১
চোখ বন্ধ করে মাত্র এক মিনিট একটু ভাবুন। দুর্মূল্যের এই বাজারে আপনার বেতন দৈনিক ১২০ টাকা। মাস শেষে গিয়ে দাঁড়ায় যা তিন হাজার ছয়শত টাকায়। ধরে নেন সংসারে আপনি ছাড়া আর কেউ নেই! তবুও কি এই বেতনে আপনার সংসার চলবে? আশাকরি ভয় ও দুশ্চিন্তায় শরীর আঁতকে উঠবে।
এইবার চোখ খুলুন! আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন তার চারপাশে তাকিয়ে দেখুন তো কত শত অজস্র লোক চা পান করছে আর কতশত মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে যাচ্ছে। সব ছাড়ুন। এইবার আপনি বলুন তো সর্বশেষ কবে চা পান করেননি? আপনি যদি একান্তই নীরস প্রকৃতির না হয়ে থাকেন, তাহলে বলবেন ধুর মিয়া! চা ছাড়া কি এক মুহূর্ত চলা যায়?
চা ছাড়া আমরা চলতে পারি কিনা এই বিতর্ক আগামী দিনের জন্য রেখে দিলাম। যে চায়ের চুমুকেই আমাদের জীবনে প্রাণবন্ত ভাব চলে আসে। সে চায়ের কারিগরদের জীবনে গত দুইশ বছর ধরে চলছে অব্যাহত শোষণ-নিপীড়ন।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে উপমহাদেশের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। তার পর পেরিয়ে গেছে কত শত বছর। এই সময়ে কত নদ-নদী শুকিয়ে খাল হয়ে গেছে। বদলে গেছে পরিবেশ-প্রকৃতি। একদেশ হয়েছে তিন ভাগে বিভক্ত। দেশের নামের সাথে যুক্ত হয়েছে কাগজে-কলমে স্বাধীন-সার্বভৌম। কিন্তু মানুষের জীবনে প্রকৃত স্বাধীনতা এসেছে কিনা, তা প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসের অন্যতম আলোচ্য বিষয়।
আজকের বাংলাদেশ দুই দফায় স্বাধীন হয়েছে। একবার ব্রিটিশদের থেকে ভাগ হয়ে পাকিস্তান হয়েছে। আরেকবার পাকিস্তান থেকে ভাগ হয়ে বাংলাদেশ। প্রতিবারই স্বাধীনতার পেছনে যে কয়টা শব্দ বিশেষভাবে কাজ করেছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো, শোষণ-নিপীড়ন।
এই ভূখণ্ডের অধিকাংশ মানুষ শ্রমজীবী। প্রতিদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে গায়ে-গতরে খেটে দুবেলা দুমুঠো ভাত খেতে পারলে তারা খুশি থাকে। কিন্তু এই স্বল্প চাহিদার মানুষদের সামান্য চাওয়া পাওয়াকে কোনদিন মেনে নিতে পারেনি একশ্রেণির রাজাধিরাজ মালিকরা।
তারা এসব শ্রমিকদের শোষণ-নিপীড়ন করে যন্ত্রের মতো ব্যবহার করেছে এবং এখনো করছে। এসকল মালিকদের একটাই চাওয়া। তারা শ্রমিকের শ্রমে উৎপন্ন পণ্য উচ্চমূল্যে বিক্রি করে আয়েশী জীবন-যাপন করতে চায়। এটি করতে গিয়ে শ্রমিক মরল না বাঁচলো তাতে তাদের কিছু আসে যায় না।
শ্রমিকরা পেটের দায়ে সকল জুলুম নিপীড়ন ও শোষণকে মেনে নিয়েছে। যখন একদমই আর সহ্য করা যায় না তখন তারা প্রতিবাদে ফুসলে ওঠে। নেমে আসে রাজপথে। দাবি-দাওয়া আদায়ে মালিকদের গুন্ডাপান্ডাদের হাতে নির্মম নির্যাতন হতে শুরু করে পুলিশের জলকামানের গরম পানিও সহ্য করে। এসময় জীবন দিতে হয়েছে কতশত শ্রমিককে তার কোন হিসেব কেউ রাখেনি। এখানেই শেষ নয় ন্যায্য দাবি আদায় করতে গিয়ে চাকরিচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ শ্রমিক। মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে কেটেছে অসংখ্য শ্রমিকের দিন-রাত। এরপরও যখন শ্রমিকরা রুটি-রুজির সংগ্রাম চালিয়ে যায় তখন শুরু হয় নানামুখী ভয়-ভীতি ও হুমকি দেওয়া। এসব করে যখন ফল আসে না। তখন মালিকরা ইমোশনাল ব্লাকমেল করে শ্রমিক ও সরকারকে।
শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে মালিকরা নয় দেশের ক্ষতি হচ্ছে। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। এসব ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলে সরকারকে প্রভাবিত করে শ্রমিকদের ওপর চূড়ান্ত শোষণ-নিপীড়ন চালানো হয়। এইভাবে চলছে আমাদের দেশের শ্রম অঙ্গন। শ্রমিক অঙ্গনের প্রতিটি সেক্টরে কিছু দিন পরপর একই দৃশ্য ঘুরে ফিরে দেখা যায়। আজ যা আমরা দেখতে পাচ্ছি চা শ্রমিকদের আন্দোলনে।
৩০০ টাকা দৈনিক মজুরির দাবিতে দেশের ১৬৭টি চা বাগানে ধর্মঘট চলছে। এইবারের ধর্মঘট একটু ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। গণমাধ্যমে ওঠে আসছে চা শ্রমিকদের প্রতি গত দুইশ বছর ধরে চলা শোষণ-নিপীড়নের নির্মম ইতিহাস। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে দেশের মানুষ হতবাক হয়ে যাচ্ছে। আর প্রশ্ন তুলে বলছে, এই দুর্মূল্যের বাজারে ১২০ টাকায় সংসার চলে?
২
ছলচাতুরী ও শোষণ-নিপীড়নের নির্মম ইতিহাস
১৮৩০ সাল। ভারতবর্ষে চলছে ব্রিটিশদের দখলদারিত্ব। চা পাতার ওপর চীনের প্রতি নির্ভরতা কমাতে ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় চা চাষের পরিকল্পনা করে ব্রিটিশরা। আসামে চায়ের একটি জাত আবিষ্কার করার পর তারা এই এলাকায় চা চাষে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠে। চীনের অনুকরণে আসাম ও উত্তর-পূর্ববঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চা বাগান তৈরি করে। বিশেষ করে দার্জিলিং, আসাম ও সিলেটে তারা কয়েকটি চা বাগান প্রতিষ্ঠা করে।
প্রথমে চীন থেকে চা বীজ ও যন্ত্রপাতির পাশাপাশি চীনের একদল বিশেষজ্ঞ ও কর্মী নিয়ে আসে। ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিন বছর পর সেই বাগান থেকে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন করা হয়। এরপর থেকে পাল্লা দিয়ে বাগানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯১০ সালের মধ্যেই সিলেটে ১৫৪টি চা বাগান প্রতিষ্ঠা করে ইউরোপীয়রা। অন্যদিকে ম্যালেরিয়া ও কালাজ¦রে চীনা শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে মৃত্য বরণ করে এবং বাকি শ্রমিকরা মজুরিতে অসন্তুষ্ট হয়ে বাগান ছেড়ে চলে যায়। ফলে সংকটে পড়ে যায় চা চাষ। সংকট মোকাবিলার জন্য দরকার পড়ে অসংখ্য শ্রমিকের। তখনই তারা ছলচাতুরী ও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে।
এ সময় তারা ভারতবর্ষের বিভিন্নস্থান থেকে ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে শ্রমিক সংগ্রহ শুরু করে। বিহার, ওড়িষা, চেন্নাই, নাগপুর, সাঁওতাল পরগনা, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে শ্রমিক সংগ্রহ করা হয়। এরা ছিল অদক্ষ। দক্ষ শ্রমিক সংগ্রহ করতে ব্রিটিশরা নজর দেয় ঢাকা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী ও ত্রিপুরার দিকে। শ্রমিকদের জন্য বাসস্থান ও অন্যান্য সুযোগ-সু্িবধা দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়।
এরপরের ইতিহাস আর সুখকর নয়। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ যেসব শ্রমিকরা এসেছিলেন তারা ছিলেন দুর্ভিক্ষ পীড়িত এলাকার অধিবাসী। তাদেরকে ‘কুলি’ নামে ডাকা হতো। চা বাগানের মালিক ও কর্মকর্তারা তাদের সাথে দাসের মতো আচরণ করা শুরু করে।
শ্রমিক সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি ছিল দাস কেনাবেচার মতো। শুরুর সময় লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে শ্রমিক সংগ্রহ করলেও পরবর্তীতে তারা একদল দালালের মাধ্যমে শ্রমিক সংগ্রহ শুরু করে। দালালরা শ্রমিকদের বিভিন্ন জায়গা থেকে ভয়, অপহরণ, ভুল বুঝিয়ে, অনেক সময় সহিংসতার মাধ্যমে তুলে আনতেন। এরপর এদেরকে প্রথমে জড়ো করা হতো একটি কেন্দ্রে। তারপর সেখান থেকে শ্রমিকদের বাগান মালিকদের নিকট বিক্রি করা দেওয়া হতো এবং বাগানে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। যারা এসব কাজ করতেন তাদের বলা হতো আরকাত্তি।
চা বাগানে কাজ করতে আসা শ্রমিকরা ভেবেছিল তাদের জীবনমান উন্নত হবে। কিন্তু পরক্ষণে তাদের ভাবনা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। বাগানের মালিকরা যেহেতু শ্রমিকদের কিনে নিয়েছেন তাই তারা তাদের সাথে দাসের মতো আচরণ শুরু করে। মালিকরা মনে করতো, শ্রমিকরা তাদের সম্পত্তি। তাদের স্বাধীনতা তারাই নির্ধারণ করবেন। শুরু হয় নির্মম নির্যাতনের নতুন যাত্রা।
শ্রমিকরা বাগানে বন্দি হয়ে পড়ে। এক বাগান থেকে অন্য বাগানে মালিকরা পাহাড়া দিয়ে নিয়ে যেতো। বাগানের বাহিরে শ্রমিকদের যেতে দেওয়া হতো না। অনেকটা কারাগারের মতো শ্রমিকদের জীবন কাটাতে হতো। যার কারণে বংশ পরস্পরায় শ্রমিকদের সন্তানদের চা বাগানে কাজ করতে হতো। যা গত দুই শতাব্দীতে আর পরিবর্তন হয়নি।
বাগানের বন-জঙ্গলে বসবাস করতে গিয়ে শ্রমিকরা এক প্রতিকূল পরিবেশের মুখে পড়ে। নতুন আবহাওয়ার সাথে যুক্ত হয় বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর সাথে লড়াই। বন্যপ্রাণীর আক্রমণে মারা যায় বেশ কিছু শ্রমিক। জঙ্গলে বসবাসের কারণে নানা রোগ দেখা শ্রমিকদের মাঝে। মালিকরা এসব রোগ থেকে বাঁচার জন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এসব থেকে মুক্তি পেতে শ্রমিকরা ফিরে যেতে চায় নিজ জন্মভূমিতে। কিন্তু মালিকরা তাদের যেতে দেয় না। অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৫ ও ১৮৮২ সালে আইন করে বাগান থেকে কোন শ্রমিক পালিয়ে গেলে মালিকরা তাদের বাগানে বন্দি করে রাখতে পারবে এবং তাদের ওপর মারধর করতে পারবে। এই আইনি বৈধতা মালিকদের নির্মম নির্যাতনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। শুরু হয় শ্রমিকদের ওপর সীমাহীন নির্যাতন-নিপীড়ন ও শোষণের অবাধ দ্বার।
ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যখন সারা ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় তখন এই অমানবিক পরিবেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে শ্রমিকরা। ১৯২১ সালের ২০ মে বারো হাজার শ্রমিক জন্মভূমিতে ফেরত যাওয়ার উদ্দেশ্যে সিলেট ও আসামের বিভিন্ন স্থান থেকে এসে চাঁদপুরে জড়ো হয়। চাঁদপুর থেকে স্টিমারে করে গোয়ালন্দ পৌঁছে রেলে করে জন্মভূমিতে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন তারা। কিন্তু তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে তখনকার ইউরোপীয়ান টি এসোসিয়েশন ও স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট। তাড়াহুড়া করে স্টিমারে উঠতে গিয়ে অনেকে পদদলিত হয়ে মারা যায়।
যারা স্টিমারে উঠতে পারেনি তারা আর বাগানে ফিরে না গিয়ে চাঁদপুরে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাদের মধ্যে কলেরা রোগ ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ সরকার কলেরা রোগ ঠেকানোর নাম করে বিদ্রোহ দমনের সুযোগ নেয়। রাতের বেলা গুর্খা সৈন্যরা তাদের ওপর হামলা করে এবং ব্যাপকভাবে গুলি চালায়। সেদিনই সরকারি হিসেবে ৩০০ জন শ্রমিক নিহত হয়।
এই ঘটনার পর চা শ্রমিকরা আর কখনো নিজেদের জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। চা বাগানের মালিকরা অন্য বাগানের শ্রমিকদের এই বার্তা দেয়, মালিকরাই শ্রমিকদের শেষ কথা। তাদের অবাধ্য হওয়া যাবে না। যারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে তাদের পরিণতি এদের মতো হবে।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর সিলেট ও চট্টগ্রামের চা শ্রমিকরা পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যায়। তাদের বংশধররা আজকের বাগানে পূর্বসুরিদের কাজ করে যাচ্ছে।
৩
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চা শ্রমিকদের অবদান
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রায় পঁচিশ বছরের পাকিস্তানীদের শোষণ ও নিপীড়নের জাল ছিন্ন করে বাংলাদেশ রচিত হয়। এই মহান মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম লক্ষ ছিলো অর্থনৈতিক মুক্তি। এই সংগ্রামে চা শ্রমিকরা চা বাগানে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও তাদের খাদ্য সহায়তা দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। মহান স্বাধীনতার পর তারা অন্য সকল নাগরিকদের ন্যায় তারাও এই ভূখÐের নাগরিক হিসেবে মর্যাদা লাভ করে।
দেশে নিবন্ধিত চা বাগান আছে ১৬৭টি। একটি চা বাগান করতে ন্যূনতম ২৫ একর জায়গা প্রয়োজন। তাই যারা ২৫ একর জায়গায় বাগান করতে পারেন না তাদের বাগানকে ফাঁড়ি বলা হয়। এই রকম অনিবন্ধিত ফাঁড়ি আছে বাগানের দিগুণ। এসব বাগান ও ফাঁড়িতে মোট জনগোষ্ঠী ৫ লাখের বেশি। এর মধ্যে চা শ্রমিক আছে ১ লাখ ৪০ হাজার ১৬৪ জন। যার ৬৪ শতাংশ নারী।
চা উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^র নবম। প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে চীন ও ভারত। পাটের পর চা বাংলাদেশে দ্বিতীয় অর্থকরী ফসল। ২০২১ সালে দেশে মোট টা উৎপন্ন হয়েছে ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি। দেশের আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে চায়ের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের বাজারে চা পাতার চাহিদা প্রায় ১০ কোটি কেজি। আমাদের দেশে উৎপন্ন থেকে চাহিদা বেশি। ফলে আমাদেরকে আমদানি করে ঘাটতি পূরণ করতে হয়।
পাটের আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার দুষ্টচক্র দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চায়ের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বাংলাদেশের জন্য আশার আলো। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চায়ের যথেষ্ট কদর রয়েছে। সীমিত সম্পদের এই দেশের অর্থনীতি মজবুত করার জন্য চা ও চা শ্রমিকদের ভূমিকা অপরিসীম। আধুনিক ব্যবস্থাপনা ও চা বাগানের জমির সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন দিগুণ করা সম্ভব। আর এটি সম্ভব হলে আন্তর্জাতিক বাজারে কোটি কোটি কেজি চা রফতানি করা যাবে। যা দেশের অর্থনীতিতে এনে দিবে সমৃদ্ধি।
৪
টেকসই উন্নয়নের জন্য চাই মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্ক
টেকসই উন্নয়নের পূর্বশত মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্ক। আজকের এই চলমান ধর্মঘট মালিক ও শ্রমিকের মাঝে চলে আসা দীর্ঘ দিনের শীতল সম্পর্কের উদাহরণ হয়ে থাকবে। চা উৎপাদনে সমৃদ্ধি আনতে হলে এর শ্রমিকদের গুরুত্ব দিতে হবে। শ্রমিকদের সাথে মালিকের সুসম্পর্ক স্থাপন করতে মৌলিক যেসব বাধা আছে সেগুলো দূর করতে হবে। শ্রমিকদের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, সন্তানদের শিক্ষাসহ মৌলিক অধিকার ও ন্যায্য দাবি মেনে নিতে হবে। কর্মক্ষেত্রে তাদের জন্য সুচিকিৎসা ব্যবস্থা করতে হবে। সময়ের সাথে তালমিলিয়ে সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাধীনভাবে জীবন-যাপনের নিশ্চয়তা দিতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না তারাও মানুষ। তাদেরও মানবাধিকার ও সমৃদ্ধ জীবন-যাপনের অধিকার রয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করা গেলে শ্রমিকদের মন জয় করা সম্ভব হবে।
এক্ষেত্রে সবার আগে মালিকদের এগিয়ে আসতে হবে। শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে মালিকদের পাশাপাশি রাষ্ট্রকে গুরুদায়িত্ব বহন করতে হবে। চলমান বৈশি^ক অর্থনৈতিক সংকট আমাদের দেশকে গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে অসাধু কালোবাজারীদের দৌরত্ব। আজ সকল পেশার মানুষের জীবন খুব দুর্বিষহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে মেহনতি খেটে খাওয়া শ্রমিকদের অবস্থা আরও করুণ। শহরে কাজ করা একজন শ্রমিক অন্তত ৪০০-৫০০ টাকা রোজগারের সুযোগ পেয়েও সংসার চালাতে পারছে না। সেখানে এই যুগে একজন চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি কোনভাবে ১২০ টাকা হতে পারে না। সরকারি হিসেবে প্রতিটি চা শ্রমিকের পরিবারে অন্তত ৫ জন সদস্য আছে। যাদেরকে একজন পরতপক্ষে দুইজনের জনের আয়ের ওপর চলতে হয়। এই আয় দিয়ে এই দুর্মূল্যের বাজারে চলা অসম্ভব।
তাই এই মুহূর্তে দেশের স্বার্থে চা বাগানের মালিকদের উচিত চা শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়া। তাদের পক্ষে ৩০০ টাকা মজুরি দেওয়া অসম্ভব নয়। শ্রমিকরা বাস্তবতা বিবর্জিত কোন দাবি পেশ করেনি। শ্রমিকদের দাবি যত দ্রæত মালিকরা মানবেন ততই তাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে। এই ভরা মৌসুমে বাগানে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার চা পাতা নষ্ট হচ্ছে। এতে দিনশেষে মালিক ও রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শ্রমিকরা মালিকের কিংবা রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে চান না। তারা তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়া আজকের এই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। সুতরাং মালিক ও রাষ্ট্রকে এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। শ্রমিক বাঁচলেই রাষ্ট্র বাঁচবে এই কথা ভুলে গেলে চলবে না।
৫
শোষণের কালোছায়া দূরীভূত করে আসুক সূর্যের স্বাধীনতা
দেশের অধিকাংশ চা বাগান সিলেট বিভাগে। প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক ‘দুটি পাতা একটি কুড়ির’ মোহনীয়তায় মুগ্ধ হতে সিলেট ভ্রমণে আসেন। কিন্তু এই আজকের চলমান আন্দোলন যদি না সংঘটিত হতো তাহলে অনেকেরই জানা হতো না বাগানে কত বিষবাষ্প লুকিয়ে আছে। লুকিয়ে আছে কত কান্না, পাওয়া না পাওয়ার বেদনা, আধুনিক যুগে আদিম অন্ধকারে বসবাস করা একদল মানুষের কথা। যাদের জীবনে স্বাধীনতার সূর্যের উদয় ঘটে না।
যৎ সামান্য রেশন (সপ্তাহে ২ টাকা কেজি দরে ৩ কেজি আটা) ও ঝুপরি ঘর দিয়ে যাদের বুঝ দেওয়া হয় তোমাদের জন্য আমরা কত কিছু করছি। মাদকের নেশায় (বাংলা মদ) বুঁদ করে যাদেরকে অন্য দুনিয়ার বাসিন্দা করে রাখা হয়েছে। নেশার ঘোরে যারা ভুলে যায় মালিকদের সকল শোষণ-নিপীড়নের কথা। ভুলে যান সকল যন্ত্রণা ও বেদনায়ক স্মৃতি।
চা শ্রমিকরা রাজধানী থেকে বহুদূরে বসবাস করে। তাই এই ঢাকা শহরে তাদের জন্য কেউ কণ্ঠ উচ্চকিত করে না। তাই চা শ্রমিকদের ওপর চলা শোষণ-নিপীড়ন আড়ালেই রয়ে গেছে যুগ যুগ ধরে। তাদের এই মানবেতর জীবন আর কাম্য নয়। শোষণের কালোছায়া দূরীভূত হয়ে তাদের জীবনে স্বাধীনতার সূর্য নেমে আসুক। দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে তারা হয়ে উঠুক এই সমাজ-রাষ্ট্রের মূলধারার জনগোষ্ঠী। তাদের সন্তানরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তাদের পিতা-মাতার সকল দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দিক। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
চা শ্রমিকদের আজকের এই সংকট স্থায়ীভাবে দূর করতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তাদের ন্যূনতম মজুরি সুযোগ-সুবিধা আইন দ্বারা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল, শ্রমিক সংগঠন, সুশীল সমাজ ও মালিকদের সম্বনয়ে বাস্তবতার আলোকে একটি সময়োপযোগী মজুরি বোর্ড ও চা শ্রমিকদের কল্যাণ বোর্ড গঠন করতে হবে। আজকের এই সংকট যেন আর গভীর না হয় এবং আমাদের যেন আর লিখতে না হয়, ‘চা বাগানে এখনো সূর্য ওঠেনি।’
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
mahmudashish@yahoo.com