বেকারত্ব বলতে সাধারণভাবে কর্মক্ষম মানুষের কর্মহীনতাকে বোঝায়। একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমার আওতাভুক্ত ব্যক্তির কাজের ইচ্ছা, উপযুক্ত সামর্থ্য ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যদি সে কোনো উপার্জনমূলক কর্মসংস্থান করতে ব্যর্থ হয় তবে সে বেকার। বেকারের কর্মহীন পরিস্থিতিকে ‘বেকারত্ব’ বলে ধরা হয়। মোটকথা বেকারত্ব হলো, একটি পরিস্থিতি কিংবা অবস্থা। যার সঙ্গে কর্মক্ষম মানুষের কর্মহীন অবস্থার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বেকারত্ব এমন এক অবস্থা যেখানে যোগ্যতা ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তি কর্ম লাভে ব্যর্থ হয়।
সমস্যা জর্জরিত পৃথিবীতে বেকারত্ব এক কঠিন ও জটিল সমস্যা। এ সমস্যার সমাধান না হওয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ছিনতাই, রাহাজানির মত বড়ো বড়ো সমস্যা। হতাশার গ্লানিতে কর্মোদ্দীপক মানুষের চেহারায় বিষাদ নেমে এসেছে। উন্নত, অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল সবরকম দেশেই কম-বেশি এ সমস্যা বিদ্যমান। বেকারত্বের পরিচয় নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। মতভেদ থাকলেও মূল কথা প্রায় একই। যেমন অধ্যাপক এ সি পিশুর বলেন, “যখন কোন দেশে কর্মক্ষম লোক প্রচলিত মজুরিতে কাজ করতে রাজি থাকা সত্ত্বেও যোগ্যতা অনুসারে কাজ পায় না, তখন এ অবস্থাকে বেকারত্ব বলে।” বেকারত্ব হলো একজন ব্যক্তির অনিচ্ছাকৃত অবসর, যিনি প্রচলিত মজুরিতে কাজ করতে চান, কিন্তু কাজ পান না।
পৃথিবীর আদি ইতিহাস থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে জানা যায় যে, মানুষ তার আর্থ-সামাজিক সমস্যা ও তার সমাধানকল্পে ব্যাপক চিন্তা-গবেষণা চালিয়েছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী এবং প্রধান প্রধান ধর্মগুলোও নানারকম উপায় খুঁজে বের করেছে। মানব মস্তিষ্কপ্রসূত সেসব উপায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার অথৈ গহবরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। বেকারত্বের প্রকৃতি অনুসারে একে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হচ্ছে
১. ক্ষণস্থায়ী বেকারত্ব
২. প্রযুক্তিগত বেকারত্ব
৩. মৌসুমি বেকারত্ব
৪. জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বাণিজ্য চক্রজনিত বেকারত্ব
৫. ব্যক্তিগত চরম বেকারত্ব
৬. স্থানগত বেকারত্ব।
নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিষ্ঠিত মদিনা রাষ্ট্রেও বেকারত্ব ছিল। ইতিহাস পাঠে এটাও জানা যায়, মদিনায় বেকারত্বের কারণ ছিল বহুবিধ। যেমন কর্মের সীমিত সুযোগ, শিল্পের বিকাশ না হওয়া, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি, দারিদ্র্য, কুটির শিল্পের দুর্বল অবস্থা, বিনিয়োগে ত্রুটি পূর্ণতা, মূলধনের অভাব, নিরাপদ অভিবাসনের সমস্যা, শ্রমজীবীদের গতিশীলতার অভাব, অলসতা ও শ্রম বিমুখতা, বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা প্রভৃতি। এসব কারণে সদ্য বিকশিত ইসলামি রাষ্ট্রে বেকারত্ব একটি অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় রাসুলুল্লাহ (সা.) বেকার সমস্যা মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নেন এবং সে অনুযায়ী কর্মপন্থা গ্রহণ করেন।
বেকারত্ব দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নবী কারিম (সা.) পদক্ষেপ গ্রহণ করে প্রথমে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছেন। কারণ এর সঙ্গে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা জড়িত। কঠোর সাধনা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষ বেকারত্ব দূর করবে, নিজেদের পরিশ্রমী ও আত্মপ্রত্যয়ী বানাবে; ইসলামের চাওয়া এটাই। কোরআনে কারিম এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) এর শিক্ষা, দেখানো কর্মপন্থা ও অনুপ্রেরণা অনুযায়ী এ উপায়কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো:
উপার্জনের নীতি: কোনো অবস্থাতেই বেকার থাকা যাবে না। কোরআনে কারিমে, “প্রত্যেক নামাজিকে আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করতে আদেশ করা হয়েছে” (সুরা জুমআ: ১৩)। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, “নিজ হাতে উপার্জনকারী আল্লাহর বন্ধু। যে ব্যক্তি চেষ্টা করবে, সে রিজিকের সন্ধানে জমিনে ছড়িয়ে পড়বে এবং সে রিজিক পাওয়ার যোগ্য, আর যে অলস ভঙ্গিতে বসে থাকে, সে বঞ্চিত হওয়ারই যোগ্য।”
কাজ করার নীতি: ইসলামে কাজকে পুণ্য এবং অলসতাকে পাপ গণ্য করা হয়েছে। কোরআনে কারিমে নবী কারিম (সা.) কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, “আর আপনি বলে দিন, তোমরা কাজ করে যাও। আল্লাহ তোমাদের কাজ দেখবেন আর দেখবেন রাসুল ও মুমিনরা” (সুরা তাওবা: ১০৫)। হযরত দাউদ (আ.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, “‘হে আল্লাহ! নিজের হাতে কামাই করার জন্য আমাকে রোজগারের একটি পথ খুলে দাও।’ আল্লাহ তায়ালা তার প্রার্থনা কবুল করলেন, কঠিন লোহাকে মোমের মতো নরম করে দিলেন, যাতে করে তিনি যুদ্ধাস্ত্র ইত্যাদি লোহা উদগত পণ্য তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে পারেন”’ (সহিহ্ বুখারি)। নবী কারিম (সা.) বলেন, “শ্রমজীবীরা আল্লাহর বন্ধু।” ইসলামে বৈরাগ্যবাদ, সন্ন্যাসবাদ এবং ব্রহ্মচর্চাকে নিন্দা করা হয়েছে। “যারা জীবিকা অর্জনের জন্য কোনো কাজ না করে সব সময় শুধু ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকে, তাদের যারা খাদ্য পানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী জোগান দেয় তারা প্রথমোক্তদের চেয়ে উত্তম বলে নবি কারিম (সা.) স্বয়ং বর্ণনা করেছেন” (সুনানে তিরমিজি)।
বৈরাগ্যতা পরিহার: বিভিন্ন ধর্ম বৈরাগ্যবাদের উৎসাহ দিয়ে মানুষকে সমাজ-সংসার থেকে আলাদা করে রেখেছে। সেখানে রাসুল (সা.) বলেন, “ইসলামে কোন বৈরাগ্য নেই” (আবু দাউদ: ১৪৬৯)। বৈরাগ্যবাদ বেকারত্ব সৃষ্টি করে। আল্লাহ তায়ালার প্রদত্ত পূর্ববর্তী ধর্মগুলোতেও বৈরাগ্যবাদের স্থান ছিল না। বরং এটা এ সময়কার ধর্মাবলম্বীদের নিজস্ব সৃষ্টি। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, “এবং বৈরাগ্যকে তারা সৃষ্টি করে নিয়েছিল, যার নির্দেশ আমরা তাদের দেইনি” (সুরা হাদিদ)। শুধু নিষেধাজ্ঞাই নয় বরং ইসলামের গোটা জীবন প্রণালী মানুষকে সমাজ-সংসার, রাষ্ট্র, পরবর্তী প্রজন্মের লালন-পালন ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের প্রতি উৎসাহিত করেছে। নির্দেশ প্রদান করেছে। যা প্রতিটি মানুষকে কর্মমুখর করে তোলে।
লেখক: কেন্দ্রীয় কর্মসংস্থান বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন।