সন্তান মানেই আদরের, ভালোবাসার। মালিক-শ্রমিক, ধনী-গরীব, বাদশাহ-ফকিরের হিসেব নিকেশ এখানে খাটে না। সব একাকার। মানব জীবনের প্রথম ধাপকে শিশুকাল বলে আখ্যায়িত করা হয়। এমনকি মায়ের গর্ভে অবস্থান রত সন্তানকেও শিশুরূপে পরিগণিত করা হয়ে থাকে। জীববিজ্ঞানের ভাষায় মানব সন্তানের জন্ম থেকে বয়ঃসন্ধির মধ্যবর্তী পর্যায়ের রূপ হচ্ছে শিশু। চিকিৎসা শাস্ত্র অনুযায়ী, মাতৃগর্ভের ভ্রæণ, অ-ভ‚মিষ্ঠ সন্তানই শিশু। যৌবনপ্রাপ্ত কিংবা বয়ঃসন্ধিক্ষণে প্রবেশ করেনি, এমন ব্যক্তিই শিশু বলে পরিচিত। মা-বাবার ভালোবাসা ও রক্ষণাবেক্ষণে বেড়ে ওঠে শিশু, হয়ে ওঠে সমাজ, দেশরক্ষার হাতিয়ার। অথচ সমাজে অনাথ শিশু, অবৈধশিশু, ছিন্নমূল-পথশিশু ইত্যাদি ভাগ্যাহত শিশু আমাদের চোখে পড়ে। জন্মের পর মা-বাবা হারানো সন্তানকে অনাথ বা এতিমশিশু, বিবাহ বহির্ভূত নর-নারীর সন্তান অবৈধ, ঠিকানা বিহীন রাস্তায় বেড়ে ওঠা শিশুরা ছিন্নমূল বা পথশিশু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এ সন্তানরা সমাজের সবচেয়ে ভাগ্যাহত মানবকুঁড়ি। অথচ আজকের শিশুই আগামী দিনের পরিপূর্ণ মানুষ, সমাজচিন্তক, সভ্যতার নির্মিতা।
শিশু অধিকার ও শিশুশ্রম
জাতিসংঘের সনদ এবং বাংলাদেশ সরকারের শিশুনীতি অনুযায়ী ০-১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকল মানবসন্তানকে শিশু বলা হয়েছে। এদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ ভাগ শিশু, তন্মধ্যে ১৫ শতাংশ হচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত শিশু। সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের সংখ্যার সঠিক কোন জরিপ না থাকলেও, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দশ লাখের অধিক পথশিশু আছ। যারা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
বিশ্বের প্রতিটি দেশেই শিশু অধিকার একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত। জাতিসংঘ সনদে শিশু অধিকার সংক্রান্ত নীতিমালা ঘোষণা করা হয়েছে। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশও এই সনদে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। অধিকাংশ দেশেই অভিভাবকের দিকনির্দেশনায় কিংবা রাষ্ট্রের বাধ্যতামূলক শিক্ষানীতির আলোকে শিশুরা বিদ্যালয়ে গমন করে। ক্ষুদে শিশুরা খেলার ছলে শৈশবকালীন শিক্ষাকে আনন্দময় করে তোলে। কিন্তু অনুন্নতদেশে প্রায়শঃই শিশুদের জীবনযুদ্ধে অর্থ উপার্জনে শ্রমকার্যে অংশ নিতে হয়। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে শিশুদের সার্বিক পরিস্থিতি ততটা উন্নত নয়। দারিদ্র্যের কষাঘাতে বহু শিশু বেঁচে থাকা, শারীরিক-মানসিক বিকাশ ও বিনোদনের অধিকার থেকে বঞ্চিত। অনেকক্ষেত্রে অভাবের তাড়নায় অভিভাবকরা তাদের শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করেন। আবার ছিন্নমূল শিশুরা নিজেরাই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নানা অপরাধেও জড়িয়ে পড়ে তারা। শিশুদের মাঝে মাদকাসক্তির চিত্র ভয়াবহ। শিশু অধিকার ফোরামের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় ৮৫ ভাগ পথশিশু মাদকাসক্ত। ১৯ শতাংশ হেরোইন, ৪৪ শতাংশ শিশু ধূমপানে, ২৮ শতাংশ ট্যাবলেট, ৮ শতাংশ ইঞ্জেকশনে আসক্ত, ৮০ শতাংশ শিশু কাজ করে জীবন টিকিয়ে রাখতে; ২০ শতাংশ শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়; ৪৬ শতাংশ মেয়ে শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়; ১৪.৫ শতাংশ শিশু সার্বিকভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। অভিভাবকহীন এ শিশুদের দিয়ে অনেকেই করাচ্ছে ভয়ংকর অপরাধ কর্মকাণ্ড। সামান্য কিছু টাকা বা দু’বেলা খাবারের জন্য চুরি, ছিনতাই, গাড়িতে আগুন, বোমা মারা, মাদক চোরাচালানসহ নানা রকম অপরাধকর্মে জড়িয়ে যাচ্ছে শিশুরা।
শিশুশ্রম একটি সামাজিক ব্যাধি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে শিশুশ্রম বলতে বুঝানো হয়েছে “যখন কোনো শ্রম বা কর্ম পরিবেশ শিশুর দৈহিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা শিশুশ্রম হিসেবে গণ্য হবে।” বাংলাদেশ জাতীয় শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুদের কাজ করানো হলে তা শিশু শ্রমের অন্তর্ভুক্ত হবে।
বিশ্ব শ্রম সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বে ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ১২০ মিলিয়ন। শিশুশ্রমের দিক থেকে বিশ্বের ১৪০টি দেশেরমধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। আইএলও’র আরও এক সমীক্ষায় জানা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে ১৮ বছরের নিচে মোট শিশু শ্রমজীবীর সংখ্যা ৬৩ লাখ এবং এ সংখ্যা পৃথিবীর মোট শ্রমজীবী শিশুর ৫ শতাংশ। কৃষি ও শিল্পকারখানার কাজে নিয়োজিত রয়েছে ৬৫ শতাংশ শিশু। ৩০ শতাংশ শিশু পরিবারের সহায়তা দিতে কাজ করে থাকে। দূষিত কর্মপরিবেশে কাজ করে চলেছে ১৭ শতাংশ শিশু। বিশ্বে প্রায় সাড়ে ১১ কোটি শিশুশ্রমিকের অর্ধেকেরও বেশি খনির কাজ থেকে শুরু করে নির্মাণ, কৃষি ও শিল্প উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রমিকের সংখ্যা অনেক বেশি। বিশ্বে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত মোট শিশুর ৫ দশমিক ৬ শতাংশই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের দারিদ্র্যই মূলত শিশুশ্রমের জন্য দায়ী। কারখানার নানা ধরনের শ্রমের কাজ করানো হয় ৮ থেকে ১২ বছর বয়সের শিশুদের দিয়ে। বাংলাদেশে শতকরা ৯৪ ভাগ শিশুশ্রমিক কৃষি এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে। প্রায় ৪৭ লাখশিশু শ্রমিকের মধ্যে ৫ থেকে ১৪ বছরের শিশুর সংখ্যা বেশি।
বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশনের (বিএলএফ) পরিচালিত জরিপে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র কেরানীগঞ্জেই সাড়ে নয় হাজার ছোট-বড় কারখানায় মোট শ্রমিক দুই লাখ ৩০ হাজার। এর মধ্যে ৪৭ শতাংশ শ্রমিকের বয়স ১৭ বছরের নিচে। এরমধ্যে পাঁচ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার এবং ৫-১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা প্রায় এক লাখ ২০ হাজার। যেসব শিশু এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করে তারা বেশিরভাগই দরিদ্র পরিবারের। এদের মধ্যে আবার ৯০ শতাংশ ঢাকার বাইরে থেকে আসা। ফলে পরিবারের আয়ের জন্য শিশুদের কাজে পাঠাতে হয়। অন্যদিকে সমান কাজ করলেও শিশুদের বড়দের মতো পারিশ্রমিক দিতে হয় না। এই সুযোগেও অনেকে শিশুদের কাজে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। শিশুদের কাজের অনিরাপদ পরিবেশ, কাঠামোগত মজুরি নির্ধারণ না করা, কর্মঘণ্টা নির্ধারিত না থাকার বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। স্বাভাবিক মৌসুমে শিশুরা প্রতিদিন গড়ে ১৩ ঘণ্টা করে। আর মৌসুমের সময় কমপক্ষে ১৬ ঘণ্টা কাজ করে। এতে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
‘বাংলাদেশে শিশুশ্রমের অবস্থান’ শীর্ষক এক সমীক্ষায় শিশুশ্রমের কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে দারিদ্র্য, পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি না থাকা, বাবা-মা পরিত্যাজ্যতা, অসেচতনতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অভিবাসন প্রভৃতি। অন্যদিকে পেটের জ্বালা, অভাব, লেখাপড়ার খরচ দিতে ব্যর্থ হওয়া এবং সংসারের অসচ্ছ্বলতার গ্লানি একজন বাবা-মাকে তাদের শিশুসন্তানকে শ্রমে নিয়োজিত করতে বাধ্য করে। এছাড়া পিতৃ-মাতৃহীন অনাথ শিশুরাই বহুলাংশে শিশুশ্রমের সঙ্গে যুক্ত। বাস, লঞ্চঘাট, হোটেল-মোটেল, ইটভাটা, মোটর গ্যারেজ, বাসাবাড়ি, কল-কারখানা, তামাক শিল্প, চামরা শিল্প, স্টেশন বা টার্মিনালের কুলি, নির্মাণ শ্রমিক, চিংড়ি হ্যাচারি, লবণ কারখানা, দেশের নানা ধরনের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ঝালাই, স্প্রে-পেইন্টিং, অটোমোবাইল গ্যারেজ, প্লাস্টিকদ্রব্য তৈরির কারখানায় কাজ করছে শিশুরা। শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই দেড় লাখের বেশি শিশু বিপজ্জনক কর্মকাণ্ডে জড়িত। কিন্তু বাস্তবতা যে সম্পূর্ণ ভিন্ন তা বোঝার জন্য পরিসংখ্যানের প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশে শিশুরা সাধারণত কৃষি, কলকারখানা, গণপরিবহন, আবাসন, খাবারের দোকান, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ইটভাটা এবং নির্মাণকাজে কাজ করে। কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন দরিদ্রতার কারণে শিশুশ্রম দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।
শ্রমিক পরিবারের শিশুপ্রসঙ্গ
বাংলাদেশে খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। শ্রমবিনিয়োগের মাধ্যমেই জীবন-জীবিকার চাকা ঘুরিয়ে চলেন বেশিরভাগ মানুষ। তাদের অনেকেই হ্যান্ড টু মাউথ। কারো কারো আর্থিক সামর্থ কিছুটা স্বচ্ছ¡ল হলেও পরিশ্রমের মাত্রা এতোটাই বেশি যে, পরিবারের সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। জীবিকার সন্ধানেই মৌমাছির মতো ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। বর্তমান বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় সন্তানদের লেখাপড়ার পেছনে যে ধরনের বিনিয়োগ প্রয়োজন তা করার সুযোগ হয়ে ওঠে না। ফলে ভবিষ্যত প্রজন্মের এ সম্ভাবনাময় স্বপ্ন মুকুলেই ঝরে যায়।
শ্রম বাজার এখন দারুণভাবে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনার নিয়েও নিরাপত্তার দেখা মেলে না। চাকরির গ্যারান্টিও নাই। ফলে শ্রমিকদের মনস্তাত্বিক অবস্থা খুব ভালো থাকে না। পুরুষদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা না থাকলে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। এ কারণে দাম্পত্য কলহ অনেক বেশি সৃষ্টি হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে তাদের সন্তানদের উপর। বিভিন্ন কারণে মা-বাবার মাঝে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে, এতে শিশুর জন্য এ ভালবাসা হয়ে ওঠে অনিশ্চিত। বিচ্ছেদের পর বেড়ে উঠতে হয় মা কিংবা বাবার একক ভালবাসায়। অনেকক্ষেত্রে উভয়ের ভালবাসা থেকেই বঞ্চিত হতে হয় শিশুকে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য বা তৃতীয় পক্ষের দায়িত্বে বেড়ে উঠে শিশু। শিকার হয় লাঞ্ছনার। স্বজনহীন নির্দয় এক পরিবেশই হয়ে উঠে শিশুটির একমাত্র ঠিকানা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ১৭ শতাংশ বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েছে। ২০২০ সালে দুই সিটিতে ১২ হাজার ৫১৩টি ডিভোর্সের ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ সালে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে ৪ হাজার ৫৬৫টি বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে (সূত্র-২৬ জুন, ২০২১ কালের কণ্ঠ)। ব্যাপক হারে বিচ্ছেদের ঘটনায় অসহায় শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ কমিয়ে আনা, যাতে শিশুরা তাদের জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়।
অকিাংশ শ্রমিক সামান্য বেতনে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। ফলে ছোটখাটো বাসাবাড়িতে একক ইউনিটে থাকতে হয়। অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই আয়ের পথ বেছে নিতে হয়। ফলে তাদের শিশুরা একাকিত্বের মাঝেই বেড়ে ওঠে। যৌথ পরিবারে কিছু সুবিধা থাকে, একক পরিবারে তা হয়ে উঠে না। সঠিক যত্ম নেওয়া সম্ভব হয় না, সৃষ্টি হয় তাদের নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। অনেকক্ষেত্রে শিশুদের যৌন হয়রানিরও শিকার হতে হয়। কিছু কিছু পরিবার ডে-কেয়ার সেন্টারের সহায়তা নিয়ে থাকে। যৌথ পরিবারে শিশুর সমস্যায় সবাই এগিয়ে আসে। শিশুরা একাকীত্বে ভোগে না। লালন পালন সমস্যা হয় না। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে। খেলাধুলার পরিবেশ থাকে। মিলেমিশে থাকার মানসিকতা তৈরি হয়। পাড়া-মহল্লায় খেলারমাঠগুলো ক্রমেই কমে আসছে। বিনোদন কেন্দ্র যা আছে, তাও অপ্রতুল। অথচ খেলাধুলার পরিবেশ ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো শিশুর শারীরিক ও মানসিক গঠনের সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এ ধরনের সুযোগ থেকে শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে তাদের বিকশিত হবার সুযোগ ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশে দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে নগরায়ন। দুর্যোগের পাশাপাশি কাজের সন্ধানে শহরে আসে গ্রামের মানুষ। আগামী ৩০ বছর পর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই বাস করবে শহরে। শহরমুখি এ জনস্রোত শ্রম বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে তুলেছে জীবন ও জীবিকার সহজ পথ।
শিশুদের মানবিক বিকাশ প্রয়াস
শিশুদের মানবিক বিকাশের জন্য বৈরী পরিবেশ আজ নতুন নয়। শিশুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্ববাসী। তাইতো বিশ্বব্যাপী নানামুখি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। শিশু অধিকার নিশ্চিত করতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে শিশু দিবস পালিত হয়ে আসছে। প্রথমবার ১৯২০ সালের ২৩ এপ্রিল তুরস্কে শিশু দিবস পালিত হয়েছিল। জাতিসংঘ ১৯৫৪ সালের ২০ নভেম্বর দিনটিকে শিশু দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেই থেকে বিভিন্ন দেশে ২০ নভেম্বরকে বিশ্ব শিশু দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়। আবার আন্তর্জাতিক শিশু দিবস জুন ১ তারিখে উদযাপন করা হয়। তবে বিভিন্ন দেশে নিজস্ব নির্দিষ্ট দিন আছে শিশু দিবসটিকে উদ্যাপন করার। বাংলাদেশে, ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ১৭ মার্চকে শিশু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবারকে বিশ্ব শিশু দিবস পালন করা হয়। শিশু দিবসগুলোতে শিশুদের অধিকার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, বাস্তবায়নে কাজও করা হয়। তারপরও পরিপূর্ণ শিশু অধিকার বাস্তবায়ন হয় না বিশ্ব জুড়েই। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শিশুদের অধিকার রক্ষা এবং ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম দূর করার জন্য ২০০২ সাল থেকে ‘বিশ্ব শিশুশ্রম বিরোধী দিবস’ পালন করে আসছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর ১২ জুন এ দিবসটি পালন করা হয়। গত দুই দশকে শিশুশ্রম কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও, সাম্প্রতিক তথ্য দেখায় যে শিশুশ্রম নিরসনের বৈশ্বিক অগ্রগতি ২০১৬ সাল থেকে থমকে গেছে। কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্বব্যাপী আরও লাখ লাখ শিশুকে শিশুশ্রমের ঝুঁকিতে ফেলেছে।
জাতিসংঘ ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নির্মূল করার জন্য কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়াও এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ৭ জোরপূর্বক শ্রম নির্মূল, আধুনিক দাসপ্রথা ও মানব পাচারের অবসান এবং নিকৃষ্টতম শিশুশ্রমের নিষেধাজ্ঞা ও নির্মূল করার জন্য অবিলম্বে এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলেছে। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক ২ শিশু শ্রমিকদের নিয়োগ ও ব্যবহার, শোষণ, পাচার এবং সকল প্রকার সহিংসতা ও নির্যাতনের অবসান ঘটানো এবং সকল প্রকার শিশুশ্রমের অবসান ঘটানোর কথা উল্লেখ করেছে।
ইউনিসেফ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত অতিমাত্রায় বিভক্ত। সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় রয়েছে ১৩০টি কর্মসূচি যেগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটির সাথে অপরটি সংযুক্ত নয়। এসব কর্মসূচির লক্ষ্যসমূহ একটির সাথে অন্যটি মিলে যায়, এতে বাজেট কম এবং এদের আওতাও অপ্রতুল। তবে ২০১৩ সালে কার্যকর হওয়া শিশু আইন, বাংলাদেশের সব জেলায় শিশু আদালত গঠনের বিধান রেখে সংসদে শিশু আইন সংশোধন বিল ২০১৮ পাস হয়েছে। দায়রা আদালতে যেসব ক্ষমতা প্রয়োগ ও কার্যাবলী সম্পাদন করতে পারে, আইন সংশোধনের ফলে শিশু আদালতও সে ক্ষমতার অধিকারী হলো। শিশুদের কল্যাণ, সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করে তাদের জাতি গঠনের উপযোগী করে গড়ে তোলার এটা একটা ভালো প্রয়াস বলে মনে হয়েছে।
বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে শিশুশ্রম বন্ধ করা একটি কঠিন কাজ। প্রতি বছর ১২ জুন ঘটা করে শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালিত হলেও এখনো শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখা সম্ভব হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পেটের জ্বালা মেটানোর জন্যই তারা কাজে নামে। অভাব না আইন দিয়ে আটকানো যায়, আর না উপদেশ দিয়ে। দরিদ্র শিশুদের অভিভাবকদের কাজের ব্যবস্থা করা; এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ব্যবসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। অন্যজনের শিশুকে নিজের সন্তান মনে করা, বেশি বেশি করে তদারকির ব্যবস্থা করা, কোথায় শিশুশ্রম হচ্ছে তা খুঁজে বের করা, শিশুদের দিয়ে কাজ করায় এমন মালিকের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা, সর্বোপরি শিশুশ্রম নিরসনে যেসব আইন আছে, তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিশুশ্রম নামক অভিশাপ দূর করা সম্ভব হবে বলে মনে হয়। সরকার ঘোষিত বিপজ্জনক শিশুশ্রম তালিকায় স্থানীয় পোশাক কারাখানার শিশু শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করা, শিশুদের স্কিল ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা, শিশুর অভিভাবকদের সরকারের সহায়তা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা, এসব কারখানাকে ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে গণ্য করা। সেইসাথে কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিয়োগদানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে কার্যকর এবং গৃহকর্মে নিয়োগ ও ভাঙ্গারি খাতকেও ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। শিশুশ্রম প্রতিরোধ কার্যক্রমকে সফল করে তুলতে অবিলম্বে শিশুনীতি বাস্তবায়ন, আইএলও কনভেনশন ১৮২ পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও ১৩৮ অনুসমর্থন করাসহ পথশিশু, ছিন্নমূল শিশু ও শিশু শ্রমিকদের পুনর্বাসন ও কল্যাণে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কলকারখানার বিকাশ, উৎপাদন বৃদ্ধি ও ব্যাপক কর্মসংস্থানের প্রসার ছাড়া দারিদ্র্য-বিমোচন সম্ভব নয়। আবার দারিদ্র্য নির্মূল করা ছাড়া শিশুশ্রমও বন্ধ করা যাবে না।
পরিশেষে বলা যায়, সবার জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত এখনও সম্ভব হয়নি। স্যানিটেশন ব্যাবস্থার অনেক উন্নতি সত্ত্বেও, সুরক্ষিত টয়লেট ও হাত ধোয়ার সুবিধা পাচ্ছে না অনেকেই। এর সাথে আছে পুষ্টি, শিক্ষা, খেলাধুলা এবং শিশুর শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা। প্রশিক্ষণের অভাবে শিশুদের মধ্যে প্রতিবন্ধিতা শনাক্ত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বাংলাদেশের বেশিরভাগ স্কুলে কিশোরি ও প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য টয়লেট সুবিধা নেই। মেয়ে শিশুরা নিরাপত্তা এবং যৌন হয়রানির কারণে মাঝেমাঝে পড়ালেখা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থায় রয়েছে অনেক ঘাটতি। শিশুদের সামাজিক সুরক্ষায় প্রয়োজন জরুরি বিনিয়োগ। এর আওতায় আনতে হবে প্রতিবন্ধী শিশুদের। শিশু অধিকার সনদ ও আন্তর্জাতিক চুক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আইনী কাঠামো এবং বিশেষ শিশু নীতি গ্রহণ ও দেশের সকল শিশু, বিশেষ করে দুস্থ শিশুদের কল্যাণ সাধন করা। পাশাপাশি প্রকল্প এলাকায় নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন এবং শোষণ প্রতিরোধকল্পে ইতিবাচক ও সহায়ক সামাজিক আদর্শের অনুশীলন, উন্নয়ন ও সুদৃঢ় করাও প্রকল্পটির অন্যতম প্রধান কাম্য। শিশুশ্রম বন্ধে প্রতিটি জেলা পর্যায় ১৪ বছরের কম শিশুদের সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধান করতে হবে। শ্রমজীবী প্রতিটি শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিশু শ্রম ও অধিকার সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। শ্রমিকদের সন্তানরা যাতে শিক্ষার পূর্ণ সুযোগ পায় সে বিষয়টি মালিকপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। এর বাইরে মজুরি বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যবিষয়ে সচেতনতা এবং শ্রমিকদের মন থেকে কুসংস্কার দূর করা ইত্যাদি বিষয়ে মালিক পক্ষের নজর দিতে হবে। শিশুর পরিবারের পক্ষ থেকেও সচেতনতা আরো বাড়াতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসনই শিশুদের মূল্যবোধের পথে পরিচালিত করতে পারে। মাদকসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে শিশুরা যাতে জড়িয়ে না যায় সেজন্য তাদের ধর্মীয় বিধানের প্রতি মনোযোগী করাতে হবে। তাদের বন্ধু নির্বাচনের প্রতিও খেয়াল রাখতে হবে। সেইসাথে শিশুশ্রম নির্মূলে সামাজিক উদ্যোগ ও সচেতনতা বৃদ্ধির আন্দোলন আরো জোরদার করা প্রয়োজন।
লেখক: কবি ও গবেষক; প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।