ব্যারিস্টার কোরবান আলী ১৯৩১ সালে তৎকালীন পাবনা জেলার অন্তর্গত (বর্তমান সিরাজগঞ্জ) শাহজাদপুর থানা অধীন চরকৈজুরী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মোহাম্মদ জুরান উদ্দিন, মাতা লুবাইয়া খাতুন। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তান মাদরাসা বোর্ডের অধীনে সিরাজগঞ্জ হাজী আহমদ আলীয়া মাদরাসা থেকে আলিম পাশ করেন এবং উক্ত মাদরাসায় ১৯৫৪ সালে কামেল ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬০ সালে এলএলবি ডিগ্রি নিয়ে ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারী করার জন্য লন্ডন চলে যান। ১৯৬৪ সালে লন্ডনের লিংকন্স ইন হতে ব্যারিস্টারী ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৪ সালে পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের উচ্চ আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ইসলামী ছাত্র সংঘের সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। লন্ডনে ব্যারিস্টারী পড়ার সময় ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সেখানে অবস্থানকালে উপমহাদেশের মুসলিমদের নিয়ে ইউকে ইসলামী মিশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। দেশে ফেরার আগপর্যন্ত তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
শ্রমিক আন্দোলন
দেশে ফিরে অসহায়, হতদরিদ্র ও অধিকার বঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ কষ্ট দেখে একজন নবীন ব্যারিস্টার তার মানবতাবোধ থেকে শ্রমজীবী মানুষের পাশে দাঁড়াতে বাধ্য হয়ে তিনি ১৯৬৫ সাল থেকে শ্রমজীবী মানুষকে ফ্রি আইনি সহায়তা প্রদান শুরু করেন। তৎকালীন সময় আদমজী, ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ, তেজগাঁও ও টঙ্গী থেকে শ্রমিক দলে দলে আসতে আরম্ভ করে। তাঁর অমায়িক ব্যবহার ও সেবামূলক কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে শ্রমিকগণ তাকে অনুরোধ করেন একটি শ্রমিক ফেডারেশন গঠন করার জন্য। কারণ সরকারি রেজিস্ট্রেশন ব্যতীত শ্রমিকদেরকে সংগঠিত করা যায় না। তাই তিনি ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন গঠন করেন এবং তিনি তার সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এ শ্রমিকবান্ধব নেতা প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তখনকার দিনে একজন ব্যারিস্টার শ্রমিক আন্দোলনের সভাপতি এ কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে শ্রমিকগণ তার নিকট আসতে থাকে এবং শ্রমিক কল্যাণে যোগদান করার অঙ্গীকার করেন। শ্রমিক ময়দানে শ্রমিক কল্যাণের অগ্রগতি এত দ্রুত বাড়তে থাকে যে, তার গতিরোধ করা তৎকালীন কোন শ্রমিক নেতাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এমনকি মালিকেরাও তাদের কাজে আইনে সহায়তা পাবার জন্য ব্যারিস্টার সাহেবের নিকট ধরণা দিতেন। কোন কারখানায় গেলে মালিক ও প্রশাসন তাকে সংবর্ধনা দিতেন ও উন্নত মানের আপ্যায়ন করাতেন এবং তার নিকট আইনি সহযোগিতা কামনা করতেন। তিনি বলতেন আমার সংগঠনে শ্রমিক মালিকদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করাই উদ্দেশ্য তার মাধ্যমে শ্রমিক ও মালিকদের সকল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। আমার আইনি সাহায্য সকলের জন্য উন্মুক্ত, কাউকে আমি অন্যায় ভাবে সাহায্য করতে চাই না। তখন শ্রমিক সংগঠন গুলোর শ্লোগান ছিলো দুনিয়ার মজদুর এক হও, শ্রমিক রাজ কায়েম করো। যা শুনে মালিকগণ ভয় পেতেন।
তার সময় তেজগাঁও শিল্প অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলো শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যেমন: তিব্বত, বিজিএম, নাবিস্ক টেক্সটাইলসহ আরও কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান। টঙ্গীতে শ্রমিক কল্যাণের অন্তর্ভুক্ত ছিল আন্তর্জাতিক শিল্প কারখানা বাটা কোম্পানি, সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি, আশ্রাফ টেক্সটাইল, মুন্নু সিরামিক, ডেমরাতে লতিফ বাওয়ানী জুট মিল ও বিশ্ব বিখ্যাত আদমজীতে ৪০টি ইউনিট ছিল এবং নারায়ণগঞ্জে লক্ষীনারায়ণ জুট মিল ও ড্রেজার ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত। ডেমরার শ্রমিক নেতা ছিলেন বিশিষ্ট জাতীয় রাজনীতিবীদ সাইফুদ্দিন মানিক। শ্রমিক কল্যাণ তাকে নির্বাচনে পরাজিত করে ডেমরা শিল্প এলাকা দখল করে। টঙ্গীতে শ্রমিক নেতা বিশিষ্ট রাজনীতিবীদ ও শ্রমিক নেতা কাজী জাফরকে পরাজিত করে টঙ্গীর গুরুত্বপূর্ণ মিলকারখানা দখল করে শ্রমিক কল্যাণ। তখন পাকিস্তান এয়ার লাইন্স অর্থাৎ PIA এর ইউনিয়ন দখল করে শ্রমিক কল্যাণ ১৯৭০ ও ১৯৭১ সালে। ঢাকার রিকশা ড্রাইভারদের ইউনিয়ন সম্পূর্ণ দখলে ছিল শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের। ঢাকায় ক্লিনার কলোনী অর্থাৎ মেথর পাড়ার শ্রমিক কল্যাণের দখলে ছিলো। যার নেতৃত্ব ছিলো ফেনীর শ্রমিক নেতা শহীদ সফিউল্লাহ।
ব্যারিস্টার সাহেব চলায় ফিরায়, ব্যবহারে শ্রমিকদের সাথে মিশে যেতেন, একাকার হয়ে যেতেন, অল্প সময়ের মধ্যে শ্রমিকদের মন জয় করে ফেলতে পারতেন। তাকে দেখেছি তিনি শ্রমিকদের কাধে হাত রেখে চলতেন, কথা বলতেন, গল্প করতেন, হাসি-ঠাট্টা করতেন, ইসলামের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে থাকতেন। একজন ব্যারিস্টার তাদের এত অন্তরঙ্গ ও নিকটতম হতে পারেন একজন শ্রমিক তা ভাবতেও পারতেন না। তাই সহজেই তারা কোরবান আলী সাহেবের আপন হয়ে যেতেন ঘনিষ্ট বন্ধু হয়ে যেতেন।
শ্রমিকেরাও তাকে ভালবাসতেন অন্তর দিয়ে, আবার তিনি কোন শ্রমিকের বাসায় গেলে, কলোনীতে গেলে তার বিছানায় শুয়ে পড়তে দ্বিধা করতেন না। ব্যারিস্টার সাহেবও তাদেরকে ভালবাসতেন। ব্যারিস্টার সাহেবের বাসা ছিল হাতিরপুল ভূতের গলিতে। তার বাসায় একটি ড্রয়িংরুম। তার প্রশস্ততা ছিল অনেক বড়। ব্যারিস্টার সাহেবের দাওয়াত ছিল ডেমরা, আদমজী ও টঙ্গী থেকে যারা ঢাকায় আসবে তাদের কোন অসুবিধা হলে রাতে আমার বাসায় চলে আসবে। তাই তার বাসায় প্রত্যেক রাত্রে তার মেহমান হতো অসহায় শ্রমজীবী মানুষরা। তিনি তাদের খাবার ব্যবস্থা করতেন। শ্রমিকদেরকে খাওয়াতে পেরে তিনি সুখ অনুভব করতেন। যদি কোন দায়িত্বশীল দায়িত্ব অবহেলা করতো তাহলে তিনি তাদেরকে কঠিন ভাষায় শাসন করতেন। তিনি নিজেও ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী এবং যারা কঠোর পরিশ্রম করতো দায়িত্ব অবহেলা করতেন না তাদেরকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসতেন। শ্রমিকদের যেকোন বিপদে তিনি ঝাঁপিয়ে পরতেন।
তিনি কি রকম গল্প করতেন শ্রমিকদের সাথে তার একটি দৃষ্টান্ত পেশ করছি। একদিন ব্যারিস্টার সাহেবের সাথে আমি রিকশায় চরছি। তিনি রিকশায় উঠে রিকশা চালকের সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। এক পর্যায় জিজ্ঞাসা করলেন তুমি ভাই বিবাহ করেছো? ড্রাইভার জবাব দিল স্যার আমি গরিব মানুষ, বিবাহ করার মতো টাকা পয়সা নেই, তাই এখনও বিবাহ করতে পারিনি। তখন ব্যারিস্টার সাহেব বললেন, ভাই তোমার বাড়ি কোথায়? তিনি বললেন পটুয়াখালী খেপুপাড়া। ব্যারিস্টার সাহেব তখন বললেন ভাই তোমার বাড়ি যদি পাবনা হতো তাহলে আমার মেয়ে তোমার নিকট বিবাহ দিতে পারতাম। রিকশা ড্রাইভারের সাথে বিবাহ না দিলেও একজন ব্যারিস্টার তাকে এমন কথা বলা সত্যিই স্মরণ করিয়ে দেয় রাসুল (সা.) তার গোলাম জায়েদের নিকট তার ফুফাতো বোন যয়নাবকে বিবাহ দেয়। এইতো হচ্ছে বঞ্চিত অবহেলিত মানুষকে ভালবাসার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । তিনি একটি কথা প্রায়ই বলতেন অহেতুক আত্মমর্যাদাবোধ পোষণ করে শ্রমিক আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। প্রত্যেক অসহায় শ্রমজীবী মানুষকে ভালোবাসতে হবে নিজের সন্তানের মতো এবং মূল্যায়ন করতে হবে নিজের চেয়ে অধিক। অর্থাৎ শ্রমিকদেরকে তুচ্ছ মনে করা আর নিজেকে অহংকার হেতু সম্মানিত মনে করা হচ্ছে অহেতুক আত্মমর্যাদাবোধ। আমরা যারা শ্রমিক আন্দোলন করতে চাই ইসলামের বিজয়ের জন্য তারা আমাদের শ্রমিক কল্যাণের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ব্যারিস্টার কোরবান আলীর প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে শ্রমজীবী মানুষের মন জয় করতে হবে। শ্রমিকদেরকে ইসলামী আন্দোলনের কর্মী বানাতে হবে। মহান আল্লাহ তার খেদমতকে কবুল করুন। আমিন।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সভাপতি,বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন