মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা মানব জাতিকে পুরুষ ও নারী এ দুভাগে বিভক্ত করে সৃষ্টি করেছেন। অতপর তাদেরকে পৃথিবীতে মেধা ও শ্রম বিনিয়োগ করে জীবিকা উপার্জনের অধিকার প্রদান করেছেন। সাথে সাথে উভয়ের কর্ম ও দায়িত্বের পরিধিও সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। কর্মই সাফল্যের চাবিকাঠি। কর্মহীন জীবনের কোন মূল্য নেই। তাই পুরুষদের ন্যায় নারীদেরও কর্মের অধিকার ইসলামে স্বীকৃত। ইসলাম এ ব্যাপারে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য উপকারী নারীবান্ধব নির্দেশনা প্রদান করেছে। ইসলাম নারীদেরকে তার যথাযথ মর্যাদা ও অধিকার প্রদান করে তাকে সম্মানিত করেছে এবং পারিবারিক ও সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করেছে। কর্মের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ঘরের বাইরে কর্ম করার ক্ষেত্রে নারীর অধিকার কতটুকু তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য থাকলেও নারীর কর্ম সম্পর্কে ইসলামের অবস্থান সুস্পষ্ট। ইসলাম নারীকে ঘরের মধ্যে যে কোন বৈধ কর্ম সম্পাদন করতে এবং প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেয়েও শ্রম করতে নিষেধ করেনি বরং অনুমতি দিয়েছে। তবে নারীর কর্মের অধিকারের ব্যাপারে ইসলাম কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। শরীআত নির্ধারিত এসব নীতিমালা অনুসরণ করে একজন মুসলিম নারীও ঘরের বাইরে যে কোন শ্রম করার অধিকার তার রয়েছে। আর একজন মুসলিম নারী যদি শরয়ী নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করেন এবং ঘরের বাইরে যেয়ে শ্রম প্রদান করেন তাহলে মহান আল্লাহ তায়ালা এর বিনিময়ে তাকে আখিরাতে যেমন সওয়াব প্রদান করবেন, তেমনি দুনিয়াতেও তাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করবেন। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন,“অতপর তাদের প্রতিপালক তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে বলেন, আমি তোমাদের মধ্যে কর্মনিষ্ঠ কোন নর অথবা নারীর কর্ম বিফল করি না তোমরা একে অপরের অংশ।” এ পর্যায়ে আমরা মহিলা শ্রমিকদের কর্মের অধিকারের ব্যাপারে শরীআত নির্ধারিত নীতিমালা আলোচনা করবো।
ক. কর্মটি মৌলিকভাবে শরীআহ সম্মত হওয়া
নারী যে কাজটি করবে সেটি মৌলিকভাবে ইসলামী শরীআতের দৃষ্টিতে বৈধ বা হালাল হতে হবে। পুরুষের ন্যায় নারীরাও বৈধ যে কোন কাজে শ্রম বিনিয়োগ করার অধিকারী। যেমন : বৈধ ব্যবসা-বানিজ্য, শিক্ষাকতা, ডাক্তারি, নার্সিং ইত্যাদি। কাজের ক্ষেত্রে ইসলাম নারীর প্রতি কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি বরং তাতে উৎসাহিত করেছে। আমরাহ বিনতে তারিখ (রা.) বলেন, আমার দাসিকে সাথে নিয়ে আমি বাজারে গিয়ে মাছ ক্রয় করে থলেতে রাখলাম। মাছের মাথা ও লেজ থলের বাইরে রইলো। আমাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আলী (রা.) তা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কত দাম দিয়ে কিনেছেন? এ তো অনেক বড়ো ও ভাল বাজার করেছেন। পরিবারের সবাই তৃপ্তির সাথে আহার করতে পারবেন।
খ. কর্মটি নারী সুলভ হওয়া
কোন নারী যদি ঘরের বাইরে যেয়ে কাজ করতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই তার দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের অনুকূল সকল কাজে শ্রম করার অধিকার রয়েছে। যদিও মানুষ হিসেবে নারী পুরুষ অভিন্ন সত্তা। সভ্যতা-সংস্কৃতির ক্রমবিকাশে তাদের অবদানও অভিন্ন। তারা একে অপরের পরিপূরক, কেউ কারো প্রতিদ্বন্দ্বি কিংবা বিকল্প নয়। তবে দৈহিক গঠন, মনস্তত্ত্ব, আবেগ-অনুভূতি, দৈহিক কাঠামো, শক্তি সামর্থ, মেধা ও যোগ্যতা, অভিরুচি, ঝোক-প্রবণতা, কর্মস্পৃহা, কর্মদক্ষতা প্রভৃতি দিক দিয়ে তাদের ব্যবধান দুস্তর। নারীদের হৃদপিণ্ড ও মগজ উভয়টিই পুরুষের তুলনায় ৩০ গ্রাম ছোট ও হালকা। নারীর প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গ ও কোষের মধ্যে নারীত্বের চিহ্ন সুস্পষ্ট। তারা সাধারণত: কর্মবিমুখ। সাজ সজ্জার প্রতি তাদের আকর্ষণ বেশি। তারা অধিক পরিমাণে আবেগ প্রবণ। আর এই আবেগ তার চিত্তকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে, যার সাথে যুক্তি কিংবা বুদ্ধির কোন সংশ্রব নেই। আনন্দ-বেদনা, দুঃখ-অনুশোচনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের আচরণ অপরিপক্ক। তাই কঠিন ও বিপদ সংকুল মুহূর্তগুলোর চাপ বহন করতে তারা অক্ষম। তাদের দৈহিক শক্তি-সামর্থ্য ও কর্মক্ষমতা পুরুষের চাইতে কম। আর নারীসুলভ কর্মের মধ্যে ব্যবসা, সেলাই, শিক্ষকতা, নার্সিং, চিকিৎসা বিষেশভাবে অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া যে সকল কাজ কষ্টসাধ্য ও কঠিন এরূপ কাজে নিয়োগ হওয়া নারীদের জন্য বাঞ্চনীয় নয়। যেমন : রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা, ইমারত নির্মাণ করা, রাস্তা তৈরি করা, কয়লা খনিতে কাজ করা, নৈশকালীন যে কোন কাজ করা এবং ভূগর্ভের কাজে নারী শ্রমিক নিয়োগ করা ইসলাম অনুমোদন করে না। হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, “আমার খালাকে তার স্বামী তালাক দিলেন। ইদ্দতের সময়ের মধ্যেই তিনি নিজের বাগানের খেজুর সংগ্রহ করার ইচ্ছা পোষণ করলেন। এক ব্যক্তি তাকে কঠোর ভাবে নিষেধ করলেন। বিষয়টি জিজ্ঞাসা করার জন্য তিনি নবী করিম (সা.)-এর নিকট গেলেন। তিনি তাকে বললেন, বাগানে যাও, তোমার খেজুর কাটো। তুমি হয়তো তা থেকে দান খায়রাত করবে বা কল্যাণকর কোন কাজ করবে।”
গ. কর্মস্থল নিরাপদ থাকা
নারী শ্রমিকদের বৈধ কর্মস্থলে নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। নারীদের ঘরের বাইরের যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম শর্ত হলো পথে ঘাটে বা কর্মস্থলে নারীর জন্য নিরাপদ হওয়া একান্ত প্রয়োজন। তবে নারীর নিজের কর্মস্থলে বিপদাপন্ন হওয়ার আশংকা থাকে অথবা তার দ্বারা কোন পুরুষ বিপদাপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে এমতাবস্থায় নারীর ঘরের বাইরে যাওয়া উচিত নয়। হযরত উসামা ইবনে যায়েদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, “আমি আমার পরবর্তীদের মধ্যে পুরুষের জন্য নারীদের থেকে অধিক ক্ষতিকারক কোন ফিতনার উপাদান রেখে যাইনি।” কেননা আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, “মানুষের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে নারী, সন্তান, রাশিকৃত সোনা-রূপা আর চিহিৃত ঘোড়াসমুহের প্রতি আসক্তি।” এ সম্পর্কে শায়েখ আব্দুল আযীয (রহ.) বলেন, পুরুষের মাঝে মাহরাম ছাড়া নারীর কাজ করা ফিতনার উপলক্ষ যা এমন এক মন্দ পরিণতির দিকে পৌছে দেয় যা আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা হারাম করেছেন। বলাই বাহুল্য, হারামের উপলক্ষ্যও হারাম। তবে ইসলাম সকল নারীকে ফিতনার উপকরণ বলেননি। সুতরাং নারীদের জন্য নিরাপদ ও সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ থাকা একান্ত জরুরি।
ঘ. সম-মজুরীর অধিকারী
সমান কাজ করেও শ্রমজীবী মহিলারা পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে কম বেতন পেয়ে থাকেন। কোন একটা জরিপে দেখানো হয়েছে যে, দৈনিক শ্রমিকদের পারিশ্রমিক পুরুষের জন্য যখন ৪৬/- টাকা, তখন নারী শ্রমিক পান ২৬/- টাকা। যা নারী শ্রমিকের প্রতি নির্যাতনের শামিল। তাই সমকাজের জন্য সম-মজুরি হওয়া একান্ত অপরিহার্য। কেননা নারী পুরুষ একই উৎস থেকে উদ্ভুত। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, “হে মানব জাতি! নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, পরে তোমাদের বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার।” তিনি আরও বলেন, “পুরুষ যা উপার্জন করে তা তার নিরঙ্কুশ প্রাপ্য এবং নারী যা উপার্জন করে তা তার নিরঙ্কুশ প্রাপ্য।” এ আয়াত সমূহে নারী পুরুষ উভয়কে সমান অধিকারে ভূষিত করা হয়েছে। সুতরাং শ্রমিকদের জন্য মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে একই মানের কাজের জন্য মহিলা ও পুরুষ শ্রমিকদের জন্য সমান মজুরির নীতি অনুসরণ করা অপরিহার্য। এ বিষয়ে নারী পুরুষের মধ্যে বৈষম্য করা উচিত নয়। পাশাপাশি প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি ও বদলির ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি সমআচরণ করা এবং অশ্লীল আচরণ থেকে বিরত থাকা কিংবা এমন আচরণ যা অভদ্রজোনিত বা যা মহিলাদের শালিনতা ও সম্ভ্রমের পরিপন্থী তা করা উচিৎ নয়।
ঙ. প্রসূতিকালীন সুবিধা
প্রত্যেক মহিলা শ্রমিক তার সন্তান প্রসাবের সম্ভব্য তারিখের পূর্ববর্তী আট সপ্তাহ এবং সন্তান প্রসাবের পর আট সপ্তাহ প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা পাবেন। তাছাড়া মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা ও সবেতনে মাতৃত্বকালীন ছুটি পাবেন।
চ. মহিলা শ্রমিকদের জন্য স্বতন্ত্র পর্দার ব্যবস্থা
নারী শ্রমিকরা ‘শরীআহ সম্মত পোষাক’ পরিধান করে ঘরের বাইরে কাজ করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে ধৌতকরণ সুবিধা, ভোজন কক্ষ, গোসল খানা ও পায়খানা পুরুষ ও মহিলাদের জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা থাকা জরুরী। পাশাপাশি নারীদের জন্য আলাদা বিশ্রাম কক্ষ ও নামাজের ব্যবস্থা থাকতে হবে। উম্মে আতিয়্যাহ (রা.) বলেন, আমাদেরকে রসুলুল্লাহ (সা.) এ মর্মে নির্দেশ দিয়েছেন যে, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার সময় আমরা যেন আমাদের সাবালিকা, ঋতুবর্তী ও গৃহবাসী মহিলাদেরকে বের করি। তবে ঋতুবতী মহিলারা যেন নামাজ থেকে বিরত থাকে। বাকী পূণ্যের কাজে ও মুসলিমদের দোআয় শরীক হবে। আমি বললাম হে আল্লাহর রসুল! আমাদের কারো কারো চাদর নেই। রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তার অন্য বোন তাকে চাদর পরিয়ে দিবে।
ছ. শিশুকক্ষ থাকা
যেসব প্রতিষ্ঠানে মহিলা শ্রমিক কাজ করবেন এমন সকল প্রতিষ্ঠানে তাদের ছয় বছরের কম বয়সী শিশু সন্তানদের ব্যবহারের জন্য এক বা একাধিক কক্ষের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ কক্ষগুলো অবশ্যই পরিস্কার পরিছন্ন ও স্বাস্থ্য সম্মত হওয়া জরুরি। এসব শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার জন্য অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মহিলারা তত্ত্বাবধান করবে। তাছাড়া শিশুদের বিনোদনমূলক সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কেননা শিশুরা হলো আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত, যার শুকরিয়া আদায় করা আমাদের কর্তব্য। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, “ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি দিয়ে আমি তোমাদেরকে সাহায্য করলাম এবং তোমাদেরকে আমি সংখ্যাগরিষ্ট করলাম।” শিশুরা হলো চোখের প্রশান্তি। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, “হে আমাদের রব! স্ত্রীদের এবং সন্তানদেরকে আমাদের জন্য নয়ন জুড়ান করে দাও এবং তুমি আমাদের মুত্তাকী লোকদের ইমাম বানিয়ে দাও।” সুতরাং বলা যায় শিশুরা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। তাই ইসলাম শিশু জন্মের আগে ও পরের অনেক অধিকারকে সুচারুরূপে উপস্থাপন করেছে। জনৈক আরবি কবি যথার্থই বলেছেন,
সন্তানেরা মনে হয় যেনো মোদের মাঝে
মোদের অন্তর মূর্ত হয়ে মাটিতে হাটে।
দমকা হাওয়া বয়ে যায় যদি কোন সাঁঝে
ঘুম আসে না চোখে সারাটি রাতে।
জ. কর্মটির প্রতি ব্যক্তিগত বা সামাজিক প্রয়োজন থাকা
নারীদেরকে সাধারণত কোন প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়ার অনুমতি নেই। কারণ আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা নবী করীম (সা.)-এর স্ত্রীগণকে ঘরে অবস্থান করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ বিধান নবী পত্নীগণের পাশাপাশি সমগ্র মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, “আর তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন জাহেলী যুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শণ করে বেড়াবে না।” ইবনে কাছির (রহ.) বলেন, এই শিষ্টাচারসমুহ পালনের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা নবী করিম (সা.)-এর স্ত্রীগণকে আদেশ করেছেন। আর এ উম্মতের অন্যান্য নারীও এই বিধানের অন্তর্ভুক্ত। উল্লেখিত আয়াত দ্বারা ইবনে কাছির ও অন্যান্য মুফাসসিরগণ এই বিধান সাব্যস্ত করেছেন যে, নারীরা সাধারণভাবে বাড়িতে অবস্থান করবে, প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হবে না। সুন্নাহ দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে নারীগণ তাদের প্রয়োজনে তাদের ঘরের বাইরে বের হতে পারবে। হযরত আয়িশা (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমাদের প্রয়োজনে তোমাদেরকে বাইরে বের হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।” সুতরাং শরীআহ যে সব ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা না থাকলে নারীরা ঘরের বাইরে যেতে পারবেন এবং প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারবেন।
ঝ. পুরুষের সাথে অবাধ মেলামেশা ও নির্জনবাস না করা
যে সকল পুরুষকে বিবাহ করা হারাম নয় এমন পুরুষের সাথে অবাধ মেলামেশা ও নির্জনে কাজ করা কোন মুসলিম নারীর জন্য বৈধ নয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আমি রসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি তিনি বলেন, “কোন নারীর সাথে কোন পুরুষ যেন কোন অবস্থাতেই নির্জনে অবস্থান না করে এবং কোন নারী যেন কোন অবস্থাতেই মাহরাম ছাড়া সফর না করে।” আরও একটি হাদিসে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “কোন নারীর সাথে কোন পুরুষ নির্জনে অবস্থান করলে শয়তান সেখানে তৃতীয়জন হিসেবে উপস্থিত থাকে।” অতএব নির্জনে নারী পুরুষের অবাধ মেলা-মেশার সুযোগ না থাকলে কিংবা নারীর সাথে মাহরাম থাকলে নারী-পুরুষ সকলেই শরয়ী বিধান মেনে প্রয়োজনীয় কর্মসম্পাদনে কোন অসুবিধা নেই। তবে কর্মস্থলেরর সার্বিক পরিবেশ ইসলামী না করে ঘরের বাইরে কাজ করতে যাওয়া নারীর জন্য এবং সার্বিক সমাজের জন্য সুফল বয়ে আনবে না। এ প্রসঙ্গে শাইখ আবদুল আযীয বিন বায (রহ.) বলেন, পুরুষের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্রে নারীদের কর্মের ব্যবস্থা করার আহবান ইসলামী সমাজব্যবস্থার জন্য বিপদজনক। এর সব চেয়ে বড় ক্ষতিকর প্রভাব হচ্ছে, এটি নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশার সুযোগ করে দেয়, যা সমাজ বিধবংসী ব্যভিচারের দিকে নিয়ে যায়।
ঞ. সুগন্ধি ব্যবহার করে বাইরে বের না হওয়া
কোন নারী যেন সুগন্ধী ব্যবহার করে বাইরে বের না হয়। বাইরে বের হওয়ার সময় অবশ্যই তাকে সুগন্ধী ছাড়া বের হতে হবে। হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, “যে নারী লোবন লাগায় সে যেন আমাদের সাথে ইশার সালাতে উপস্থিত না হয়।” তিনি আরও বলেন, আমি রসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, “কোন নারী এই মসজিদে সুগন্ধী ব্যবহার করে আসলে তার সালাত ততক্ষণ কবুল করা হবে না যতক্ষণ না সে জানাবাত থেকে পবিত্র হওয়ার জন্য যেভাবে গোসল করা হয় সেভাবে গোসল করে সালাতে দাড়ায়।” উপরিক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সুগন্ধী লাগিয়ে ঘরের বাইরে বের হওয়া নারীর জন্য হারাম বরং সুগন্ধী না লাগিয়ে অন্যান্য শরয়ী বিধি-বিধান পরিপালন করে নারী তার প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করতে বাইরে বের হতে পারবে । চাকরী ও ব্যবসা-বানিজ্যসহ সকল বৈধ কাজ করতে ইসলামে কোন বাধা নেই বরং ইসলামে এগুলোর অনুমোদন রয়েছে।
ত. স্বামী বা অভিভাবকের অনুমতি স্বাপেক্ষে বাইরে গমন করা
কোন নারী ঘরের বাইরে বের হতে চাই, তাহলে তার স্বামী বা আইন সম্মত অভিভাবকের নিকট থেকে অনুমতি গ্রহণ করতে হবে। কারণ স্বামী বা অভিভাবকগণই ঐ নারীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ব্যাপারে আল্লাহর নিকট জিজ্ঞাসিত হবে। তাই কোন নারী যদি বাইরে যেয়ে কাজ করতে চায় তাহলে তার দায়িত্ব হলো তার স্বামী বা অভিভাবক থেকে অনুমতি নেওয়া। তাছাড়া সামর্থ্যবান নারীর হজ গমনের ক্ষেত্রেও অভিভাবকের অনুমতি আবশ্যক। এ ব্যাপারে ইমাম শাফিঈ (রহ.) বলেন, কোন নারী যদি শারীরিকভাবে এবং আর্থিকভাবে হজে যাওয়ার সামর্থ্যবান হয় কিন্তু তার অভিভাবক কিংবা তার স্বামী হজে যেতে বাধা দেয় তাহলে ঐ নারী হজের ইহরাম বাধবে না। ইসলামী আইনবিদগণ নারীর বাইরে বের হওয়ার ব্যাপারে স্বামী বা অভিভাবকের অনুমতি গ্রহণ করাকে শর্ত হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তাদের দলিল কুরআনের বাণী। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে আগুন হতে রক্ষা কর যার জ্বালানী হবে মানুষ এবং পাথর।” এ আয়াতের তাফসিরে মুফাসসির ইমাম কাতাদাহ (রহ.) বলেন, দায়িত্বশীল ব্যক্তি তার পরিবার পরিজনকে আল্লাহর আনুগত্যের আদেশ দিবে আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কাজ থেকে নিষেধ করবে, তাদের ওপর আল্লাহর বিধান প্রয়োগ করবে, তাদেরকে তা পালনের আদেশ দিবে এবং তা পালনে তাদেরকে সহযোগিতা করবে। যখন তাদের দ্বারা কোন গুনাহর কাজ কিংবা আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কাজ হতে দেখবে তখন তাদেরকে তা থেকে নিবৃত্ত করবে এবং নিষেধ করবে। সুতরাং কোন বিবাহিত নারী যদি প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে চায়, তাহলে তার স্বামীর নিকট হতে অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে। আর অবিবাহিতা বা বিধবা কিংবা অন্য যে কোন নারী তার আইনগত অভিভাবকের নিকট থেকে অনুমতি না নিয়ে ঘর থেকে বাহির হবে না। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি গ্রহণসহ যে কোন নারী চাকরী বা ব্যসা-বাণিজ্য বা তার যে কোন প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে পারবে।
থ. পারিবারিক দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এমন কর্ম না হওয়া
নারীর প্রধান দায়িত্ব হলো তার স্বামী ও সন্তানের দেখাশুনা করা। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “জেনে রাখ! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল আর তোমরা প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে আল্লাহর নিকট জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী হচ্ছে তার স্বামীর পরিবার ও সন্তান-সন্ততির দায়িত্বশীল, তাকে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। তাই যদি কোন স্ত্রী তার পরিবারের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করে বাইরের কাজে বের হয় এবং স্বামী সন্তানের অধিকার ,বিনষ্ট করে তাহলে তা কখনই তার জন্য বৈধ নয়। আল্লামা শাইখ আব্দুল আযীয বিন বায (রহ.) বলেন, যদি মহিলা পুরুষদের সংশ্রব থেকে দূরে কোথাও কোন কর্মে কোনরূপ শরয়ী অতীব প্রয়োজন ব্যতিত নিয়োজিত হয় এবং এ কর্ম যদি তার সন্তান-সন্ততিদের ক্ষতির কারণ হয় ও এতে তার স্বামীর অধিকার আদায় করার ক্ষেত্রে কোন ত্রুটি দেখা দেয় তাহলে তার এ কর্ম হারাম হবে। কেননা এ কর্ম নারীরস্বভাবগত দায়িত্বের বহির্ভূত এবং তার একান্ত কর্তব্য পরিহারের নামান্তর। এতে পরবর্তী প্রজন্ম খারাপভাবে বেড়ে উঠবে এবং পারিবারিক বন্ধনসমূহ যা পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা ও দায়িত্ব গ্রহণের ওপর নির্ভরশীল ছিন্ন হয়ে যাবে। সুতরাং পারিবারিক দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এ জাতীয় কোন কর্ম করা নারীর জন্য বৈধ নয়। তবে এরূপ কোন সমস্যা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে অন্যান্য নীতিমালা মেনে নারী তার প্রয়োজনে ঘরের বাইরে চাকরী বা অন্য যে কোন কাজ করতে পারবে।
দ. প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যাওয়ার অধিকার
যে সব কাজ শরীআত সম্মত এবং নারী তা যদি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে পারে এমন কর্মের ব্যাপারে ইসলাম নারী শ্রমিকদের কাজ করার অনুমতি দিয়েছে। এমনকি নারী ইদ্দতের সময়ও তা করতে পারবে। হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, “আমার খালাকে তার স্বামী তালাক দিয়ে দিল। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে তিনি নিজের বাগানের কয়েক কাঁদি খেজুর কাটার ইচ্ছা করলেন। তখন এক ব্যক্তি তাকে কঠোরভাবে নিষেধ করলো, বিষয়টি জিজ্ঞাসা করার জন্য করার জন্য তিনি নবী করিম (সা.)-এর নিকট গেলেন। তিনি তাকে বললেন বাগানে যাও, তোমার খেজুর কাটো তুমি সম্ভাবত সে অর্থ দান খায়রাত করতে বা কল্যাণকর কোন কাজে লাগাতে পার।
উপরিক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে আমরা বলতে পারি যে, ইসলাম নারীদেরকে শুধু মর্যাদাই দেয়নি বরং তার যথাযথ অধিকারও প্রদান করেছে। রসুলুল্লাহ (সা.) এবং তার সাহাবীদের যুগে আমরা দেখতে পাই মহিলা সাহাবীরা ক্ষেতে খামারে কাজ করতেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। সুতরাং নারীদের কর্মের অধিকারকে ইসলাম সুরক্ষিত ও নিরাপদ করেছে। তাই যে কোন মুসলিম নারীর ইসলামী নীতিমালা মেনে ঘরের বাইরে কাজ করার অধিকার থাকবে।
লেখক : ইসলামী শ্রমনীতি গবেষক