সভ্যতার উন্নয়নে শ্রমজীবী মানুষের অবদান অনস্বীকার্য। আজকের আধুনিক বিশে^র যেখানে যতটুকু সুন্দর তার পিছনে শ্রমজীবী মানুষের হাতের ছোঁয়া ও খেটে খাওয়া মানুষের রয়েছে হাড় ভাঙা পরিশ্রম। আজকের আধুনিক সভ্যতা শ্রমজীবী মানুষ ধরে রেখেছে। শ্রমিকেরা কাজ বন্ধ করে দিলে গোটা সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই বিশে^র সকল দেশ ও জাতি শ্রমজীবী মানুষের উপর নির্ভরশীল।
বিপ্লব আন্দোলন সংগ্রামে শ্রমজীবী মানুষের অবদান: পৃথিবীতে যত আন্দোলন সংগ্রাম ও বিপ্লব হয়েছে শ্রমজীবী মানুষ তথা শ্রমিক সংগঠনের ভূমিকা ছিল অগ্রগামী। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পিছনে শ্রমজীবী সংগঠনের ভূমিকা ছিল বলিষ্ঠ। তারা আমেরিকার জাহাজে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে আমেরিকার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে আমেরিকার আগ্রাসন বন্ধ করে দিয়ে ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে দিয়েছিলো। অপরদিকে আলজেরিয়ার ইসলামী দল শতকরা ৮৫% ভোট পেয়েও সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেনি, কারণ তাদের হাতে দেশের শ্রমিক সংগঠন ছিল না।
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শ্রমিক: দেশের শতকরা ৭০% মানুষ শ্রমিক। এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে ইসলামী বিপ্লব সম্ভব নয়। তাই ইসলামী আন্দোলনকে সফল করতে হলে শ্রমিক সংগঠনকে গুরুত্ব দিতে হবে।
বড়ো বড়ো রাজনৈতিক দল: বাংলাদেশের বড়ো বড়ো রাজনৈতিক দল, যেমন: আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি। প্রত্যেকটি দল শ্রমিক সংগঠনের মাধ্যমেই বৃহত্তর রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে থাকে। তাই ইসলামী আন্দোলনকে সফল করতে হলে শ্রমিক সংগঠনকে গুরুত্ব দিতে হবে।
সরকার/রাষ্ট্র পরিচালনা: দেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় স্বাধীনতা পরবর্তী প্রত্যেকটি সরকার আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি যখন যারা ক্ষমতায় ছিল প্রত্যেকেই শ্রমিক সংগঠনের সাথে সমঝোতা করে দেশ বা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধীদলকে সামান্যতম সুযোগ-সুবিধা দেয় না। বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত কর্মসূচি পালন করতে বাধা দেয়। সেই আওয়ামী লীগ সরকারও পরিবহন শ্রমিকদের তিনদিনের অবরোধ কর্মসূচি পালন করার পর শ্রমিক সংগঠনের প্রতি নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। তাই ইসলামী আন্দোলনকে সফল করতে হলে শ্রমিক সংগঠনকে গুরুত্ব দিতে হবে।
সংগঠিত শক্তি: কথায় বলে ঐক্যই শক্তি, সংগঠিত মানুষই শক্তিশালী মানুষ। শ্রমজীবী মানুষ একই সময় একই মিল কারখানা ও অফিসে, প্রতিষ্ঠানে পারস্পরিক সহযোগিতায় এক সাথে অনেক কাজ করে। যাদের সংখ্যা হাজার লক্ষের কোটায় দাঁড়াতে পারে, তাই তারা নিজেদের মধ্যে একটি শক্তি অনুভব করে। তাই শ্রমিক সংগঠন যেকোন কর্মসূচি সহজেই সফল করতে পারে। অতএব ইসলামী আন্দোলনকে সফলতার দারপ্রান্তে পৌঁছাতে হলে শ্রমিক সংগঠনকে গুরুত্ব দিতে হবে।
কঠোর পরিশ্রমী: শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ কঠোর পরিশ্রমী হয়ে থাকে। তারা অলস নয়। তাদের বিলাসীতার প্রতি কোন মোহ নেই। এক কথায় বলা যায় প্রত্যেক শ্রমিক এক একজন সৈনিক। তারা যে কোন আন্দোলন বা বিপ্লবকে সফল করতে যেকোন কঠিন কর্মসূচি পালন করতে পারে। ইসলামী আন্দোলনের বড়ো বড়ো কর্মসূচি পালন সহজেই করতে পারে শ্রমিকেরা। তাই ইসলামী আন্দোলন সফল করতে শ্রমিক সংগঠনের গুরুত্ব অপরিহার্য।
অল্পে তুষ্ট, কম চাহিদা: শ্রমিকেরা অল্পে তুষ্টি লাভ করে। মোটা ভাত, কাপড় ও সামান্য বেতন ভাতা পেলেই শ্রমিকেরা সন্তুষ্ট থাকে। চাহিদার লম্বা তালিকা বা বিলাসবহুল জীবন তাদেরকে আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে পারে না। তাই যে কোন আন্দোলন সংগ্রামে শ্রমিকেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইসলামী আন্দোলনকে সফল করতে হলে আন্দোলন পাগল কিছু কর্মী প্রয়োজন। শ্রমিক সংগঠনেই পারে এই কর্মী সরবরাহ করতে। তাই ইসলামী আন্দোলন শ্রমিক সংগঠনের গুরুত্ব অনেক বেশি।
ত্যাগ কুরবানি: শ্রমিকদের দুনিয়ার প্রতি মোহ কম। তাদের নাই বিলাসবহুল বাড়ি। নেই কোন গাড়ি বা লক্ষ কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালেন্স। তারা সাধারণভাবে জীবন যাপন করে। তাদের পিছু টান নেই। তাই তারা যেকোন ত্যাগ কুরবানি স্বীকার করতে সর্বদাই প্রস্তুত। ইসলামী আন্দোলনকে সফলতার দারপ্রান্তে পৌঁছাতে জনশক্তির ত্যাগ কুরবানি খুব জরুরি। এই ধরনের জনশক্তি সরবরাহ করা শ্রমিক সংগঠনের পক্ষেই সম্ভব। তাই ইসলামী আন্দোলনে সফল করতে হলে শ্রমিক সংগঠনকে গুরুত্ব দিতে হবে।
রাজনৈতিক সচেতন: শ্রমজীবী মেহনতী মানুষ রাজনৈতিক সচেতন। কারণ তাদের স্বার্থ সুবিধা-অসুবিধা সরকারের সাথে জড়িত। দেশ কোন দিকে পরিচালিত হচ্ছে বা কি ক্ষুণœ হচ্ছে এইসব দিকগুলি শ্রমিকের তীক্ষ্মদৃষ্টিতে সবসময় দেখে। তাই দেশের সরকারের উত্থান-পতনের আন্দোলনে শ্রমিকেরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এই রাজনৈতিক সচেতন জনগোষ্ঠী যেকোন কর্মসূচি অনায়াসে পালন করতে পারে। ইসলামী আন্দোলনের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে রাজনৈতিক সচেতন ও কর্মপাগল বৃহৎ জনশক্তির। শ্রমিক সংগঠনই পারে এই রাজনৈতিক সচেতন ও কর্মপাগল জনশক্তি সরবরাহ করতে।
অসহায় মানুষের অধিকার আদায় ইসলামী আন্দোলন: শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য ও গরিব অসহায় শোষিত, বঞ্চিত মানুষকে জালেম অত্যাচারী ও শোষকের হাত থেকে রক্ষা করা ইসলামী আন্দোলনের অপরিহার্য কাজ। তাইতো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কালামে হাকিমের সুরা নিসার ৭৫ নং আয়াতে এইভাবে আহ্বান করেছেন; “তোমাদের কী হলো, তোমরা আল্লাহর পথে অসহায় নরনারী ও শিশুদের জন্য লড়বে না, যারা দুর্বলতার কারণে নির্যাতিত হচ্ছে? তারা ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের রব! এই জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাও, যার অধিবাসীরা জালেম এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের কোন বন্ধু, অভিভাবক ও সাহায্যকারী তৈরী করে দাও”।
দুর্বল লোকদের দ্বারা দ্বীন কায়েম: দুর্বল লোকদের দ্বারা যদি দ্বীন কায়েম হয় তাহলে সবাই আল্লাহর শক্তির প্রশংসা করে। আর রাজা বাদশাহদের দ্বারা দ্বীন কায়েম হলে তাদের শক্তির প্রশংসা করে। মহান আল্লাহ তার শক্তির প্রশংসা চান তার সৃষ্টির কোন শক্তির তিনি মুখাপেক্ষী নন। তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কালামে হাকিমে ঘোষণা করেছেন; আমি সংকল্প করেছিলাম যাদেরকে পৃথিবীতে লাঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল তাদের প্রতি আনুগ্রহ করবো। তাদেরকে নেতৃত্বদান করবো। পৃথিবীতে তাদেরকে কর্তৃত্বদান করবো। (সুরা কাসাস: ৫-৬)। সুতরাং আল্লাহর ওয়াদা হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া। তাই ইসলামী আন্দোলনে সফল করতে হলে শ্রমিক সংগঠনকে গুরুত্ব দিতে হবে।
শ্রমিকেরাই ইসলামী আন্দোলনের মূল জনশক্তি: মানবজাতির মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের জন্য এবং আল্লাহর দ্বীনকে বিজয় করার লক্ষ্যে নবীদের সাথী হিসেবে যোগ্যতা সম্পন্ন সাহসী জনশক্তি যারা বাতিলের সাথে মোকাবেলা করতে সক্ষম সে জনশক্তি কোথায় পাওয়া যাবে তা আল কুরআন সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করেছেন; আর নিশ্চয়ই আমরা ভীতি, অনাহার, প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতির মাধ্যমে এবং উপার্জন ও আমদানি হ্রাস করে তোমাদের পরীক্ষা করবো। এ অবস্থায় যারা সবর করে এবং যখন কোন বিপদ আসে বলে; আমরা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর দিকে আমাদের ফিরে যেতে হবে, তাদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দাও। (সুরা বাকারা: ১৫৫-১৫৬)।
উপরিউক্ত আয়াতে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলা হয়েছে, শ্রমজীবী মানুষ প্রতিনিয়ত সেইসব মোকাবেলা করে জীবনযাপন করে আসছে। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। তাই শ্রমজীবী মানুষ ইসলামী আন্দোলনের পথে এত অগ্রসর হতে পারে। ফলে ইসলামী আন্দোলনের সফলতার জন্য শ্রমিক সংগঠন অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠায় শ্রমজীবী মানুষের ভূমিকা:
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কালামের সুরা তওবার ২৪ নং আয়াতে বলেছেন; “হে নবী! বলে দাও, যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান ও তোমাদের ভাই তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের উপার্জিত সম্পদ, তোমাদের যে ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দেয়ার ভয়ে তোমরা তটস্থ থাক এবং তোমাদের যে বাসস্থানকে তোমরা খুবই পছন্দ কর-এসব যদি আল্লাহ ও তার রসুল এবং তাঁর পথে জিহাদ করার চাইতে তোমাদের কাছে বেশী প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফায়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর আল্লাহ ফাসেকদেরকে কখনো সত্য পথের সন্ধান দেন না”।
গরিব অসহায় শ্রমজীবী মানুষ যাদের সম্পদের প্রাচুর্য নেই। বসবাসের জন্য সুন্দর সুন্দর ঘর নেই। অর্থের অভাবে পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তানদের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে না। তারাই দুনিয়ার জীবনের চেয়ে আখেরাতের জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে আল্লাহর পথে চলতে পারে এবং তাদের জীবনকে জেহাদের পথে উৎসর্গ করা খুবই সহজ। তাই ইসলামী আন্দোলন সফল করতে এই ধরনের কর্মীর প্রয়োজন অধিক। আর শ্রমিক সংগঠনেই এই ধরনের কর্মী সরবরাহ করতে পারে।
আমাদের দেশে শতকরা ৭০% মানুষ শ্রমিক ও শ্রমজীবী। তাই তাদেরকে উপেক্ষা করে কোন বিপ্লব বা আন্দোলন সম্ভব নয়। এমনকি ইসলামী আন্দোলনও নয়। তাই বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন সফল করতে হলে শ্রমজীবী মানুষকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাই শ্রমিকদেরকে বিভিন্ন ট্রেডে বিভক্ত করে প্রত্যেক ট্রেডে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে জোরদার ও কার্যকর করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে হক আদায় করে দায়িত্ব পালনের তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন।