ভূমিকাঃ সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিনির্মাণে শ্রমজীবী মানুষের অবদান যে অপরিসীম তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রম ব্যতিরে সম্ভব হতো না। ক্ষুধার্ত বনি আদমের আহার জোটাতে কৃষক-শ্রমিক একদিকে ক্ষেতে-খামারে ঘাম ঝড়িয়ে কৃষিপণ্য উৎপাদন করেছে, আশ্রয়ের জন্য অট্রালিকা নির্মাণ করেছে; অপরদিকে এ শ্রমিকরাই যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য দুনিয়া জুড়ে জালের মত ছড়িয়ে থাকা কংক্রীটের সড়ক ও রেল লাইন তৈরী করেছে। উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে বিদ্যুৎ শক্তিকে কাজে লাগাতে সম্প্রসারণ করেছে বিদ্যুৎ লাইন। হাজারো ভৌত অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে শ্রমজীবী মানুষের কঠোর শ্রমের বদৌলতে। মাটি খুড়ে খনি থেকে স্বর্ণ, তামা, কয়লা, ইউরেনিয়াম উত্তোলন আর প্রতিরক্ষার জন্য চীনের প্রাচীর তৈরি হয়েছে মজলুম শ্রমিকের হাতে। সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও সভ্যতার প্রতিক মিশরে পিরামিড আর আগ্রার তাজমহল এসবই তো শ্রমিকের শ্রমের ফসল। বিত্তবান ও ক্ষমতাদর্পী মানুষের বিলাসিতা ও আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য শ্রমিকদের ত্যাগ ইতিহাস কতটুকু মূল্যায়ন হয়েছে, মানুষের আরাম-আয়েশের জন্য কত উপকরণ তৈরী করেছে, জীবন প্রণালীকে সুগম করতে তৈরী করা হয়েছে কত অবকাঠামো! কিন্তু শ্রমজীবী মানুষ যুগে যুগে শুধুই বঞ্চিত হয়েছে; বিত্তবানদের শোষণ-নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এটা হচ্ছে সভ্যতার একটি ট্রাজেডি। বাংলাদেশের কথা ধরা যাক। আমাদের কৃষক মাঠে ফসল ফলায়; শ্রমিক-মজুর মিলে উৎপাদন করে। নির্মাণ-শ্রমিকদের হাড়-ভাঙা শ্রমে গড়ে উঠছে সুরম্য প্রাসাদ, অফিস-আদালত, বাড়িঘর। নগরীর সৌন্দর্য্যবর্ধন, সড়ক-মহাসড়ক, রেললাইন, ব্রীজ-কালভার্ট সবই নির্মাণ করছে শ্রমিকরা। আমাদের শ্রমিকদের গৌরবের প্রতীক যমুনা ব্রীজসহ আরও হাজারো অবকাঠামো। কিন্তু যে শ্রমিক-মজুরের কষ্টের বিনিময়ে অগ্রগতির চাকা এগিয়ে চলেছে তাদের জন্য সমাজ, সরকার বা রাষ্ট্র কি দিয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে দেশের সংবিধান, রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও সরকারের উন্নয়ন নীতি-কৌশল পর্যালোচনা করতে হবে।
বঞ্চনার ইতিহাসঃ বৃটিশ ওপনিবেশিক শাসনামলে এদেশের মেহনতি মানুষ শোষিত-বঞ্চিত ও নির্যাতিত হয়েছে। প্রাচুর্যে ভরা বাংলাদেশের সম্পদ বৃটিশ বেনিয়ারা লুন্ঠন করেছে। শ্রমিক-কৃষক- মেহনতি মানুষের অধিকার হরণ করেছিল তারা। সা¤্রাজ্যবাদের শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য এদেশের মানুষ লড়াই-সংগ্রাম করেছে। ফলে ওপনিবেশের শৃঙ্খল থেকে দেশবাসী ১৯৪৭ সালে মুক্তি লাভ করে। বড় আশা নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ওপনিবেশিক শাসনের মতই পাকিস্তানী শাসক ও কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠি পূর্ব বাংলার জনগণকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। স্বাধীন পাকিস্তানে মুক্ত বাজার অর্থনীতির ফলে শোষণ ও বৈষম্যের পাহাড় গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক স্বাধিকার ও গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরাচারী শাসনের যাতাকলে পিষ্ট হয় এদেশের মানুষ। কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রত্যাশায় অবতীর্ণ হয় মহান মুক্তিযুদ্ধে। অবশেষে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। বলাই বাহুল্য মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল একটি শোষণহীন গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। আমরা তা কতটুকু পেয়েছি?
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাঃ বাংলাদেশের সংবিধান দেশের জনগণের চেতনা ও আশা-আকাক্সক্ষার একটি প্রতিচ্ছবি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এতে কৃষক-শ্রমিক মেহনতী মানুষের মুক্তির জন্য ১৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেঃ
‘‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষন হইতে মুক্তি দান করা’’।
১৯ (১) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেঃ ‘‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবে’’।
১৯ (২) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেঃ ‘‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে’’।
২০ (২) নং অনুচ্ছেদে বলা রয়েছেঃ ‘‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না এবং সেখানে বুদ্ধিবৃত্তিমূলক ও কায়িক-সকল প্রকার শ্রম সৃষ্টিধর্মী প্রয়াসে ও মানবিক ব্যক্তিত্বের পূর্ণতর অভ্যিক্তিতে পরিণত হইবে’’।
সন্দেহ নেই যে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দলিল ‘‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’’ যথার্থভাবেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের এসব বিধি-বিধান রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে কিন্তু সংবিধানের এসব বাধ্যবাধকতা পরিপালনে বিগত পাঁচ দশকে বিভিন্ন সরকার কতটুকু দায়িত্ব পালন করেছে তা আজ পর্যালোচনা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি- কৌশলঃ সংবিধানে প্রদত্ত এসব দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের জন্য সরকার বিভিন্ন প্রকার নীতি-কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে থাকে। স্বাধীনতার পরে আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে প্রণীত সংবিধানের আলোকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তন করা হয়। প্রত্যাশা ছিল- পাকিস্তান আমলের মুক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বৈষম্য ও অসম বন্টনের অবসান ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক ও সুষম সমাজ ব্যবস্থার পতন ঘটবে। এ লক্ষ্যে ব্যক্তি মালিকানাকে সংকুচিত করে ব্যাপকভাবে কল-কারখানা জাতীয়করণ তথা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করা হয়। সমাজতন্ত্রের তাত্বিক দর্শন অনুযায়ী জাতীয়করণের কর্মসূচী থেকে প্রত্যাশা করা হয়েছিল যে,
(ক) শ্রমিকরা আনুপাতিকহারে মজুরী প্রাপ্তির আশা ছেড়ে দিয়ে কেবল স্বার্থহীনভাবে দক্ষতা ও সততার সাথে কাজ করবে;
(খ) কল-কাখানার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ ও বাজার প্রতিযোগিতার নীতি দ্বারা চালিত না হয়ে দক্ষতা ও সততার সাথে কর্মসম্পাদন করবে;
(গ) সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ তাদের কার্যনির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে অন্যায় সুযোগ নেবে না।
বাস্তব অভিজ্ঞতা হচ্ছে এ সকল প্রত্যাশা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরী পায়নি; ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দক্ষতা ও সততার স্বাক্ষর রাখতে পারেনি এবং সরকারী কর্মকর্তারা অন্যায় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ তথা দুর্নীতি থেকে বিরত থাকেনি। বরং মাথাভারি জনবল কাঠামোর ফলে কারখানাগুলো ন্যূজ হয়ে পড়ে। অস্বচ্ছতা ও লুন্ঠনের প্রক্রিয়া এত ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের প্রবল চাপে জাতীয় স্বার্থ ও ন্যায়-বিচার পিছু হটতে বাধ্য হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের সোনার হরিণ সমাজতন্ত্র সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে পারেনি; বরং বিত্তহীন শ্রমিক শ্রেণি বিত্তহীনই রয়ে গেল। উৎপাদন যন্ত্র ও উৎপাদিত পণ্যের ওপর শ্রমিক শ্রেণির স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের পথও রুদ্ধ হয়ে গেল। ফলে জাতীয়করণ তথা সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদী সমাজ থেকেও অধিকতর নিপীড়নমূলক ব্যবস্থায় পরিণত হয়। এ অবস্থা শ্রমিকদের মনোবল ও শৃঙ্খলাবোধের উপর প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত কল-কারখানাগুলো ক্রমান্বয়ে লোকসান গুনতে থাকে; পুঞ্জিভূত লোকসানের ফলে কারখানাগুলো একে একে বন্ধ হতে থাকে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারও হতাশার স্তরে নেমে আসে।
সাংবিধানিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে কৃষক-শ্রমিক মেহনতী মানুষের কল্যাণে সরকার কর্তৃক ভ্রান্তনীতি গ্রহণের ফলে প্রত্যাশা পূরণ তো দূরের কথা বরং রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পখাতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই দুরুহ হয়ে পড়ে। সরকারী নীতি কৌশল সামাজিক বৈষম্য ও শোষনের পথকে আরও সুগম করে দেয়। নব্য পুঁজিপতি শোষক শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে।
পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনঃ বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প-কারখানার ব্যর্থতার পটভূমিতে পাশ্চাত্যের দাতা সংস্থাগুলোর পরামর্শে আশির দশকে ক্রমান্বয়ে পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতিতে প্রত্যাবর্তনের নীতি-কৌশল গ্রহণ করা হয়। এবারে প্রত্যাশা ছিল-
(ক) মালিক ও শ্রমিক পক্ষ উভয়ই উৎপাদনে তাদের অবদানের বিনিময়ে আনুপাতিক হারে পারিশ্রমিক লাভ করবে;
(খ) কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারিত হবে;
(গ) ক্ষমতা ও সম্পদের পুঞ্জিভূতকরণ প্রবণতা রোধ হবে
(ঘ) ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও মুনাফার আকর্ষণ উদ্যোক্তা শ্রেণিকে অধিকতর দক্ষতা ও পণ্যের মানোন্নয়নে উজ্জীবিত করবে।
আমরা এখন মুক্ত বাজার অর্থনীতি তথা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অনুসরণ করছি। বস্তুতঃ জাতীয়করণকৃত সরকারী খাতের শিল্প-কারখানার বিপুল লোকসান ও বিশৃঙ্খলার পরিপ্রেক্ষিতে অধিকতর দক্ষতা ও মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে ব্যক্তি-মালিকানায় শিল্প বিকাশের দিকে ঝুঁকে পড়েছি। এ নীতির সাফল্যের জন্য দরকার হচ্ছে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ, সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও সরকারের কার্যকরী তত্ত্বাবধায়ক ভূমিকা।
আমরা লক্ষ্য করছি যে, শহরে-বন্দরে নতুন নতুন বিল্ডিং তৈরী হচ্ছে, নতুন কল-কারখানা গড়ে উঠছে, বিলাস সামগ্রীর আমদানী বেড়েছে, সর্বাধুনিক মডেলের গাড়িতে ঢাকার রাজপথে ট্রাফিক জ্যাম বাড়ছে, তৈরি হচ্ছে ফ্লাইওভার, গ্রামে-গঞ্জে পাকা সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে উঠছে, আধুনিক শপিংমল, ইংরেজি মাধ্যমের বাহারী নামের স্কুল ও ক্লিনিকের ভারে ঢাকা শহরের আবাসিক এলাকাও এখন বাণিজ্যিক অবয়ব ধারণ করেছে, টেলিযোগাযোগও তথ্য-প্রযুক্তির সুযোগ দ্রæত প্রত্যন্ত প্রান্তরেও ছড়িয়ে পড়ছে। এ্যাপার্টমেন্ট সংস্কৃতি নগর জীবনে এনে দিয়েছে এক নতুন মাত্রা। এসবই আমাদের গর্বের প্রতীক; মনে হচ্ছে আমরা এগিয়ে চলেছি দ্রুত । কিন্তু এর মধ্যে কি সামগ্রিক অগ্রগতির ইঙ্গিত আছে ? বস্তুত উদার বাজার ব্যবস্থার ফলে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দেশে একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠি রাতারাতি সম্পদ ও অর্থত্ত্বে ফুলে-ফেপে উঠছে।
শ্রমজীবী মানুষ কি পেয়েছে ?
অর্থনীতিতে নানা অগ্রগতির সূচক দেখা গেলেও বাংলাদেশ এখনও স্বল্পোন্নত দেশের অন্তর্ভূক্ত। উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত হতে আরো সময় লাগবে। অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদের ভাষায়-দেশের দুই কোটি মানুষ আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা অর্জন করেছে। এর মানে দাঁড়ায় ১৮ কোটি মানুষ এখনও অস্বচ্ছল। আরেক হিসেবে, বিগত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী প্রতিবছর মাত্র এক শতাংশ হারে দারিদ্র হ্রাস পাচ্ছে। এ হারে দারিদ্র বিমোচনে অর্ধ শতাব্দি লেগে যাবে। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হলে সে লক্ষ্যমাত্রাও মুখ থুবড়ে পড়বে। প্রকৃতপক্ষে দেশে মুক্তবাজার ব্যবস্থার কারণে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে কিছু অগ্রগতি হলেও সার্বিকভাবে শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যে ইতিবাচক উল্লেখযোগ্য কোন প্রভাব পড়েনি। দেশের শ্রমশক্তির ৬৫ ভাগ এখনও কৃষিখাতে নিয়োজিত। কিন্তু কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানা কাঙ্খিত মাত্রায় গড়ে না উঠায় কৃষিজীবীরা পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় না। ফলে তাদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না। শিল্পখাতে নতুন নতুন কারখানা গড়ে উঠছে সন্দেহ নেই, কিন্তু বর্ধিত শ্রমশক্তির তুলনায় তা অপ্রতুল। নির্মাণ ও বস্ত্রখাতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ দেখা গেলেও শিল্পোদ্যোক্তারা যতটা লাভবান হচ্ছেন, সে তুলনায় শ্রমিক মজুরের ভাগ্য যেন স্থিতিশীল হয়ে আছে। যেমন ধরুন- গার্মেন্টস শ্রমিকদের কথা। তাদের থাকার জন্য ভাল আবাসন নেই, অধিকাংশ নারী শ্রমিকই থাকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, কারখানায় যাতায়াতের জন্য নেই কোন পরিবহন, নি¤œমানের খাবার খেয়ে তারা রাত-দিন কাজ করছে। এছাড়া রয়েছে অত্যাচার-নির্যাতন ও জীবনের ঝুঁকি। অগ্নিদগ্ধ হয়ে অকাল-মৃত্যু যে নৈমিত্তিক ঘটনা। একটি গেঞ্জির জন্য নির্যাতনে হত্যার ঘটনাও ঘটছে। শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার দেয়া হচ্ছে না বলেই এ অবস্থা। তাদের ন্যায্য মজুরী দিতে হবে, তাদের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, দিতে হবে পরিবহন ও চিকিৎসা সুবিধা ইত্যাদি।
প্রশ্ন হচ্ছে, মুক্তবাজার অর্থনীতির নীতি-কৌশলের আওতায় পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামোতে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা অর্থনৈতিক বৈষম্য কি দূর করা সম্ভব ? বাংলাদেশ সমাজতন্ত্র তথা ঢালাও জাতীয়করণের ভ্রান্ত নীতি কৌশল থেকে বেরিয়ে এসে উদার মুক্তবাজার নীতি অনুসরণের ফলে সময়ের ব্যবধানে পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। নিম্নে অর্থনৈতিক বৈষম্যের মাত্রা বৃদ্ধির কিছু উদাহরণ দিয়েছি। কিন্তু এর কারণ কি সেটা চিহিৃত করা দরকার।
প্রথমত: বাজারের গতি প্রকৃতির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রন শিথিল হয়ে পড়ায় ব্যক্তিস্বার্থ সমাজ স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে দেখা দিয়েছে। বস্তুত; মুক্ত বাজার ব্যবস্থার সাধারণ বৈশিষ্ট্যের সাথে সমাজের সাধারণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে সংঘাত দেখা দিচ্ছে। সরকারের উদার নীতির সুযোগে অর্থলিপ্সু একটি চক্র কালো টাকার স্তুপ গড়ে তুলেছে। এটা স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে, উদার পুঁজিবাদী মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে নৈতিকতার কোনো স্থান নেই।
দ্বিতীয়ত: নৈতিকতার কোনো বাধন না থাকায় বিত্তশালীরা নিজেদের বল্গাহীন খেয়ালখুশিমত ভোগ্য ও বিলাস সামগ্রী বিদেশ থেকে আমদানী করছে, ফলে চাপ পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর। ধনীদের এ বিলাসিতা এক ধরণের অপচয় যার প্রভাব অবশ্যই দরিদ্র শ্রেণির উপর পড়তে বাধ্য। কারণ এর ফলে দরিদ্র শ্রেণির চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের যোগান কমে যায়।
তৃতীয়ত: মুক্তবাজার অর্থনীতির অনিবার্য হিসেবে বাংলাদেশ ‘কনসুমারিজম’ এর ভয়াবহ প্রভাব সমাজকে আক্রান্ত করে ফেলেছে। পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনে ভোগ্যপণ্যের বিজ্ঞাপন এমন সয়লাব সৃষ্টি করেছে যে, ভোক্তা শ্রেণি অবচেতনভাবে নিম্মমানের অপ্রয়োজনীয় পণ্যের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। এমনকি ভোগলিপ্সা, জৈবিক ও যৌন আকর্ষণ সৃষ্টি করে এমন বিজ্ঞাপনও প্রচার করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য বণিক শ্রেণির মুনাফা বাড়ানো এবং মধ্যবিত্ত, নিম্মবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষের পকেট খালি করা। বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যকে সামাজিক মর্যাদার প্রতিক বলে গণ্য করা হচ্ছে। ফলে সমাজে বিত্তবান ও বিত্তহীনদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে এক ধরনের মনস্তাত্বিক জটিলতা। একজন অর্থনীতিবিদের ভাষায়, “আগে পণ্য ক্রয়ের পূর্বে সঞ্চয় করতে হতো, আর এখন ক্রেডিট কার্ডের বদৌলতে মানুষের সঞ্চয় না থাকলেও তারা কেনার হিড়িক নেমে যেতে পারে”।
বস্তুতপক্ষে বাজার অর্থনীতিতে বনিক ও ধনিক শ্রেণি নানাভাবে সম্পদ পূঞ্জীভূত করার সুবিধা ভোগ করে এবং ফলে শ্রমজীবী ও পশ্চাৎপদ মানুষেরা হয় শোষিত। এ ব্যবস্থায় দেশে অর্থনৈতিক সুবিচার তথা সম্পদের সুষম বন্টন আশা করা যায় না। এ জন্যে বিকল্প উন্নততর ব্যবস্থার অনুসন্ধান করতে হবে। সমাজ ব্যবস্থা ও অর্থনীতির উত্থান-পতনে নানা সীমাবদ্ধতার প্রেক্ষাপটে নৈতিক মূল্যবোধের অনিবার্যতা ক্রমশঃ গুরুত্ব লাভ করছে। ইতিহাসের ব্যাপক অনুসন্ধান ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক টয়েনবী এ সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে, “ধর্মীয় অনুশাসন ও মূল্যবোধ ব্যতিরেকে নৈতিক উচ্চমান ও সামাজিক সংহতি অর্জন সম্ভব নয়”। এরিয়েল ডুরান্ট বলেছেন, “ধর্মের সাহায্য ব্যতিরেকে কোন সমাজ উচ্চ নৈতিক মান বজায় রেখেছে ইতিহাসে এর কোনো উদাহরণ নেই”।
বিকল্প প্রস্তাবনা: বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোকে বিবেচনায় রেখে রাষ্ট্রীয় নীতি কৌশল এমনভাবে গ্রহণ করতে হবে যাতে অর্থনীতিতে সম্পদের প্রবাহ আবর্তিত হয়, কেবলমাত্র ধনিক গোষ্ঠির মধ্যে কেন্দ্রীভূত না হতে থাকে। এ লক্ষ্যে কতিপয় প্রস্তাবনা পেশ করছি-
১.অর্থনীতি ও বাজার ব্যবস্থার সকল পর্যায়ে একটি নৈতিক ছাকনীর ব্যবস্থা (Morall Filter Mechanism) প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যাতে করে সম্পদের ব্যবহারে দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়। সম্পদ মানুষের প্রতি আল্লাহর দেয়া আমানত এবং তার ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে এ উপলব্ধিকে ছড়িয়ে দিতে হবে। এ দর্শনই হচ্ছে নৈতিক ছাকনীর প্রধান উপাদান।
২.অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ণয় করতে হবে। নাগরিকদের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ চাহিদাগুলোকে চিহ্নিত করে একদিকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয়ের জন্য সরকারী নীতি সংস্কার করতে হবে; অপরদিকে বেসরকারী খাতের বিত্ত¡শালীদেরও এ ব্যাপারে যতœবান হতে হবে। সরকারী বাজেট সংস্কারে এ বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে।
৩.রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় বন্ধ করতে রাষ্ট্রকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। তথাকথিত সিস্টেম লস সরকারী সম্পদের চুরি, আত্মসাৎ, লুন্ঠন ও অপচয় বন্ধ করে দরিদ্র মানুষের কল্যাণে তা ব্যয় করাতে হবে।
৪.সরকারী ও বেসরকারী লোকদের দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে মনে রাখা দরকার, কেবল আইন প্রণয়ন ও সংস্থা তৈরী করে দুর্নীতি দমন করা যাবে না। জনসাধারণের মধ্যে নৈতিকতার উন্মেষ ঘটাতে হবে। এজন্য ধর্মীয় শিক্ষার বিস্তার করতে হবে।
৫.সুদের অভিশাপ থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে হবে। এজন্য সুদমুক্ত ব্যাংকিংকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। সরকারীভাবে সুদবিহীন ঋণদান জোরদার করতে হবে।
৬.সুদভিত্তিক ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে এ দেশের দারিদ্র দূর করা যাবে না। এ জন্য কর্জে হাসানা, সুদবিহীন ঋণ এবং যাকাত ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৭.শ্রমজীবী, কৃষক ও শ্রমিক দরিদ্র মানুষের কল্যাণে সরকারী ভর্তুকী অব্যাহত রেখে বিত্তবানদের জন্য ভর্তুকী বন্ধ করে দিতে হবে।
৮.শ্রমিক মজুরদের জন্য জীবন জীবিকার চাহিদার সাথে সংগতি রেখে মজুরী কাঠামো নির্ধারণ করে দিতে হবে। বেসরকারী খাতে যাতে নিম্নতম মজুরী কাঠামো কার্র্র্র্র্র্র্র্র্র্যকর করা হয় সে জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
৯.যাকাত অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের একটি পথ। এছাড়াও ন্যায়ানুগ করারোপ করে সরকার সম্পদ আবর্তনের ব্যবস্থা করতে পারে। করদাতারা যাতে স্বউদ্যোগে সততার সাথে কর প্রদান করে তার জন্য নৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
১০.বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে হবে যাতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ে এবং অধিকতর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
১১.ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। পল্লীভিত্তিক কুটির শিল্পকে উৎসাহ দিতে হবে।
এসব হচ্ছে সংবিধানে বিঘোষিত শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সীমিত কয়েকটি সুপারিশ মাত্র। বস্তুত;পক্ষে ইসলামী রাষ্ট্র ও অর্থব্যবস্থা করেই কেবল শ্রমজীবী মানুষের পূর্ণাঙ্গ অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে।
লেখক: কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন