ইসলাম কেবলই একটি ধর্ম নয়, বরং দ্বীন এবং পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত একজন মানুষের জীবানাচরণ, রীতি নীতি কেমন হওয়া উচিত, স্বল্প পরিসরের এ জীবনকে কিভাবে পরিচালিত করলে একজন মানুষ ইহকালে সুখময় জিন্দেগী এবং পরকালে মুক্তি লাভ করতে পারে তার একটি নিঁখুত ভারসাম্য পূর্ণ বিধান দিয়েছে ইসলাম। ইসলামে রয়েছে একটি স্বচ্ছ সুন্দর ও সুস্থ সংস্কৃতি। যার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের জীবনকে সুন্দর করা, সুখ শান্তিময় ও কল্যাণময় করা।
সংস্কৃতির পরিচয়: সংস্কৃতি শব্দটি সাধারণত সাকাফাহ, তাহ্যিব, তামাদ্দুন বা কালচারের প্রতিশব্দ। আরবিতে যাকে বলা হয় সাকাফাহ্ । ইংরেজিতে culture.
ইসলামী সংস্কৃতি পরিচয়: ইসলামী জীবন দর্শনের আলোকে মানুষের ব্যবহারিক জীবন ও পরিবেশে যে সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছে তাই ইসলামী সংস্কৃতি। ইসলামী সংস্কৃতিতে ইসলামী মূল্যবোধ, আকিদা-বিশ্বাস ও আচরণিক কার্যাদি সবই ইসলামী শরিয়াতের অনুকূলে থাকে। শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য শিল্প ইত্যাদি ইসলামী ভাবধারায় গড়ে উঠে। ইসলামী সংস্কৃতিতে বেহায়াপনা, নির্লজ্জতা, ধোঁকাবাজি করা, অশ্লীলতা ও উলঙ্গপনার কোন স্থান নাই। মার্জিত রুচিশীল ও পরিশীলিত জীবনাচার হল ইসলামী সংস্কৃতি ।
মানুষের জীবনে সংস্কৃতির প্রভাব: মানুষ কোথাও একত্রে বসবাস করবে অথচ তার কোন সংস্কৃতিই থাকবে না, এটা অসম্ভব; অন্তত এরূপ এক মানব-সমষ্টির অস্তিত্ব ধারণাই করা যায় না। এমন কি দুনিয়ার ও লোক-সমাজের সাথে সর্বপ্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে যে ব্যক্তি গভীর বনে এক নিভৃত কোণে বসে আছে, যে মনে করে নিয়েছে যে, সে দুনিয়ার সব নিয়ম-নীতিকেই পরিহার করে চলেছে, মূলত সেও অবচেতনভাবে অন্য লোকদের কাছ থেকে নেওয়া কিছু না কিছু নিয়ম-নীতি অবশ্যই পালন করে চলছে। সে তা স্বীকার করুক আর নাই করুক। এভাবে মনের ও মানসিকতার যে প্রতিফলন ঘটে সমগ্র পরিবেশের ওপর আমাদের ভাষায় তাকেই বলি সংস্কৃতি। একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠে মানুষের জীবন। মোট কথা প্রত্যেকের পরিচয় তার সংস্কৃতির মাধ্যমেই ফুটে ওঠে।
যেমন এক মুসলমান ভাইয়ের সাথে অন্য কোন মুসলমান ভাইয়ের সাক্ষাৎ হলে তাকে সালাম প্রদান এবং মুসাফার মাধ্যমে সাক্ষাৎ করা হল ইসলামী সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বর্তমানে বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে মুসলমানের এই অভিবাদনের সংস্কৃতি হায়-হ্যালোতে চালু হয়েছে। যা মুসলিম সংস্কৃতিতে বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাব।
আখেরাতের সফলতার জন্য ইসলামী সংস্কৃতির পূর্ণ অনুশীলন: ইসলামী সংস্কৃতিতে ইসলামী মূল্যবোধ, আকিদা-বিশ্বাস ও আচরণিক কার্যাদি সবই ইসলামী শরিয়াতের অনুকূল থাকে। শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য শিল্প ইত্যাদি ইসলামী ভাবধারায় গড়ে উঠে। ইসলামী জীবন বোধের বিপরীতে কোন আচার-আচরণ ও কৃষ্টি কোন মুসলমান গ্রহণ করলে তা ইসলামী সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হয় না। বরং বিজাতীয় অনুকরণ, কুসংস্কার, বিদআত ও ক্ষেত্র বিশেষে শিরক হিসেবে আখ্যায়িত হয়। ইসলামী সংস্কৃতিতে বিজাতীয় অনুকরণ নিষিদ্ধ। মহানবী (স.) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি অপর জাতির অনুসরণ করবে সে সেই জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হবে।’’ (মুসনাদে আহমদ)। সুতরাং একজন মুসলিম হিসেবে আখেরাতের সফলতার জন্য ইসলামী সংস্কৃতির পূর্ণ অনুশীলন করা দরকার। কারণ ইসলামী সংস্কৃতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য প্রস্তুত করা।
শ্রমিক ময়দানে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের গুরুত্ব: অন্ধকারাচ্ছন্ন আরবে প্রতিপক্ষের বিপরীতে রাসুল (সা.) বলেছিলেন তোমরা কাফির মুশরিকদের নিন্দা চর্চার জবাবে বাক যুদ্ধে অবতীর্ণ হও কেননা তীরের ফলার চেয়েও তা আরও বেশি আহত করে তাদের। আমরা জানি আরবে সে সময় বিখ্যাত অনেক কবি সাহিত্যিকের জন্ম হয়েছিলো। কোটি কোটি ডলার খরচ করে পাশ্চাত্যের দেশগুলো প্রতি বছর সিনেমা তৈরি করে আর সেই সিনেমায় মদ, নারীর ব্যবহার এমন ভাবে ফুটিয়ে তোলে যুব সমাজ সেটাকেই কালচার কিংবা আর্ট হিসেবে নিজের মধ্যে চর্চা করে যার ফলে সমাজে বেহায়াপনা, ব্যাভিচার, খুন-ধর্ষণের মতো অপকর্ম গুলো বেড়েই চলেছে। ইসলামী সংস্কৃতির অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো মানবতার সম্মান। মানুষ মানুষে নেই কোন তারতম্য। উঁচু-নিচু বিভেদ মানবতার পক্ষে অপমানস্বরূপ। সমাজের সব মানুষই সমান মর্যাদা ও অধিকার পাওয়ার যোগ্য। ইসলামী সংস্কৃতির দৃষ্টিতে ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, উচ্চ পদাধিকারী ও নিম্নপদস্থ কর্মচারী ইত্যাদির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আবার বিজাতীয় সংস্কৃতিতে আমরা লক্ষ্য করি শ্রেণি বিভাগ তৈরি করে সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। কমিউনিজম চালু করে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র ও পারিবারিক জীবনের মর্যাদাকে গুরুত্বহীন করে দেওয়া হয়েছে। নারী-পুরুষ, বালক-শিশু, যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকল মানুষই সরকারের মালিকানা। কাজেই সরকারি নির্দেশ মেনে চলার কোনরূপ দ্বিধা নেই সে সমাজে। জমি-জায়গা, অর্থ-সম্পদ, ও ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই সেখানে ব্যক্তির মালিকানা থেকে কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় সোপর্দ করা হয়েছে। কিন্তু ইসলামী সংস্কৃতি এ অমানবিক কর্তৃত্বের প্রশ্রয় দেয়নি।
বার্ষিক উৎসবের নামে শিল্প প্রতিষ্ঠানে নারী পুরুষ এক করে নাচ, গান, নাটিকা, কনসার্টের নামে নগ্নতা, বেহায়াপনা, উলঙ্গপনা, অশ্লীল নৃত্যর আনন্দ করছে যা কোন সভ্য সমাজের সংস্কৃতি নয় বরং তা অপসংস্কৃতি। এই সমস্ত অপসংস্কৃতি থেকে শ্রমজীবীদের ইসলামী সংস্কৃতির ছায়াতে নিয়ে আসতে হলে শ্রমিক ময়দানে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের গুরুত্ব অপরিসীম। আর এটা এমন কোন বিষয় না, যে কেউ বললো আর হয়ে যাবে। এখানে টাকা থাকলেই হবে না আবার লেখক কিংবা অভিনেতা থাকলেই হবে না। এখানে দরকার একটি দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা।
ইসলামী সংস্কৃতি বিপ্লবের জন্য করনীয়:
১. প্রথমত একটি সংগঠন বা প্ল্যাটফরম তৈরি করা।
২. প্রতিভা বিকশিত করার ক্ষেত্র, মিডিয়া, চ্যানেল কিংবা প্রযুক্তির ব্যবহার।
৩. প্রতি বছর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে লেখক, অভিনেতা ইত্যাদি সংস্কৃতি কর্মী বাছাই করা সেই বাছাইকৃতদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
৪. মুসলিম প্রধান দেশ গুলোর কালচারাল প্রোগ্রাম গুলো সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখা তথ্য আদান প্রদান করা।
৫. বিশেষ করে ইরানি চলচিত্রকে স্টাডি করে দেখা।
৬. লেখক তৈরির জন্য স্ব-রচিত লেখা পাঠের আড্ডা, সে আড্ডায় তুলনামূলক অভিজ্ঞ লেখক কর্তৃক লেখার পর্যালোচনা।
৭. বাছাই করা লেখার জন্য সম্মানী ও জাতীয় প্রচার মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করা।
৮. বিভিন্ন জাতীয় দিবস গুলোকে সামনে রেখে নাটক, সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখাসহ ছড়া, গান, কবিতা ও উপন্যাস লেখার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির জন্য কর্মসূচি হাতে নেওয়া।
৯. হুট করে একটা কর্মসূচি কে সামনে রেখেই গান, সিনেমা, নাটক ইত্যাদির শুটিং কিংবা প্রচারে মনযোগ না দিয়ে বরং লেখার জন্য লেখককে, বাছাইয়ের জন্য দায়িত্বশীলবর্গকে, শুটিং এর জন্য প্রতিষ্ঠান কে সর্বশেষ চূড়ান্ত কাটছাটে সেন্সর বোর্ড ও প্রচার মিডিয়াকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। তবেই ভালো কিছু আশা করা যাবে।
১০. আমাদের মনে রাখতে হবে নিছক একটা গান, কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস কিংবা নাটক, সিনেমা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের উদ্দেশ্য মানুষ কে পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। এখানে যারা শ্রম দিবেন তাদের দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা কে মনে রাখতে হবে।
যে কোন বিপ্লবে সংস্কৃতির বিপ্লব সহায়ক ভূমিকা হিসেবে কাজ করে। আমরা জানি নীলকর, ব্রিটিশ কিংবা ফ্যাসিস্ট যে কোন অত্যাচারীর ভীত কাপিয়ে দিতে পারে একটা কবিতা একটা গান কিংবা উপন্যাস, গল্প, সিনেমা। আর এর জন্য চাই সাংগঠনিক পৃষ্ঠপোষকতা, প্রয়োজনীয় উপায় উপকরণ সরবরাহ।
শ্রমিক অঙ্গনে ইসলামী সাংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় আমাদের যাত্রা: শ্রমজীবী মানুষের মাঝে ইসলামী সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশের তাগিদে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পনার আলোকে ‘কল্যাণ সাংস্কৃতিক সংসদ’ নামে কেন্দ্রীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ, শুদ্ধ বিনোদন চর্চা ও পরিশীলিত জীবন গঠনের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত আদর্শ সমাজ বিনির্মাণ ও শ্রমজীবী মানুষসহ সর্বস্তরের জনতাকে ইসলামী সংস্কৃতির দিকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে এই সংগঠন কাজ করবে।
সমাপনী: একজন মুমিন ব্যক্তি অপ্রয়োজনীয় কথা কাজ বা যে কোন ধরনের বিষয় কিংবা কর্মতৎপরতায় লিপ্ত হতে পারে না। এ জাতীয় কার্যকলাপ তার জন্য শোভনীয়ও নয়। বিনোদন যদি ইসলামী নীতিমালার আলোকেই সম্পন্ন করা হয় এবং এর উদ্দেশ্যও হয় ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করা, তবেই তা বৈধ। সেই বৈধ কাজটি কল্যাণ সাংস্কৃতিক সংসদ শ্রমজীবী মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আমরাই এটা প্রত্যাশা করি।
লেখক: কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সম্পাদক, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন।