একজন শ্রমিক তার শ্রমের বিনিময়ে কারখানা থেকে বেতন, বোনাস, ওভারটাইম, মজুরী এবং নানাবিধ ভাতাদি পেয়ে থাকেন, যা দিয়ে তিনি জীবন যাপন এবং সংসার পরিচালনা করেন। তাই একজন শ্রমিকের কারখানার প্রতি অবশ্যই করণীয় কিছু নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। যা পালন করার মধ্যেই নিহিত আছে তার নিজের মান মর্যাদা, সম্মান, চাকুরির উন্নতি সর্বোপরি আরও সুন্দর জীবন যাপনের প্রতিশ্রুতি। তাছাড়া হালাল রুজি ইবাদতের পূর্বশর্ত। সঠিক ভাবে ও দায়িত্ব নিয়ে কাজ না করে বা কাজে ফাঁকি দিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করলে, সেই মজুরি কখনোই হালাল হবে না। একজন দায়িত্ববান শ্রমিক কে শ্রম আইনের বিধান মানার পাশাপাশি ইসলাম ইসলাম প্রদত্ত নির্দেশনাও অনুসরণ করা জরুরী। শ্রম আইনের ৩৩১ ধারায় শ্রমিকদেরকে নিম্মলিখিত নির্দেশনা প্রদান করেছে-
কোনো প্রতিষ্ঠানে কোনো শ্রমিক-
(ক) উহাতে শ্রমিকগণের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য গৃহীত কোনো ব্যবস্থার বা স্থাপিত কোনো যন্ত্রপাতির ইচ্ছাকৃতভাবে অপব্যবহার বা উহার ব্যবহারে হস্তক্ষেপ করিবেন না;
(খ) ইচ্ছাকৃতভাবে বা যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতিরেকে এমন কোন কিছু করিবেন না যাহাতে তাহার বা অন্য কোনো ব্যক্তির বিপদ হইতে পারে;
(গ) উহাতে শ্রমিকগণের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য স্থাপিত কোন যন্ত্রপাতি বা ব্যবস্থা ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহারে গাফিলতি করিবেন না।
এছাড়াও একজন দক্ষ বা ভাল শ্রমিকের মাঝে নিম্মোক্ত গুণাবলী থাকা প্রয়োজন-
১. সময়ানুবর্তিতাঃ একজন শ্রমিককে হতে হবে সময় জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। অর্থাৎ তাকে কার্যালয়ে নিয়মানুযায়ী নির্ধারিত সময়ে কারখানায় উপস্থিত হতে হবে এবং কর্ম সময় শেষ হলেই তবে কার্যালয় ত্যাগ করবে। সময়ানুবর্তিতা একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেননা নির্ধারিত সময়ে কারখানায় উপস্থিত না হলে উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাছাড়া অভ্যাসগতভাবে বিলম্বে উপস্থিতি শ্রম আইনের ২৩ এর ৪ ধারার (ঙ) উপধারা মতে অসদাচরণের শামিল। যার ফলে যে কেউ চাকুরী হারাতে পারে। তাই একজন শ্রমিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে যথাযথ সময়ে কর্মস্থলে উপস্থিত থাকা এবং সময়ানুবর্তিতার প্রতি খেয়াল রাখা।
২. আচার আচরণে ভদ্র ও বিনয়ী হওয়াঃ শ্রমিকের আচার আচরণে ভদ্র ও বিনয়ীভাবে থাকতে হবে। সহকর্মীদের সাথে ভালো ব্যবহার করা, দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিদের সম্মান প্রদর্শন করা, অশালীন কথাবার্তা না বলা, কাজে মনোযোগী হওয়া।
৩. শৃঙ্খলা রক্ষা করাঃ যে কোন কাজের জন্য চাই শৃঙ্খলা। শৃঙ্খলাবিহীন কাজে কোনো উৎপাদনই সম্ভব নয়। একজন শ্রমিককে কর্মস্থলে সকল কাজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার জন্য তার ব্যবহৃত টেবিল, চেয়ার, যন্ত্রপাতি, মেশিন ইত্যাদি অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে ব্যবহার করতে হবে এবং কাজ শেষে তা যথাযথভাবে পরিষ্কার এবং গুছিয়ে রাখতে হবে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কার্যাদেশ পালন ও অধঃস্তনকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে হবে। সুশৃঙ্খল হয়ে কাজ করা প্রত্যেক শ্রমিকের কর্তব্য।
৪. পরিস্কার পরিচ্ছন্নতাঃ কাজের স্থান, মেশিনারী, কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য জায়গা (বাথরুম, পানি পানের ব্যবস্থা, টয়লেট, খাবারের জায়গা) সব সময় পরিস্কার রাখতে হবে। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় কফ-থুথু ফেলতে হবে, টয়লেট ব্যবহারের পর পর্যাপ্ত পানি ঢালতে হবে এবং ব্যবহৃত ন্যাপকিন নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলতে হবে। কাজ শেষে যন্ত্রপাতি গুছিয়ে ভালো করে ঢেকে রাখতে হবে এবং যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
৫. উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করাঃ কারখানার ঘোষিত সহনশীল লক্ষ্যমাত্রার একজন শ্রমিকের অবশ্যই একমত প্রকাশ করা উচিত। কারখানার উৎপাদন বৃদ্ধি করাই হলো শ্রমিকের কাজ। যে শ্রমিক যত বেশী উৎপাদন করবে তার দক্ষতা ও যোগ্যতা ততো বেশি প্রমাণিত হবে। আর যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারা মানেই কারখানার উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়া।
৬. দক্ষতা বৃদ্ধি করাঃ একজন শ্রমিক ক্রমাগত নিজেকে দক্ষ ও যোগ্য কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। দক্ষতা বলতে প্রত্যেকের কাজের প্রতি মনোযোগী হওয়া, দ্রুত কাজ সম্পন্ন করা, গুণগত মানের পণ্য তৈরী করা বোঝায়। নির্ভুল এবং বেশি উৎপাদনই হচ্ছে একজন শ্রমিকের দক্ষতা। যে শ্রমিক যত বেশি দক্ষতা অর্জন করবে সে তত দ্রুত একটি কারখানায় বা প্রতিষ্ঠানে তার মান-মর্যাদা, অবস্থান ইত্যাদি বৃদ্ধি করতে পারবে।
৭. বেআইনী ধর্মঘট বা লক-আউটে প্ররোচিত না করাঃ শ্রম আইনের ২৯৫ ধারায় বলা হয়েছে কোনো ব্যক্তি কোনো বেআইনী ধর্মঘট বা লক-আউটে অংশ গ্রহণের জন্য, অথবা উহার জন্য অর্থ খরচ বা সরবরাহের জন্য অথবা অন্য কোনভাবে উহাকে আগাইয়া নেওয়ার জন্য কোনো ব্যক্তিকে প্ররোচিত করিলে, তিনি এক বছর পর্যন্ত কারাদন্ডে, অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে অথবা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হইবেন।
৮. ঢিমে তালের কাজে অংশগ্রহণ বা অংশগ্রহনে প্ররোচিত না করাঃ শ্রম আইনের ২৯৬ ধারায় বলা হয়েছে-কোনো ব্যক্তি কোন ঢিমে তালের কাজে অংশগ্রহণ করিলে অথবা অন্য কোনো ব্যক্তিকে উহাতে অংশগ্রহণের প্ররোচিত বা উৎসাহিত করিলে, অথবা অন্য কোনভাবে উহাকে আগাইয়া নেওয়ার জন্য কোনো কাজ করিলে, তিনি এক বৎসর পর্যন্ত কারাদন্ড, অথবা পাচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে, অথবা উভয় দন্ডে দন্ডণীয় হইবেন।
৯. অরেজিষ্ট্রিকৃত ট্রেড ইউনিয়নের কর্মকান্ডে অংশগ্রহন না করাঃ শ্রম আইনের ২৯৯ ধারায় বলা হয়েছে- কোনো ব্যক্তি অরেজিষ্ট্রিকৃত অথবা রেজিষ্ট্রি বাতিল হইয়াছে এমন কোনো ট্রেড ইউনিয়নের রেজিষ্ট্রেশন প্রাপ্তি সংক্রান্ত কোনো কর্মকান্ড ব্যতীত, অন্য কোন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করিলে অথবা অন্য কোনো ব্যক্তিকে উক্তরূপ কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করিলে, অথবা উক্তরূপ কোন ট্রেড ইউনিয়নের তহবিলের জন্য সদস্য চাঁদা ব্যতীত অন্য কোন চাঁদা আদায় করিলে, তিনি ছয় মাস পর্যন্ত কারাদন্ডে, অথবা দুই হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে, অথবা উভয় দন্ডে দন্ডণীয় হইবেন।
১০. একই সময়ে একদিক ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য না হওয়াঃ শ্রম আইনের ৩০০ ধারায় বলা হয়েছে- কোনো ব্যক্তি একই সময়ে একাধিক ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হইলে বা থাকিলে, তিনি ছয় মাস পর্যন্ত কারাদন্ডে, অথবা দুই হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে, অথবা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হইবেন।
১১. প্রতিষ্ঠানের গোপনীয় তথ্য প্রকাশ না করাঃ শ্রম আইনের ৩৪১ ধারায় বলা হয়েছে-(১) এই আইন অথবা কোন বিধি, প্রবিধান বা স্কীমের অধীন কোনো দায়িত্ব পালনাকলে কোন উৎপাদন বা ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কিত গোপনীয় তথ্য সম্পর্কে কোনো ব্যক্তির লব্ধ জ্ঞান বা প্রাপ্ত তথ্য, এই আইন প্রয়োগ সম্পর্কে ব্যতীত অন্য কোনো ক্ষেত্রে, তাহার চাকুরীকালীন সময়ে অথবা চাকুরী ত্যাগের পরও প্রকাশ করিতে পারিবেন না।
(২)উক্ত গোপনীয় তথ্যের মালিকের লিখিত পূর্ব অনুমতিক্রমে, অথবা এই আইনের অধীন মধ্যস্থতাসহ অন্যকোন আইনগত কার্যক্রমের উদ্দেশ্যে, অথবা তৎসংক্রান্ত কোন ফৌজদারী কার্যক্রমের প্রয়োজনে, অথবা উক্তরূপ কার্যক্রম সম্পর্কে কোন রিপোর্ট প্রদানের জন্য উক্তরূপ গোপনীয় তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে উপ-ধারা (১) এর কিছুই প্রযোজ্য হইবে না।
১২. কতিপয় বিষয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করাঃ শ্রম আইনের ৩৪২ ধারায় বলা হয়েছে- এই আইনের অধীন কোনো রিপোর্ট, সিদ্ধান্ত, রোয়েদাদ অথবা রায়ে কোনো কর্মকর্তা, কর্তৃপক্ষ, সালিস, মধ্যস্থতাকারী, শ্রম আদালত বা ট্রাইবুন্যাল কর্তৃক কোনো ট্রেড ইউনিয়ন সম্পর্কে অথবা কোনো ব্যবসা-বানিজ্যে সম্পর্কে তদন্ত বা অনুসন্ধানকালে প্রাপ্ত এমন কোন তথ্য লিপিবদ্ধ করা যাইবে না যাহা তাহাদের সম্মুখে পেশকৃত সাক্ষ্য ব্যতীত পাওয়া যায় না, যদি সংশ্লিষ্ট ট্রেড ইউনিয়ন বা প্রতিষ্ঠান লিখিতভাবে উক্ত তথ্য গোপনীয় বলিয়া বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করে, অথবা উক্তরূপ কোনো ইউনিয়ন বা প্রতিষ্ঠান লিখিতভাবে উক্ত তথ্য গোপনীয় বলিয়া বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করে, অথবা উক্তরূপ কোন কার্যধারায় উক্তরূপ কোনো তথ্য সংশ্লিষ্ট ট্রেড ইউনিয়নের অথবা প্রতিষ্ঠানের লিখিত সম্মতি ব্যতিরেকে প্রকাশ করা যাইবে না; তবে শর্ত থাকে যে, এই ধারায় কোন কিছুই ফৌজদারী দন্ডবিধির ধারা ১৯৩ এর অধীন কোনো ফৌজদারী কার্যধারার উদ্দেশ্যে উক্তরূপ তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হইবে না।
পরিশেষে বলা যায়, শ্রম আইনে মালিকের যেমন কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য তেমনি শ্রমিকদেরও কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য আছে। মালিক ও শ্রমিক উভয় যদি তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করে, উৎপাদন যেমন বাড়বে তেমনি কারখানায় শৃঙ্খলা, জবাবদিহিতা ও শান্তি বিরাজ করবে। মালিকের দায়িত্ব হচ্ছে শ্রম আইনে যেসব অধিকার শ্রমিকদের দেওয়া আছে সেইসব অধিকার নিশ্চিত করা পাশাপাশি শ্রমিকরা মালিকের প্রতিষ্ঠানকে নিজের প্রতিষ্ঠান মনে করে উৎপাদন বৃদ্ধি, উৎপাদনের গুনগত মান ও সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করা। শ্রমিক ভাইদের একথা মনে রাখতে হবে তারা যে প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে সেই প্রতিষ্ঠানের অর্জিত মুনাফা হতে তাদের মজুরী প্রদান করে। সুতরাং সর্বদা শ্রমিকদের মনে রাখতে হবে, উক্ত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করেছেন। শুধু তাই নয়, উক্ত প্রতিষ্ঠানের মজুরী দিয়ে পরিবার, সংসার ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চলে।
লেখক: কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন