, এক অভিধান।’ ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন, জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড ইন সার্ভিসেস (গ্যাটস) চিন্তা উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। উৎপাদিত চিন্তার ক্রেতা, ভোক্তা ও বিক্রেতাদের মনস্তত্ত¡ আবিষ্কার করে বিনিয়োগ প্রক্রিয়ায় সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের স্কুল ভাউচার প্রোগ্রাম, গণশিক্ষার ক্ষেত্রে কর্পোরেট অনুদানসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রকল্প চালু করে শিক্ষার জগতে নিজেদের ব্যবসার অনধিকার প্রবেশের সুযোগ করে নিয়েছে। শিক্ষাকেও বাজারব্যবস্থার আওতায় এনে শিক্ষক-ছাত্রের ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরি করেছে। গ্যাটসের কাজ হলো- শিক্ষাসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। মোস্ট ফেভারিট নেশন ও ন্যাশনাল ট্রিটমেন্ট গ্যাটসের প্রধান দুই নীতি। বিশ্ব মুক্তবাজার ব্যবস্থা তৈরির নীলনকশা প্রণয়নে গ্যাটস বিশ্ব শিক্ষাব্যবস্থাকে এক হাতে নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস চালাচ্ছে। এই শিক্ষা ব্যবসার প্রধান বাহন হচ্ছে ইংরেজি। বিনোদন, বাণিজ্যিক প্রয়োজন, শিক্ষার ছদ্মবেশে এ ভাষাটি রাক্ষসের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ডেভিট ক্রিস্টাল বলেছেন, এই পৃথিবীর ছয় হাজার ভাষা ইংরেজির প্রভাবে এই শতাব্দীতেই ধ্বংস হয়ে যাবে। আগামী ৫০ বছরের মধ্যে ইউনাইটেড আরব আমিরাতের দুবাই শহরটির আরবি ভাষা নষ্ট হয়ে ইংরেজি ভাষাভিত্তিক এক নতুন শহরে পরিণত হবে। আমরা এসব কথা বলছি, তার মূল কারণ হলো- শিক্ষার মাধ্যম হলো ভাষা। যদি বিশ্বজুড়ে একটি ভাষার আধিপত্য বিস্তার করা যায়, তাহলে শিক্ষার যে ট্রিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, তা গগণচুম্বী হতে পারে।
হিন্দি মানেই প্রতিবেশির সংসার। এটাকে অনেকেই আগ্রাসন মনে করেন না। অথচ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, উচ্চতর শিক্ষা এবং বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য বাংলাদেশে একদিকে ইংরেজি ভাষার দৌড়াত্ব চলছে অন্যদিকে চলছে হিন্দির আগ্রাসন। হিন্দি ভাষার পেছনে ভারতের হিন্দি বিস্তৃতির সাম্রাজ্যবাদী নীতি কাজ করে থাকে। বাংলাদেশে হিন্দি ভাষায় প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে যেমন রয়েছে শিশুদের জন্য কার্টুনের মতো অনুষ্ঠান, তেমনি বড়দের জন্য রয়েছে সিনেমা, নৃত্যকলা ও ম্যাগাজিনের মতো বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান। দেশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এক সময় ইংরেজি কার্টুন দেখতো। এখন আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে ক্রমশ হিন্দি কার্টুন দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। হিন্দি কার্টুনের আধিক্যে ছোট ছোট শিশু ও ছেলেমেয়েরা বাংলার বদলে হিন্দির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। মায়ের বুলি বাংলার বদলে হিন্দিই বেশি উচ্চারণ করছে। শিশু জন্মের পর মাতৃভাষা বাংলা শোনার বদলে টিভির কার্টুনের বদৌলতে হিন্দির প্রতি আসক্ত হচ্ছে। হিন্দির আগ্রাসনে মাতৃভাষা বাংলার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে এই হিন্দির যেভাবে বিস্তৃতি লাভ করছে তা খুবই আশঙ্কাজনক। হিন্দিকে বলা হচ্ছে ভারতের ঐক্যের সূত্র। হিন্দির বিস্তারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংস্কৃতির মেরুদন্ড ভেঙে দেয়া হচ্ছে। ডোরেমন কার্টুন ছাড়াও ভারতীয় চ্যানেলে হিন্দিতে প্রচারিত মহাভারত, ঠাকুর মার ঝুলি, জয় হনুমান, গড গণেশ, গোপাল ভাঁড়, শিবাসহ অসংখ্য সিরিয়াল দেখানো হয়। এসব সিরিয়াল নিয়মিত দেখে আমাদের বাংলাদেশের শিশুরা হিন্দির প্রতি উৎসাহী হচ্ছে। বাংলা ভাষার শেখার বদলে তারা হিন্দির প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। ইদানিং শিশুদের মধ্যে হিন্দিতে কথা বলা যেন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। হিন্দু ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে তৈরি শিশুতোষ কার্টুন, এনিমেশন এবং সিরিয়ালগুলো থেকে মুসলিম পরিবারের শিশুরাও বিশ্বাসগত দিক থেকে ভিন্ন পথে অগ্রসর হচ্ছে। এ সব প্রভাবে শিশুরা এখন বাসা-বাড়িতে, বন্ধুদের সাথে এমনকি স্কুলেও হিন্দি ভাষায় কথা বলে। শুধু বাংলা ভাষায় পড়াশোনা করা শিশুরাই নয়; ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা শিশুদেরও দ্বিতীয় ভাষা হয়ে উঠেছে হিন্দি। পাকিস্তান আমলের উর্দুর মতোই এখন এ জাতির ঘাড়ে হিন্দি চেপে বসছে। এভাবে হিন্দির প্রতি অবুঝ শিশুরা উৎসাহী হলে এক সময় হিন্দির আগ্রাসনে বাংলা হারিয়ে যাবে। বিজাতীয় এই আগ্রাসন রুখতে না পারলে ভবিষ্যতে চরম মূল্য দিতে হবে আমাদের।
ভারতীয় চ্যানেলে হিন্দি ভাষায় প্রচারিত সিরিয়াল, নাটক নেতিবাচকভাবে আঘাত করছে আমাদের পারিবার ও সামাজিক মূল্যবোধে। হিন্দি সিরিয়াল বোম্বের সিনেমাবাহিত সংস্কৃতি মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের অন্দরে ঢুকছে ভয়াবহভাবে। হিন্দি ভাষার সিনেমা, টিভি সিরিয়ালে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের প্রেম করার কৌশল, ভাষা বিন্যাস, পোশাকের স্টাইল, পরকীয়া প্রেম, চুল-চেহারার বিন্যাস, বাবা-মায়ের অবাধ্য হওয়া এমনকি আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ভিনদেশি টিভি অনুষ্ঠান এবং সিরিয়াল থেকে বাদ যাচ্ছে না শিশুরাও। এর প্রভাব পড়ছে জীবন-আচারসহ নানা জায়গায়। অনেক বাড়ির দৃশ্যটা প্রায় একই রকম। অবিরাম চলে একটার পর একটা ভিনদেশি টিভি সিরিয়াল। বিদেশি সিরিয়ালের কথিত চাকচিক্য আর তথাকথিত নাটকীয়তার ঘোরে আচ্ছন্ন অনেক দর্শক। কাজেই হিন্দি ভাষা বাংলাদেশে বিনোদনের বিকল্প ভাষা মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ভাষাটি বিনোদনের বিকল্প মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ায় বিনোদন জগতে বাংলার কার্যকারিতা হ্রাস পাচ্ছে।
শ্রমজীবী মানুষ এবং তাদের বিজয়স্বপ্ন
প্রত্যেকটা কাজই সম্মানের। যিনি যে কাজ করেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। হাতের পাঁচটি আঙুল পাঁচ রকমের করে সৃষ্টি করা হয়েছে। আকারে ছোটো বড় হলেও প্রতিটি আঙুলের মর্যাদাই সমান। মুষ্ঠিবদ্ধ করলে চারটি আঙুলের মাথাই সমান হয়। বৃদ্ধাঙ্গুলী মুরুব্বীর ভ‚মিকা পালন করে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখে। সবগুলো আঙুল সমান হলে মুষ্ঠিবদ্ধ হতো না। কোনকিছু ঠিকমতো ধরা যেতো না। কাজগুলো সুন্দরভাবে করা যেতো না। তাইতো সবগুলো আঙুলই খুব গুরুত্বপূর্ণ। একেকটার কাজ একেক রকম। একটা আঙুল বিকল হলে কাজে সমস্যা হয়। সুচারুভাবে কাজ সম্পাদনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। মানুষও তাই। সব মানুষকে সমানভাবে বানালে সমাজ চলতো না। সমাজ একটি গাড়ির মতো। গাড়িতে যেমন ছোটোবড় অনেক পার্টস থাকে তেমনি মানব সমাজেও। গাড়ির ছোটোবড় প্রতিটি পার্টসই যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি সমাজের ছোটোবড় প্রতিটি মানুষই গুরুত্বপূর্ণ। গাড়ির মতোই মানব পার্টস নিয়ে টিম স্পিরিটে চলতে হয়। এখানে ব্যত্যয় ঘটলেই সমস্যা সৃষ্টি হয়। সমাজ সুন্দরভাবে চলে না। এ জন্য কাজের বিষয়ে কখনো হীনমণ্যতায় ভোগা ঠিক না। আমি যে কাজটি করছি সেটাই সম্মানের। আমি বৈধ পন্থায় রোজগার করছি। কাউকে অন্যায়ভাবে ঠকাই না। শ্রমের বিনিময়ে ইনকাম করি। তাই তো আমি সমাজের একজন গর্বিত সদস্য। আমার কাজগুলো হবে ন্যায়ভিত্তিক। পরিচ্ছন্ন। মানবকল্যাণমুখি।
বাংলাদেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে দ্রæতগতিতে। শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিক-কর্মচারীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষিত খুব একটা সুখকর নয়। ফার্স্ট জেনারেশন মালিক গোষ্ঠীর কূটচালে দীর্ঘকাল ধরেই এ দেশের মেহনতি শ্রমিক সমাজ প্রকৃত মজুরি, অর্থনৈতিক সুষম বণ্টনব্যবস্থা, সর্বোপরি সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের সুবিধা, যেমন- স্বাস্থ্য পরিচর্যা সুবিধা, রেশন, ডরমেটারি, ডে-কেয়ার সেবা প্রভৃতি থেকে বঞ্চিত। শ্রমিক বাঁচলেই শিল্প বাঁচবে, শিল্প বাঁচলে দেশ বাঁচবে, বাঁচবে এ দেশের অর্থনীতি। এখানেই সরকারের মূল দায়িত্ব। অর্থনীতি ও টেকসই উৎপাদন খাতকে মজবুত করতে শ্রমিক ও তাদের সংগঠন ট্রেড ইউনিয়নের ভূমিকাকে যথাযথ স্বীকৃতি দিয়ে আস্থা তৈরির মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। উৎপাদনের স্বার্থে শ্রমিককে আস্থায় নিয়ে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। শ্রমিকদের প্রতি বৈরী মনোভাব না দেখিয়ে বা প্রতিপক্ষ না ভেবে তাদের উৎপাদনের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ বিবেচনা করতে হবে। দলমত, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। কথা কলার অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে ভাষার মাসের অঙ্গীকার। ভাষা-বিপ্লবের মাস পেরিয়ে স্বাধীনতার মাসের দাবী, শ্রমজীবি মানুষসহ সকল নাগরিকের জীবন-জীবিকা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সব ধরনের নিরাপত্তা প্রদান করার মাধ্যমে গড়ে তুলতে হবে সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ।
ভাষা বাঁচলে বাঁচবে স্বাধীনতা
পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী ভাষার চাপে ক্ষুদ্র ও অবহেলিত ভাষা হারিয়ে যাওয়া নতুন কিছু নয়। বাংলা ভাষা পশ্চিমবঙ্গের বিশেষত কলকাতায় এবং অন্যান্য শহর নগরে হিন্দি ও ইংরেজির আগ্রাসনে ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। পরবর্তীতে আসামের কিছু অঞ্চলের বাংলাভাষী মানুষ মাতৃভাষার প্রতিষ্ঠায় বুকের রক্ত দিয়েছেন। বাংলাদেশ ও আসামে সেই মহতী উদ্যোগ-উদ্দীপনা ও আত্মোৎসর্গকে স্মরণে নিয়ে বিশেষ দিনে অনুষ্ঠান, উৎসব পালন করা হয়। ইউনেসকো ২১ ফেব্রæয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এই স্বীকৃতি, এই সম্মান বাংলাদেশের মানুষকে তথাকথিত ইংরেজি ও হিন্দি প্রীতিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না। পশ্চিমবঙ্গের মোড়ে মোড়ে গজিয়ে ওঠা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলসমূহে শিশুদের দ্বিতীয় ভাষা বাংলা নয়, হিন্দি। তবে আশার দিক হচ্ছে- সেখানেও হিন্দি ভাষার তথাকথিত আগ্রাসন রোধ করে সব জায়গায় বাংলা ব্যবহারের একটি আন্দোলন ক্রমশই দানা বাঁধছে এবং জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও হচ্ছে। বাংলা পক্ষসহ বেশকিছু সংগঠন তৈরি হয়েছে, যারা নিয়মিত হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরব। বাংলা পক্ষপ্রধান অধ্যাপক গর্গ চ্যাটার্জীর কথায়, ‘পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু সাম্রাজ্যবাদ প্রথমেই আগুনে বাঙালিদের ঝলসে দিয়েছিল, তাই সঙ্গে সঙ্গেই সেখানকার বাঙালিরা লাফিয়ে উঠেছিল। কিন্তু এখানে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ আমাদের ফুটন্ত জলে সেদ্ধ করেছে ধীরে ধীরে, যাতে একটা সময়ে আমরা স্থবির, বলহীন হয়ে পড়ি।’ শাশ্বতী নাথের কথায়, যে ষড়যন্ত্র চলছে বাঙালিদের বিরুদ্ধে – কখনও সেটা আসামে এনআরসি-র মাধ্যমে, কখনও হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে, তখন যদি বাঙালিরা নিজেদের জাতিগত পরিচয়, ভাষাগত পরিচয়কে হাতিয়ার করে রুখে দাঁড়াতে না পারে, তাহলে বাঙালিদের জন্য কঠিন সময় আসছে।
মাতৃভাষার সমৃদ্ধির জন্য, যথাযথ বিকাশ-বিস্তৃতির জন্য তার চর্চা ও পরিচর্যার প্রয়োজন। এটাকে বুকের গভীরে লালন করতে হয়। সত্যিকারভাবে ভালোবাসতে হয়। মাতৃভাষার নিয়মিত চর্চা, যথাযথ পরিচর্যা ভাষার সমৃদ্ধি আনে, বিকশিত হয়, যার প্রভাব পড়ে তার সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে। বাংলাদেশের কোনো ভাষানীতি নেই। ভাষানীতি যে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্য একটি প্রয়োজনীয়, সে সম্পর্কে দেশের বুদ্ধিজীবী ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে তেমন কোন পদক্ষেপও। অথচ জাতীয় উন্নয়নে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় নীতির চেয়ে ভাষানীতি কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অর্থনীতি, শিল্পনীতি ও শিক্ষানীতি ইত্যাদি বাস্তবায়নের কারণে যেমন যথাক্রমে দেশের অর্থনীতি, শিল্প-কারখানা ও শিক্ষার উন্নয়ন ঘটে, তেমনিভাবে ভাষানীতি বাস্তবায়নের ফলে সেদেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংশ্রয়ে শৃঙ্খলার উন্নয়ন ঘটে। গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রতিষ্ঠানে বাংলা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা থাকা উচিৎ। কিন্তু বাস্তবে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানসমূহে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার হচ্ছে বেশি। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশের ভাষাসংস্কৃতিতে ধ্বস নামার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার আগ্রাসন মোকাবিলায় একটি ভাষানীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। বাংলা ভাষায় পরিশুদ্ধ ও মানসম্মত টিভি অনুষ্ঠান যেমন প্রয়োজন, তেমনই বাংলা অনুষ্ঠানের প্রতি শিশুদের আগ্রহী করে তুলতে পারিবারিক সচেতনতাও দরকার। ভাষার অধীনে পড়ে না থেকে অনুবাদ প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাওয়া দরকার। অনুবাদ হল একটি দেশের গোপন দূত। অনূদিত বই-পুস্তকের মাধ্যমে আমরা বিদেশকে জানতে পারি, বিদেশ আমাদের চিনতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনূদিত বই দিয়ে নোবেল পুরস্কার মনোনয়ন দেয়া হয়ে থাকে। অথচ এখনও আমারা নিজেদের মধ্যে ইংরেজি প্রীতি পুষে চলি। ফরাসি লেখাপত্র অনুবাদ করার জন্য ইংল্যান্ডে আলাদা ডিপার্টমেন্ট আছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য একাডেমিতে মূল ফ্রেঞ্চ, হিস্পানি, রুশ থেকে অহরহ বই বাংলায় অনুবাদ হচ্ছে। অথচ বাংলা আমাদের পুরো দেশের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আক্রান্ত ঢাকার বাংলা একাডেমি সরকারি আমলা, রাজনীতিবিদ আর বাংলা একাডেমির কর্মকর্তাদের মধ্যে বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মানসিকতা দেখা যাচ্ছে না। এখনও আমাদের দেশে বাংলায় অনূদিত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পাঠ্যবই নেই। বিভিন্ন ভাষা থেকে সাহিত্য অনুবাদ করার জন্য সরকারিভাবে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। আমাদের শিক্ষা, গবেষণা, উন্নয়ন সবকিছুর বৈশ্বিক পরিচিতি ও স্বীকৃতি আদায়ে বিদেশি ভাষার বই-জার্নাল বাংলা ভাষায় বেশি বেশি অনুবাদের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়াও জরুরি। বিদেশী ভাষা হিসেবে কোনো কোনো মহল থেকে আরবির প্রতি নেতিবাচক ইংগিত লক্ষ্য করা যায়। আরবি-ফার্সি শব্দগুলো বিদেশী ভাষা হিসেবে বাংলা থেকে আলাদা করার প্রচেষ্টা এখন তুঙ্গে। বিদেশি ভাষা হলেও আরবি বাংলাদেশে ধর্মীয় ভাষা হিসেবে প্রচলিত। এটি ইংরেজি ভাষার তুলনায় প্রায় আটশ বছর আগে এদেশে ধর্মীয় ভাষা হিসেবে প্রবর্তিত হয়েছে। ধর্মীয় শিক্ষার কাজেই আরবি ভাষা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ফলে আরবি ভাষা বাংলা ভাষার কোনো প্রত্যক্ষ ক্ষতি বয়ে আনছে না। এ ভাষাটি ইংরেজি ভাষার মতো বাংলা ভাষার প্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। কাজেই আরবি ভাষা বাংলাদেশের প্রত্যেক মুসলমান লালন করলেও, এটি বাংলা ভাষা সর্বস্তরে চালুর ক্ষেত্রে কোনোভাবেই অন্তরায় নয়। বরং ঐতিহ্যের খাতিরেই প্রচলিত আরবি-ফার্সি শব্দকে যথাস্থানে প্রয়োগের প্রচলন অব্যাহত রাখা জরুরী।
পরিশেষে বলা যায়, মাতৃভাষার শুদ্ধ ব্যবহার দরকার। দেশের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতির ব্যক্তিত্বরা নিত্যদিন টিভিতে বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহবান জানাচ্ছেন। বাংলার শুদ্ধ উচ্চারণের ওপর গুরুত্বারোপ করছেন। ইংরেজি ভাষার প্রতি কিছু মানুষের অতি উৎসাহের সমালোচনা করছেন। কিন্তু বাংলা ভাষার ওপর হিন্দির আগ্রাসন নিয়ে কেউ কোনো প্রতিবাদ করছেন না। এই আগ্রাসন রুখতেও বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করা দরকার। একুশ এলেই মাতৃভাষা বাংলার জন্য দরদ উথলে পড়ে অথচ হিন্দির আগ্রাসনে দেশের শিশুরা এবং নতুন প্রজন্ম যে বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে সে খেয়াল নেই। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নানা কর্মকৌশল করছেন। শহীদ মিনারের ফুল দেয়া নিয়ে হুড়োহুড়ি করছেন। অথচ আগ্রাসন থেকে মাতৃভাষাকে রক্ষায় উৎসাহী হচ্ছেন না। ব্রিটেনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী এখন বাংলা ভাষী। জাতিসংঘ বাংলা ভাষাকে অনেক আগেই মর্যাদার আসনে বসিয়ে আমাদের মাতৃভাষাকে বিশ্বদরবারে বিশেষ আসনে অলংকৃত করেছে। এখন সময়ের দাবি- বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ বন্ধ করার। এফএম রেডিও, টিভি, কনসার্ট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিশ্র বাংলা পরিহার করে শুদ্ধ ও নির্ভুল বাংলা ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। মানুষ তার স্ব-স্ব কর্মস্থলে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করলে বাংলার সম্প্রসারণ অব্যাহত থাকবে। বাংলাভাষা বাঁচলে স্বাধীনতা বাঁচবে, স্বাধীনতা বাঁচলে বিজয় আসবে। এ বিজয় হবে জনগণের। এ বিজয় হবে খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক; প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।