ইসলাম কালজয়ী ও শাশ্বত এক পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থার নাম। ইসলাম মানুষের সাথে সুন্দর আচরণ, মানবিক মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষার পুরো নিশ্চয়তা বিধান করেছে। ইসলাম ন্যায়সঙ্গত শ্রম প্রদান করা ও শ্রমিকের অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। আলাহ তাআলা বলেন, “মানুষ তা পায় যা সে চেষ্টা করে। আর এই যে, তার কর্ম অচিরেই দেখানো হবে। অতঃপর তাকে দেওয়া হবে উত্তম প্রতিদান।”১
ইসলাম শ্রমজীবী মানুষকে মর্যাদার আসনে সমাসীন করে। শ্রমিকদের অধিকারসমূহ নির্ধারণ করেছে। আজ থেকে ১৪০০ বছর পূর্বে আরবে তথা গোটা বিশ্বেই যখন অরাজকতার অন্ধকার বিরাজিত ছিল, তখনই সত্য, ন্যায় ও সাম্যের আলোকবর্তিকা নিয়ে বিশ্বমানবতার পরম সুহৃদ হিসেবে প্রবর্তিত হয়েছিল এই কালজয়ী ইসলাম ও মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ আদর্শ মানব সমাজ গঠনে সক্ষম হয়েছিলেন। যেখানে প্রতিটি মানুষের শুধু নয় বরং প্রতিটি সৃষ্টির অধিকার স্বীকৃত হয়ে আছে। ইসলামে শ্রম ও শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা যথাযথভাবে স্বীকৃত। মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শই শ্রমিকদের একমাত্র মুক্তির পথ। ইবনে মাজাহ হাদিসে এসেছে, রসুল (সা.) ওফাতকালীন সময়ে যে উপদেশ প্রদান করেছেন তা হলো, তোমরা নামাজ এবং অধীনদের ব্যাপারে সাবধান থেকো। এখানে অধীন বলতে কাজের লোক বা শ্রমিক, যারা কারও অধীনে শ্রমের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আঞ্জাম দিয়ে থাকেন। রসুল (সা.) আরও বলেন, “তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে তার অধীনস্থদের নিকট উত্তম।”
শ্রমের পরিচয়:
শ্রম শব্দের আভিধানিক অর্থ মেহনত, দৈহিক খাটুনী, শারীরিক পরিশ্রম ইত্যাদি। অর্থনীতির পরিভাষায়, “পারিশ্রমিকের বিনিময়ে উৎপাদনকার্যে নিয়োজিত মানুষের শারীরিক ও মানসিক সকল প্রকার কর্ম-প্রচেষ্টাকে শ্রম বলে।” অধ্যাপক মার্শাল শ্রমের সংজ্ঞায় বলেন, “Any exertion of mind or of body undergone partly or of wholly with a view to some good other then pleasure derived directly form the work.” অর্থাৎ “মানসিক অথবা শারীরিক যে কোনো প্রকার আংশিক অথবা সম্পূর্ণ পরিশ্রম যা আনন্দ ছাড়া অন্য কোনো ধরনের উপকার সরাসরি পাওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়, তাকে শ্রম বলে।” ইসলামী অর্থনীতির পরিভাষায় শ্রমের পরিচয় বলা যায়, “মানবতার কল্যাণ, নৈতিক উন্নয়ন, সৃষ্টির সেবা ও উৎপাদনে নিয়োজিত সকল কায়িক ও মানসিক শক্তিকে শ্রম বলে।” বাহ্যত এ শ্রম উৎপাদন কার্যে ব্যবহৃত হোক কিংবা পারিশ্রমিক না থাকুক অথবা সে পারিশ্রমিক নগদ অর্থ হউক কিংবা অন্য কিছু এবং শ্রমের পার্থিব মূল্য না থাকলেও পারলৌকিক মূল্য থাকবে।
শ্রমের প্রকারভেদ:
ইসলামে সাধারণত শ্রমকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যথা:
১.শারীরিক শ্রম: শারীরিক শ্রম হলো পুঁজিবিহীন জীবিকা অর্জনের জন্য দৈহিক পরিশ্রম। যেমন: রিক্সাচালক, দিনমজুরদের দৈনন্দিন শ্রম।
২.শৈল্পিক শ্রম: শৈল্পিক শ্রম বলতে যে কাজে শিল্প ও কৌশলবিদ্যাকে অধিক পরিমাণে খাটানো হয়। যেমন- চিত্রশিল্পী, হস্তশিল্প, স্থাপনা ইত্যাদি।
৩.বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম: বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম বলতে ঐ সকল পুঁজিহীন শ্রমকে বুঝায়, যেগুলোতে দেহের চেয়ে মস্তিস্ককে বেশি খাটানো হয়। যেমন- শিক্ষকতা, চিকিৎসক, আইন পেশা ইত্যাদি।
শ্রমিকের পরিচয়:
শ্রমিকের ইংরেজি প্রতিশব্দ Labour আর আরবিতে বলা হয় আমেল। সাধারণ অর্থে যারা পরিশ্রম করে তাদেরকেই শ্রমিক বলা হয়। প্রচলিত অর্থে সমাজে বা রাষ্ট্রে যারা অন্যের অধীনে অর্থের বিনিময়ে পরিশ্রম করে তাদেরকে শ্রমিক বলা হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রত্যেক মানুষকে তার গোলামি করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। আর আল্লাহর বিধান মতো কাজ করার নামই আমল। এক অর্থে প্রতিটি মুসলমান শ্রমিক হিসাবে শ্রম দিয়ে থাকেন। একজন প্রেসিডেন্টও শ্রম দিয়ে থাকেন, আবার একজন দিনমজুরও শ্রম দিয়ে থাকেন, এ অর্থে সবাই শ্রমিক। সাধারণত দৃষ্টিতে শ্রমিক বলতে কারখানায় কায়িক শ্রমে নিয়োজিত কেউ, রিকশা চালক, কুলি-মজুর সহ হাজারো পেশায় নিয়োজিত কোটি কোটি শ্রমিক যারা মূলত কায়িক শ্রমে নিয়োজিত। কিন্তু শ্রম আইনে সবাই শ্রমিক কিনা কিংবা শ্রম আইনের আওতায় সবাই পড়েন কিনা সেটি বিবেচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশের শ্রম আইনের ২(৬৫) ধারায় বলা হয়েছে “শ্রমিক” অর্থ শিক্ষাধীনসহ কোন ব্যক্তি, তাহার চাকুরীর শর্তাবলী প্রকাশ্য বা উহ্য যে ভাবেই থাকুক না কেন, যিনি কোন প্রতিষ্ঠানে বা শিল্পে সরাসরিভাবে বা কোন ঠিকাদার-এর (যে নামেই অভিহিত হউক না কেন) মাধ্যমে মজুরি বা অর্থের বিনিময়ে কোন দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরী, ব্যবসা উন্নয়নমূলক অথবা কেরানীগিরির কাজ করার জন্য নিযুক্ত হন, কিন্তু প্রধানতঃ প্রশাসনিক (তদারকি কর্মকর্তা) বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবেন না।
মালিকের পরিচয়:
অর্থনীতির পরিভাষায়, যারা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানায় কর্মকর্তার অধীনে শ্রমিক-কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন, তারাই শ্রমিক-শ্রমজীবী মানুষ। আর যারা শ্রমিকদের কাজে নিয়োগ করেন, তাদের নিকট থেকে যথাযথভাবে কাজ আদায় করেন এবং শ্রমের বিনিময়ে মজুরি বা বেতন-ভাতা প্রদান করেন, তারাই মালিক।
ইসলামে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক ও আচরণ:
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শ্রমিককে একজন অর্থনৈতিক জীব হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং তার কাছ থেকে বাড়তি উৎপাদনের মাধ্যমে কিভাবে মুনাফার অংক স্ফীত করা যায় সেদিকেই দৃষ্টি থাকে মালিকের। আমাদের শ্রম আইনে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক হচ্ছে প্রভু-ভৃত্তের সমতুল্য। ফলে শ্রমিক-মালিকের পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি সৎ গুণাবলীর সমাবেশ না হয়ে সৃষ্টি হয় পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা। অথচ ইসলাম ভাইয়ের সম্পর্ক উল্লেখ করে মালিক-শ্রমিকের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য উভয়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। ইসলামে মালিক-শ্রমিকের সম্পর্কের ভিত্তি ভ্রাতৃত্বের ওপর রাখা হয়েছে। শ্রমিকদের সাথে সদ্ব্যবহার, তাদের বেতন-ভাতা ও মৌলিক চাহিদা পূরণ ইত্যাদি সম্পর্কে রসুলুল্লাহ (সা.)-এর বাণীসমূহ দ্বারা বৈপ্লবিক ও মানবিক শ্রমনীতির সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়। মালিকদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সে শ্রমিকের শ্রম টাকার বিনিময়ে গ্রহণ করেছে। কিন্তু সে শ্রমিককে কিনে নেয়নি যে, সে ইচ্ছামত শ্রমিক থেকে শ্রম নেবে। এ জন্য সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ইসলাম মালিক ও শ্রমিক পরস্পরের প্রতি কিছু দায়িত্ব অর্পণ করেছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, “সর্বোত্তম শ্রমিক সেই যে শক্তিশালী ও আমানতদার।”২ অপর আয়াতে আল্লাহ্তাআলা বলেন, “আর মনে রাখবে কোনো জিনিস সম্পর্কে কখনো একথা বলবে না যে, আমি কাল এ কাজ করব।”৩ মালিক ও শ্রমিকের প্রতি আল্লাহ্ নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, “ওয়াদা পূর্ণ কর! ওয়াদা সম্পর্কে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।”৪ নবী (সা.) বলেন, “যার মধ্যে আমানতদারী নেই তার ঈমান নেই।” মালিকের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করা, অপচয় না করা, আত্মসাৎ না করা, সঠিক হিসাব পেশ করা একজন শ্রমিকের দায়িত্ব। এ প্রসঙ্গে রসুল (সা.) বলেন, “কাউকে কোন ব্যাপারে দায়িত্ব প্রদান করা হলে সে তার নিজের কাজ যত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন করে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব তদ্রুপ না করলে কিয়ামতের দিন তাকে উল্টা করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” তিনি আরও বলেন, “কারো উপর কোন দায়িত্ব অর্পিত হলে সে যদি এক টুকরো সুতা বা তার চেয়েও কোন ক্ষুদ্র জিনিস খেয়ানত করে তবে কেয়ামতের দিন খেয়ানতের বোঝা মাথায় করে সে উত্থিত হবে।” আল্লাহ বলেন, “এদেরকে বেদনাদায়ক শাস্তি প্রদান করা হবে যারা তাৎফিক অর্থাৎ মাপে কম-বেশ করে। নিজের হক নেওয়ার সময় পুরোপুরি আদায় করে নেয় কিন্তু অন্যকে মেপে দিতে গেলেই কম দেয়।”৫ তাৎফিক অর্থে ঐ সমস্ত মজদুরকেও বলে যারা নির্ধারিত পারিশ্রমিক পুরোপুরি উসুল করেও কাজে গাফেলতি করে। রসুলুল্লাহ্ (সা.)-এর আদর্শে মালিক-শ্রমিকের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তারা সকলেই আল্লাহ তাআলার বান্দা ও পরস্পর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। এ সম্পর্কে রসুলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, “তোমাদের অধীন ব্যক্তিরা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ্ যে ভাইকে যে ভাইয়ের অধীন করে দিয়েছেন, তাকে তাই খাওয়াতে হবে, যা সে নিজে খায় এবং তাকে তাই পরতে দিতে হবে যা সে নিজে পরিধান করে।”৬
রসুলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, “শক্তি সামর্থ্যরে অতিরিক্ত কাজ শ্রমিকদের উপর চাপাবে না। যদি তার সামর্থ্যরে অতিরিক্ত কোনো কাজ তাকে দাও তাহলে সে কাজে তাকে সাহায্য কর।”৭ মালিক ও ব্যবস্থাপনা কর্মচারীদের কর্তব্য হলো শ্রমিকদের সাথে মিলেমিশে থাকা, কথাবার্তা, উঠা-বসার ক্ষেত্রে ইসলামী ভ্রাতৃত্বসুলভ ব্যবহার ও আচার-আচরণ অবলম্বন করা, মৃত্যু, রোগ-শোক ও অন্যান্য ঘটনা-দুর্ঘটনাকালে নিজেরা উপস্থিত থেকে সহানুভূতি ও সহৃদয় আচরণ গ্রহণ করা।
বর্তমানে মালিকের প্রতি শ্রমিক পোষণ করে ঘৃণা ও বিদ্বেষ এবং শ্রমিকের প্রতি মালিক পোষণ করে সন্দেহ ও অবিশ্বাস। ইসলামের উপর উভয়ে প্রতিষ্ঠিত না থাকায় আজকের এই পরিণতি। অথচ ইসলাম উভয়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কের কথা বলেছিল। একজন শ্রমিক তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে শুধু ন্যায্য পারিশ্রমিকই নয় বরং সাথে সাথে লাভ করতে পারতো আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতের সুসংবাদ। রাসুল (সা.) বলেন, “তিন শ্রেণীর লোকদের দ্বিগুণ সওয়াব দেওয়া হবে। তাদের একজন, যে নিজের মালিকের হক আদায় করে এবং সঙ্গে আল্লাহর হকও।” তিনি আরও বলেন, “যে অধীনস্থ খাদেম আল্লাহ ও তার মালিকের অনুগত থেকে দায়িত্ব পালন করে তাকে মালিকের সত্তর বছর পূর্বে বেহেশ্তে প্রবেশ করানো হবে।”
ইসলামে সকল পেশাই মর্যাদাপূর্ণ:
মহানবী (সা.)-এর আগমনের পর মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষের পরিবর্তে এক সৌভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। বৈষম্যের সকল দেয়াল ভেঙে দিয়ে তিনি ঘোষণা করেন ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, মালিক-শ্রমিক, আরব-অনারব সকলেই সমান ও পরস্পরের ভাই। সর্বপ্রকার জুলুমের তিনি অবসান ঘটান। তিনি আরও বলেন, “যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্যরা নিরাপদ নয় সে মুমিন নয়।” ইসলামে কোন কাজকেই ঘৃণা করেনি। শ্রমের বিনিময়ে উপার্জনকে মহানবী শ্রেষ্ঠতম উপার্জন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, “শ্রমজীবীর উপার্জনই শ্রেষ্ঠতর যদি সে সৎ উপার্জনশীল হয়।” তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, “কোন ধরনের উপার্জন শ্রেষ্ঠতর? তিনি জবাব দিলেন, নিজের শ্রমলব্ধ উপার্জন।” ইসলাম সকল বৈধ পেশাকে উৎসাহিত করে এবং সকল পেশার মানুষকে সমান সম্মান করে। সম্পদ, বংশ ও পেশার কারণে মানুষের মর্যাদা নিরূপিত হয় না। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা নিরূপিত হয় নৈতিকতা, নিষ্ঠা ও তাক্বওয়ার ভিত্তিতে ।৮ কাজেই যে কোন পেশার লোক সম্মানের পাত্র। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তোমাদের কারোর নিজ পিঠে কাঠের বোঝা বয়ে এনে বিক্রি করা কারো কাছে হাত পাতার চেয়ে উত্তম। তাকে (প্রার্থীকে) সে কিছু দিক বা না দিক।”৯ ভিক্ষার প্রতি নিরুৎসাহিত করে ভিক্ষার হাতগুলোকে শ্রমিকের হাতে রূপান্তর করেছেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি আমার সঙ্গে ওয়াদাবদ্ধ হবে যে সে কখনো ভিক্ষা করবে না, তার জান্নাতের ব্যাপারে আমি দায়িত্ব গ্রহণ করব।”১০ উপার্জনের জন্য শ্রমে লিপ্ত থাকাকে তিনি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ বলে উল্লেখ করেছেন। এক লোক রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ দিয়ে গমন করলে সাহাবায়ে কেরাম লোকটির শক্তি, স্বাস্থ্য ও উদ্দীপনা দেখে বলতে লাগলেন, এই লোকটি যদি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে থাকত! রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, “লোকটি যদি তার ছোট ছোট সন্তান অথবা তার বৃদ্ধ মাতা-পিতার জন্য উপার্জন কিংবা নিজেকে পরনির্ভরতা থেকে মুক্ত রাখতে উপার্জনের চেষ্টায় বেরিয়ে থাকে, তাহলে সে আল্লাহর পথেই রয়েছে।”১১ শ্রমিকের জন্য ক্ষমাপ্রাপ্তির ঘোষণাও করেছেন তিনি। একটি হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি শ্রমজনিত কারণে ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যা যাপন করে, সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়েই তার সন্ধ্যা অতিবাহিত করে।” মানুষের প্রয়োজনীয় কোনো কাজই তুচ্ছ নয়। মুচি জুতা সেলাই করেন, নাপিত চুল কাটেন, দরজি কাপড় সেলাই করেন, ধোপা কাপড় পরিষ্কার করেন, জেলে মাছ ধরেন, ফেরিওয়ালা জিনিসপত্র বিক্রি করেন, তাঁতী কাপড় বুনেন, কুমার পাতিল বানান, নৌকার মাঝি মানুষ পারাপার করেন। এসব কাজ এতই জরুরি যে, কাউকে না কাউকে অবশ্যই কাজগুলো করতে হবে। কেউ যদি এসব কাজ করতে এগিয়ে না আসতেন, তা হলে মানবজীবন অচল হয়ে পড়ত। কোনো কাজই নগণ্য নয় এবং যারা এসব কাজ করেন, তারাও হীন বা ঘৃণ্য নন। ইসলামী আদর্শের কাছে মনিব-গোলাম, বড়-ছোট, আমীর-গরিব সবাই সমান। ইসলামী সমাজে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সমাজপতি, শিল্পপতি, রাজনীতিবিদের আলাদাভাবে মর্যাদার একক অধিকারী হওয়ার সুযোগ নেই। অধীনস্তরা ও ইনসাফের দাবি করার অধিকার রাখে। একমাত্র ইসলামই শ্রমিকদের সর্বাধিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার কথা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছে। পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্ম, অন্য কোনো মানব রচিত মতবাদ বা আদর্শ ইসলামের মতো শ্রমিকদের অধিকার দিতে পারে না। ইসলামের দাবিী অনুযায়ী, গোলামের সাথে ভালো আচরণ করতে হবে এবং তাদের কোনো প্রকার কষ্ট দেওয়া যাবে না।
শ্রমিকদের সাথে আচরণ:
‘মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব। তার প্রধান দুটিসত্তা রয়েছে , একটি বাহ্যিক ও অন্যটি অন্তর্গত। শিক্ষা, জ্ঞানার্জন, পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সে তার এই দুটি সত্তার উম্মেষ ঘটিয়ে থাকে। এ দুটি একটি অপরটির পরিপূরক হলেও অন্তর্গত সত্তাটি সমাজের মানুষের ভালমন্দ পরিচয় নির্ভর করে প্রধানত তার বাহ্যিক সত্তার ওপর। আর এই বাহ্যিক স্তরটি প্রকাশিত হয় অন্যের প্রতি তার আচরণ ও সৌজন্য প্রকাশের মাধ্যমে। কথায় আছ, “Courtesy pays a lot. but costs nothing.” সাধারণত মানুষ তার কার্যাবলি সম্পাদনের সময় যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করে তাকেই আমরা আচরণ বলে থাকি। অর্থাৎ কাজের দ্বারা মানুষের আচরণ প্রকাশ পায়। তাই বলা যায় “Behavior is a way of action.” অর্থাৎ আচরণ হলো কার্যের একটি পন্থা বা উপায়। মানুষ মনে মনে যা চিন্তা করে এবং যেসব কাজের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয় তাকেই আচরণ বলা চলে। প্রকৃতপক্ষে মানুষের ভাল-মন্দ পরিচয় নির্ভর করে সুন্দর আচরণের উপর। শ্রমিকদের সাথে সুন্দর আচরণের মাধ্যমে কাজের ভাল পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব। ইসলাম সাধ্যানুযায়ী ও রুচি অনুযায়ী কাজ করার জন্য মানুষকে জন্মগত অধিকার দিয়েছে।
হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “অধীনস্তদের সাথে দুর্ব্যবহারকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।”১২ রসুলুল্লাহ্ (সা.) মালিকদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, তারা যেন কর্মচারী, শ্রমিক ও অধীনদের সাথে সন্তান-সন্তুতির ন্যায় আচরণ করে এবং তাদের মান-সম্মানের কথা স্মরণ রাখে। রসুলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, “তাদের এভাবে সম্মান করবে যেভাবে নিজের সন্তানদের কারো এবং তাদেরকে সে খাবার দিবে যা তোমারা নিজেরা খাও।”১৩ নবী (সা.) আরও বলেন, “তোমরা অধীনস্থদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে এবং তাদেরকে কোন কষ্ট দিবে না। তোমরা কি জান না, তোমাদের ন্যায় তাদেরও একটি হৃদয় আছে। ব্যথা দানে তারা দুঃখিত হয় এবং কষ্ট বোধ করে। আরাম ও শান্তি প্রদান করলে সন্তুষ্ট হয়। তোমাদের কি হয়েছে যে তোমরা তাদের প্রতি আন্তরিকতা প্রদর্শন কর না।”
রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, “তোমাদের চাকর-চাকরানি ও দাস-দাসীরা প্রকৃতপক্ষে তোমাদের ভাই। তাদের আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং আল্লাহ যার ভাইকে তার অধীন করে দিয়েছেন, সে তার ভাইকে যেন তাই খাওয়ায় যা সে নিজে খায়, তাকে পরিধান করায় যা সে নিজে পরিধান করে। আর তার সাধ্যের বাইরে কোনো কাজ যেন তার ওপর না চাপায়। একান্ত যদি চাপানো হয়, তবে তা সমাধান করার ব্যাপারে তাকে সাহায্য করা উচিত।”১৪ পবিত্র কুরআনে এরশাদ হচ্ছে, “আমি তোমার উপর কোনোরূপ কঠোরতা করতে চাই না, কোনো কঠিন ও দুঃসাধ্য কাজ তোমার ওপর চাপাতেও চাই না, আল্লাহ চাহে তো তুমি আমাকে সদাচারী হিসেবেই দেখতে পাবে।”১৫
সু-আচরণ সম্পর্কে জনৈক ফ্রায়া স্টার্ক বলেন, “সু- আচার আচরণ অঙ্কশাস্ত্রের শুন্যের মতো, আপাতদৃষ্টিতে এর গুরুত্ব ততোটা বোঝা যায় না, কিন্তু সবকিছুর সাথে এর সংমিশ্রণ বিরাট মূল্য পরিবর্ধন করে।” বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী Kewin Lewin মানুষের আচরণ সম্পর্কে একটি তত্ত্ব প্রচার করেছেন। তাঁর নাম অনুসারে তত্ত্বটি K. Lewin মডেল নামে পরিচিত। তিনি এখানে ব্যক্তির আচরণকে ব্যক্তির কার্যকলাপের প্রতিফলন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মূলত মানুষের আচরণ তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হয়। ব্যক্তি তার পরিবেশের সাথে সঙ্গতি রেখে তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য কার্য সম্পাদনে প্রবৃত্ত হয় যা তার আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ লাভ করে। ক. খবরিহ একটি গাণিতিক ফাংশনের মাধ্যমে তার মডেলটি উপস্থাপন করেছেন। মডেলটি – B=F (P*E)। যেখানে, B= Behavior, F= Function, P= Person, E= Environment
মহানবী (সা.) শ্রমজীবি মানুষের মুক্তির জন্য এক ঐতিহাসিক ভাষণে যে অনুপম শ্রমনীতি দিয়ে গেছেন- “হে মানবজাতি, আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি যে, গোলামদের সাথে ভাল আচরণ করবে এবং তাদের কোন কষ্ট দিবে না। তোমরা কি জান না, তাদের একটি অন্তর আছে যা কষ্ট পেলে ব্যাথা পায় এবং আরাম পেলে আনন্দিত হয়। তোমাদের কি হয়েছে? তোমরা তাদেরকে হীন মনে কর এবং তাদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর না! এটা কি জাহিলিয়াতের যুগের মানসিকতা নয়। অবশ্যই এটা জুলুম এবং বে-ইনসাফি।”
শ্রমের গুরুত্ব:
শ্রমের গুরুত্ব সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক বিষয়। আর তা হলো, মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত নবী-রসুলগণের প্রায় সবাই প্রত্যক্ষভাবে এই শ্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। মুসনাদে আহমাদ শরিফের মতে, সব নবী-রসুলই মেষ চড়িয়েছেন; এমনকি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেও মেষ চড়াতেন। “আমিই দুনিয়ার জীবনে তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বণ্টন করে দেই এবং তাদের একজনকে অপর জনের উপর মর্যাদায় উন্নীত করি যাতে একে অপরকে অধীনস্থ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে।”১৬ প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহ তাআলা মানুষকে একে অপরের উপর মর্যাদা, বুদ্ধি-জ্ঞানে উন্নীত করে মানুষের মাঝে এই পার্থক্য ও তফাৎ এই জন্য রেখেছেন যে, যাতে বেশী মালের অধিকারী ব্যক্তি স্বল্প মালের অধিকারী ব্যক্তির কাছ থেকে, উচ্চ পদের মালিক তার চাইতে নিম্ন পদের মালিকের কাছ থেকে এবং অনেক বেশি জ্ঞান-বুদ্ধির মালিক তার চাইতে কম জ্ঞান-বুদ্ধির মালিকের কাছ থেকে কাজ নিতে পারে। মহান আল্লাহর পরিপূর্ণ এই কৌশলের মাধ্যমে বিশ্বজাহানের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে। অন্যথা সকলেই যদি ধন-মালে, মান-সম্মানে, জ্ঞান-গরিমায় এবং বুদ্ধি-বিবেচনা ও অন্যান্য পার্থিব উপায়-উপকরণে সমান হত, তবে কেউ কারো কাজ করার জন্য প্রস্তুত হত না। মানবিক সমস্ত প্রয়োজন পূরণ ও ভারসম্যের কারনে মালিক-শ্রমিক শ্রেণি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিক শ্রেণি না থাকলে ছোট মানের ও তুচ্ছ মনে করা হয় এমন কাজও কেউ করত না। মহান আল্লাহ প্রত্যেককে পার্থক্য ও তফাতের মাঝে রেখেছেন এবং যার কারণে প্রত্যেক মানুষ অপর মানুষের মুখাপেক্ষী হয়।
রসুল (সা.) বলেছেন, “যে কোন মজুরকে খাটিয়ে নিজের পুরোপুরি কাজ আদায় করে নেয় কিন্তু তার মজুরী দেয় না কিয়ামতের দিন আমি তার দুশমন হব। আর আমি যার দুশমন হব তাকে আমি লাঞ্ছিত ও বিপদগ্রস্ত করেই ছাড়বো।” মালিককে সাবধান করে দিয়েছেন এই বলে, “তোমরা প্রত্যেকেই এক একজন দায়িত্বশীল। আর প্রত্যেকেই তার অধীনস্থ ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” ইসলাম মালিকদেরকে শ্রমিকের সমস্যা বিবেচনার ক্ষেত্রে তাদেরকে আল্লাহর বান্দাহ, প্রতিনিধি ও বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করতে বলে। হযরত (সা.) বলেন, “মজুর-চাকরদের অসংখ্যবার ক্ষমা করা মহত্বের লক্ষণ। তাদের অপরাধ প্রত্যেক দিন সত্তর বার হলেও ক্ষমা করে দিও।” শ্রমিকদের প্রতি মালিকের দায়িত্ব প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, “তোমাদের কোন ভৃত্য তোমাদের জন্য যখন খাদ্য প্রস্তুত করে নিয়ে আসে, তখন তাকে হাতে ধরে খেতে বসাও। সে যদি অস্বীকার করে তবে দুএক মুঠো খাদ্য তাকে অবশ্যই দিবে।”
মানুষের উন্নতির চাবিকাঠি হলো শ্রম। যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী, সে জাতি তত বেশি উন্নত। সব ধরনের শ্রমিককেই মর্যাদা দিতে হবে। একজন দিনমজুরের শ্রম, কৃষকের শ্রম, শিক্ষকের শ্রম, অফিসারের শ্রম, ব্যবসায়ীর শ্রম সবই সমান মর্যাদার অধিকারী। শ্রমের মর্যাদা সমাজের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে। শ্রমের ব্যাপারে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, “অতঃপর যখন নামায শেষ হবে, তখন তোমরা জমিনের বুকে ছড়িয়ে পড় এবং রিযিক অন্বেষণ কর।”১৭ ইসলামে শ্রমের মর্যাদা অত্যাধিক। শ্রম দ্বারা অর্জিত খাদ্যকে ইসলাম সর্বোৎকৃষ্ট খাদ্য হিসেবে আখ্যা দিয়েছে এবং জীবিকা অন্বেষণকে উত্তম ইবাদত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, “ফরজ ইবাদতের পর হালাল রুজি অর্জন করা একটি ফরজ ইবাদত।”১৮ এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “তিনি তোমাদের জন্য ভূমি সুগম করে দিয়েছেন। কাজেই তোমরা এর দিক-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তার দেয়া রিজিক থেকে আহার কর।”১৯ শ্রম ও শ্রমিকের ব্যাপারে মহানবীর (সা.) সবচেয়ে তাৎপর্যমণ্ডিত ঘোষণাটি হলো, “আল কাসিবু হাবিবুল্লাহ অর্থাৎ শ্রমিক হচ্ছে মহান আল্লাহর বন্ধু।” পবিত্র কোরআনে মানুষকে চিত্রিত করা হয়েছে শ্রমের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য দিয়ে। ইরশাদ হচ্ছে- “লাকাদ খালাকনাল ইনসানা ফি কাবাদ” অর্থাৎ “সুনিশ্চিতভাবে মানুষকে আমি শ্রমনির্ভররূপে সৃষ্টি করেছি।”২০
কুরআন-হাদিস, ইসলামের ইতিহাস পড়লে জানা যায়, নবী-রসুলগণ শ্রমিকদের কত মর্যাদা দিয়েছেন। ইসলামের সব নবী ছাগল চরিয়ে নিজে শ্রমিক হয়ে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছেন। মালিক হযরত শোয়াইব (আ.) তাঁর মেয়ের বিয়ে দিয়ে শ্রমিক নবী মুসাকে (আ.) জামাই বানিয়েছেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) শ্রমিক যায়েদ (রা.)-এর কাছে আপন ফুফাতো বোন জয়নবের বিয়ে দিয়েছিলেন। বিশ্বনবী (সা.) যায়েদকে (রা.) মুতারের যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ইসলামের প্রথম মোয়াজ্জিন বানানো হয়েছিল শ্রমিক হযরত বিলালকে (রা.)। মক্কা বিজয় করে কাবা ঘরে প্রথম প্রবেশের সময় মহানবী (সা.) শ্রমিক বেলাল (রা.) ও শ্রমিক খাব্বাবকে (রা.) সাথে রেখে ছিলেন। নবীজী কখনো নিজ খাদেম আনাসকে (রা.) ধমক দেননি এবং কখনো কোনো প্রকার কটুবাক্য ও কৈফিয়ত তলব করেননি।
রসুল (সা.) বলেছেন, “তোমাদের অধীন ব্যক্তিরা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তায়ালা যে ভাইকে তোমার অধীন করে দিয়েছেন তাকে তা-ই খেতে দাও, যা তুমি নিজে খাও, তাকে তা-ই পরিধান করতে দাও, যা তুমি নিজে পরিধান কর।”২১ হযরত আবুবকর (রা.) বলেন, রসুল (সা.) বলেছেন, “ক্ষমতার বলে অধীন চাকর-চাকরানী বা দাস-দাসীর প্রতি মন্দ আচরণকারী বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।”২২ তিনি আরও বলেন, “কেউ তার অধীন ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে এক দোররা মারলেও কেয়ামতের দিন তার থেকে এর বদলা নেওয়া হবে।”
শ্রমিকের দায়িত্ব চুক্তি মোতাবেক মালিকের প্রদত্ত কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে সম্পাদন করা। ইরশাদ হচ্ছে, “শ্রমিক হিসাবে সেই ব্যক্তি ভাল, যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত।”২৩ শ্রমিক তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে আঞ্জাম দিবে এটা তার কর্তব্য। আর এ কর্তব্য সুচারুভাবে পালন করলে তার জন্য দ্বিগুণ পুণ্যের কথা রসুল (সা.) বলেছেন, “তিন শ্রেণির লোকের দ্বিগুণ সওয়াব প্রদান করা হবে। তাদের মধ্যে এক শ্রেণি হলো যে নিজের মালিকের হক আদায় করে এবং আল্লাহর হকও আদায় করে।” কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, হে মানব জাতি, তোমরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী; কিন্তু আল্লাহ, তিনি অভাবমুক্ত ও প্রশংসিত।২৪
শ্রমিকের অধিকার:
ইসলাম শ্রমিকদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রর্দশন করে। শ্রমিককে কষ্ট দেওয়া জাহেলিয়াতের যুগের মানসিকতা মনে করে। এ ব্যাপারে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, “তোমাদের কেউ যেন আমার দাস, আমার দাসী, না বলে। কেননা আমরা সবাই আল্লাহর দাস-দাসী।” ওমর ইবনে হুরাইস (রা.) হতে বর্ণিত নবী করিম (সা.) বলেছেন, “তোমরা তোমাদের কর্মচারীদের থেকে যতটা হালকা কাজ নিবে তোমাদের আমলনামায় ততটা পুরস্কার ও নেকী লেখা হবে।
শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়ে তিল তিল করে গড়ে উঠে শিল্প প্রতিষ্ঠান। একটি শিল্পের মালিক শ্রমিকদের শ্রম শোষণ করে অল্প সময়েই পাহাড় পরিমাণ অর্থ-বিত্তের মালিক হয়। শ্রমিকদের কম মজুরি দিয়ে, তাদের ঠকিয়ে গড়ে তোলে একাধিক শিল্প-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কারখানায় তাদের কোনো অংশীদারিত্ব থাকে না। শ্রমিকের আরেকটি প্রণিধানযোগ্য অধিকার হলো লভ্যাংশের ভিত্তিতে অংশীদারিত্ব লাভ করা। এ ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন, “মজুরকে তার কাজ হতে অংশ দান কর, কারণ আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যায় না।”২৫
শ্রমিকের পেশা পরিবর্তন বা কর্মস্থল পরিবর্তনে অধিকার থাকবে। এতে কারও ইচ্ছায় হস্তক্ষেপ করে স্বাধীন সত্তায় বাধা প্রদান উচিত নয়। সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের ব্যক্তিত্বকে এমনভাবে ক্ষুন্ন করা হয়েছে যে, শ্রমিককে তার এই মানবিক স্বাধীনতা হতে বঞ্চিত করা হয়েছে। এ ব্যবস্থায় শ্রমিক ইচ্ছামত কাজ নির্বাচন করে নিতে বা এক স্থান হতে অন্য স্থানে গমন করতে পারে না।
শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো যথাযথ মজুরিপ্রাপ্তি। মাসের পর মাস চলে যায় শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি পায় না। মালিকগোষ্ঠী বরাবরই বিভিন্ন অজুহাতে শ্রমিকদের টাকা আত্মসাৎ করে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। প্রাপ্য মজুরির দাবিতে শ্রমিককে মালিকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হয়। ইসলামের ঘোষণা হলো, যারা শ্রমিকের পাওনা দিতে টালবাহানা করবে, হাশরের ময়দানে আল্লাহ নিজেই তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আমি কেয়ামতের দিন তিন শ্রেণির মানুষের প্রতিপক্ষ। আর আমি যার প্রতিপক্ষ, তাকে পরাজিত করবই। তন্মধ্যে এক শ্রেণি হলো, যে কোনো শ্রমিক নিয়োগ করে, অতঃপর তার থেকে পুরো কাজ আদায় করে নেয় কিন্তু তার পারিশ্রমিক প্রদান করে না।”২৬ শ্রমিকের পাওনা যথাসময়ে পরিশোধের ব্যাপারে মহানবী (সা.) কঠোর হুঁশিয়ারি প্রদান করেছেন। অনতিবিলম্বে মজুরি প্রদান করার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন সবচেয়ে আন্তরিক। মজুরির প্রশ্নে মানবসভ্যতার ইতিহাসে শীর্ষে অবস্থান করছে তাঁর বাণী। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দাও।”২৭ শ্রমজীবী মানুষ বা কোনো শ্রমিক অবসর নেওয়ার পর তার বাকি জীবন চলার জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা বা পেনশনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এ ব্যাপারেও ইসলাম নীরব নয়। হযরত ওমর (রা.) বলেছেন, “যৌবনকালে যে ব্যক্তি শ্রম দিয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের খেদমত করেছেন বৃদ্ধকালে সরকার তার হাতে ভিক্ষার ঝুলি তুলে দিতে পারে না।”
১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেটে অধিকার বঞ্চিত শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজসহ বিভিন্ন দাবিতে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করে। বিক্ষোভ সমাবেশে অনেক নিরীহ শ্রমিক পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। শ্রমজীবী মানুষের আপসহীন মনোভাব ও আত্মত্যাগের ফলে ৮ ঘণ্টা কাজের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১ মে শ্রমিক আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হাদিস, শ্রমিকদের সাধ্যের অতীত কাজে কখনো খাটাবে না এ নির্দেশনামূলক কথাটির কিছু অংশ হলেও ১ মে এর আন্দোলনে প্রতিফলিত হয়। অথচ মহানবী (সা.) একজন শ্রমিককে তার শ্রমের মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদান করতে গিয়ে তাকে আল্লাহর বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। রাসুলের (সা.) অপর তাগিদটি হলো শ্রমিকের প্রাপ্যতা নিয়ে। মহানবীর (সা.)-এর বাণীতে শ্রম ও শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদার বিষয়টি অভূতপূর্ব স্বীকৃতি পেয়েছে। এ বাণীর আলোকে যদি বিশ্ব শ্রম ব্যবস্থা প্রবর্তিত হতো, তাহলে ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে শ্রমিক ও শ্রম-ইতিহাসের মর্মান্তিক ঘটনার সৃষ্টি হতো না।
নবী-রসুল ও সাহাবীদের শ্রমের দৃষ্টান্ত:
বিশ্বমানবতার শ্রেষ্ঠ সুহৃদ মুহাম্মদ (সা.) নিজেকে শ্রমিক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করে পৃথিবীর সব শ্রমিককে ধন্য ও মর্যাদাশীল করেছেন। মহানবী (সা.) নিজে বকরী চড়িয়েছেন, হযরত মুসা (আ.) নিজে হযরত শোয়াইব (আ.) এর নিকট নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শ্রম বিক্রি করেছেন, দাউদ (আ.) কর্মকার ছিলেন, আদম (আ.) ছিলেন কৃষক, নুহ (আ.) ছুতার ও ইদ্রিস (আ.) দরজি ছিলেন। মহানবী (সা.) তার প্রিয়তম কন্যা ফাতেমাকে একজন উত্তম শ্রমিকের কাছে পাত্রস্থ করেছিলেন; যিনি শিক্ষা ও বীরত্বের দিক থেকেও ছিলেন সমান পারদর্শী। আমিরুল মোমেনিন হযরত আলী (রা.) নিজে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে শ্রমিকের জীবন বেছে নিয়েছিলেন। হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.) ছিলেন কাপড়ের ব্যবসায়ী।
কোদাল চালাতে চালাতে একজন সাহাবীর হাতে কালো দাগ পড়ে যায়। রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর হাত দেখে বললেন, “তোমার হাতের মধ্যে কি কিছু লিখে রেখেছ ? সাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রসুল (সা.) এগুলো কালো দাগ ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি আমার পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণের জন্য পাথুরে জমিতে কোদাল চালাতে গিয়ে হাতে এ কালো দাগগুলো পড়েছে। নবীজী (সা.) এ কথা শুনে ওই সাহাবীর হাতের মধ্যে আলতো করে গভীর মমতা ও মর্যাদার সাথে চুমু খেলেন। এভাবে অসংখ্য কর্ম ও ঘটনার মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীতে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। রসুলুল্লাহ (সা.) শ্রম দিয়ে জীবিকা অর্জন করার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করে বলেন, “কারও জন্য নিজ হাতের উপার্জন অপেক্ষা উত্তম আহার্য বা খাদ্য আর নেই। আল্লাহর নবী দাঊদ (আঃ) নিজ হাতের কামাই খেতেন।”২৮
বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী পন্ডিত ও ইমামগণও তাঁদের নিজেদের মূল নামের পাশাপাশি পেশাভিত্তিক পরিচয় দিতে বিন্দুমাত্রও লজ্জাবোধ করতেন না। ‘আত্তার’ অর্থাৎ আতর বিক্রেতা, কাত্তান (তুলা উৎপাদনকারী), খাব্বাজ (রুটি ব্যবসায়ী) ইত্যাদি পেশাভিত্তিক উপাধি ব্যবহার করতেন তাঁরা।
শ্রমিকদের ভুল-ত্রুটিকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা:
বর্তমান সময়ে কল-কারখানা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রায়শই শ্রমিকরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আজকাল পত্রিকার পাতা খুলতেই শ্রমিক নির্যাতনের খবর ভেসে ওঠে; অনেক সময় নিষ্ঠুর ও পাশবিক নির্যাতনের মাধ্যমে তাদেরকে মেরে ফেলা হচ্ছে। কল-কারখানার শ্রমিক তো বটেই, গৃহের শ্রমিকও বাদ যাচ্ছে না পাশবিক নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা থেকে। ঠুনকো অভিযোগে শ্রমিককে মারধর করার অধিকার কিছুতেই দেয়নি ইসলাম। হযরত আবু মাসউদ (রা.) বলেন, আমি আমার চাকরকে মারধর করছিলাম। আমি পেছন থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম, “সাবধান আবু মাসউদ! তুমি তোমার গোলামের ওপর যতটুকু ক্ষমতা রাখো, আল্লাহ তোমার ওপর এর চেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখেন।” আমি পেছনে ফিরে দেখি, তিনি আমার প্রাণের নবী। আমি তখন বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি তাকে আল্লাহর জন্য আজাদ করে দিলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন, তুমি যদি তাকে মুক্ত না করতে তবে অবশ্যই তোমাকে আগুনে জ্বলতে হতো।”২৯ একজন কেনা গোলামের গায়ে হাত তোলায় নবীজি (সা.) কত বড় ধমক দিলেন! শ্রমিক কোনো ভুল করে ফেললেও তার জন্য ক্ষমার দরজা খোলা রেখেছে ইসলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এক লোক এসে জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসুলুল্লাহ! শ্রমিককে কতবার ক্ষমা করব? নবীজি চুপ থাকলেন। লোকটি আবারও জিজ্ঞেস করলে নবীজি (সা.) চুপ থাকলেন। লোকটি তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করলে নবীজি (সা.) বললেন, “প্রতিদিন ৭০ বার হলেও তার অপরাধ ক্ষমা করবে।”৩০
পরিশেষে, ইসলাম শুধু শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথাই বলে না বরং সমগ্র মানব জাতির মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চায়। মানুষে-মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতার পরিবর্তে সৌহার্দ-সম্প্রীতি গড়ে তুলতে চায়। আর ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই শ্রমিক-মালিক, নারী-শিশু-পুরুষ সর্বশ্রেণির মানুষ পাবে তাদের অধিকার, দূর হবে সকল প্রকার অশান্তি ও হানাহানি এবং বিশ্বব্যাপি প্রতিষ্ঠিত হবে শান্তি ও নিরাপত্তা।যে কোন শ্রমকেই আমাদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত এবং শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষায় সম্ভাব্য সব প্রচেষ্টাই একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতিরাষ্ট্রের এক অনিবার্য অনুষঙ্গ হওয়া আবশ্যক। আগামী দিনে বাংলাদেশসহ বিশ্ব শ্রমিকরা নিজেদের প্রয়োজনে ইসলামের দেওয়া শ্রমের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসবেন ইনশাআল্লাহ।
তথ্যসূত্র
১.সুরা নাজম : ৩৯-৪১
২.সুরা কাসাস :২৬
৩.সুরা কাহাফ : ২৩
৪.সুরা ইসরাহ্ : ৩৪
৫.সুরা মুতাফ্ফিফীন : ১-৩
৬.সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম
৭.সহীহুল বুখারী ও মুসলিম
৮.সুরা হুজুরাত : ১৩
৯.বুখারি : ২/৭৩০
১০ .আবু দাউদ : ২/৪২৭
১১ .হাইসামি : ৪/৩২৫
১২.সুনানু ইবনে মাজাহ
১৩.সুনানু ইবনে মাজাহ
১৪ .বুখারি ও মুসলিম
১৫.সুরা কাসাস : ২৭
১৬.সুরা আয-যুখরুফ : ৩২
১৭.সুরা জুমা : ১০
১৮.বায়হাকী
১৯.সুরা মুলক : ১৫
২০.সুরা বালাদ : ৪
২১.বুখারী
২২.সুনানু ইবনে মাজাহ
২৩.সুরা কাসাস : ২১৬
২৪.সুরা আল-ফাতির :১৪
২৫.মুসনাদে আহমাদ
২৬.বুখারি : ২/৭৭৬
২৭.সুনানু ইবনে মাজাহ : ২/৮১৭
২৮.বুখারী, মিশকাত :২৭৫৯
২৯.মুসলিম : ৫/৯২
৩০.আবু দাউদ : ২/৭৬৩
লেখক: বিশিষ্ট গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ