১
৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই ভূখণ্ড হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এই জনপদ কালের পরিক্রমায় বহু শাসকের দ্বারা শাসিত হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় অধিকাংশ শাসকের পরিচয় শোষক হিসেবে সমাদৃত হয়েছে।
এই সকল শাসকের শোষণের বিরুদ্ধে এই দেশের কৃষক-শ্রমিকরা আজীবন লড়াই করেছে। লড়াই করেছে নিজেদের স্বাধীনতার জন্য। লড়াই করেছে নিজেদের আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য।
১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন। পলাশী আম্রকাননে ব্রিটিশদের দ্বারা বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে যায়। পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ এই জনপদের কৃষক-শ্রমিকরা ব্রিটিশদের দ্বারা অতীতের ন্যায় অতিমাত্রায় শোষিত হতে থাকে। অবশেষে বহু বিদ্রোহ ও সংগ্রামের চূড়ান্ত ফল হিসেবে ব্রিটিশরা উপমহাদেশ থেকে বিদায় নেয়।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শোষকের বিরুদ্ধে কখনোও সুবিধাভোগী উচ্চবিত্ত শ্রেণি শোষকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেনি। তারা শোষিত মানুষের পক্ষে নিজেদের কণ্ঠকে উচ্চকিত করেনি। বরং শাসকের শোষণের পক্ষ নিয়েছে। সব সময় শোষিত জনগোষ্ঠীকে শোষকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে। শাসকের বৃত্ত ভাঙতে মেনে নিতে হয়েছে অজ্রস আত্মত্যাগ। সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে পথ তৈরি করতে একের পর এক আন্দোলনের সূচনা করতে হয়েছে। তেভাগা, নীল চাষ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পেছনে সবচেয়ে বড়ো শক্তি ছিল কৃষক শ্রমিকরা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর রক্তে অঙ্কিত হয়েছে বিজয়ের পতাকা।
১৯৪৭ সালে আগস্ট মাসে উপমহাদেশকে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুই ভাগে বিভক্ত করে বিদায় নেয় ব্রিটিশরা। ভারত একটি ভূখণ্ডের দেশ হলেও পাকিস্তান ছিল দুটি আলাদা ভূখণ্ড। যার একটি থেকে অপরটির দূরত্ব ছিল প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার। ভৌগলিক দূরত্বের পাশাপাশি ভাষা, জাতিসত্তা, সংস্কৃতিতে দুটো ভূখণ্ড ছিল আলাদা প্রকৃতির। ফলে ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতার মাত্র ২৫ বছরের মাথায় পাকিস্তান আবার বিভক্ত হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
২.
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে দুটি আলাদা ভূখণ্ড একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে ভৌগলিক দূরত্বকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল। ব্রিটিশ শোষণের অবসান ঘটিয়ে একটি বৈষম্য মুক্ত ও শোষণহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় স্বপ্নে বিভোর ছিল বাঙালিরা। কিন্তু ব্রিটিশদের প্রায় দুইশ বছরের শাসনে জন্ম নেওয়া এই দেশীয় শোষকদের দ্বারা সেই আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ইতি ঘটে।
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির পেছনে যারা নেতৃত্বে ছিলেন তাদের অধিকাংশ বাসস্থান হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানকে বেছে নেন। রাজা যেখানে থাকেন সেটা হয় রাজধানী। সেই সুবাধে পশ্চিম পাকিস্তান হয়ে উঠে রাজধানী। ক্ষমতা, রাজনীতি-অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রশাসন, প্রতিরক্ষার কেন্দ্রস্থল।
ফলে নবগঠিত পাকিস্তানের পশ্চিম পাকিস্তান হয়ে উঠে প্রথম শ্রেণির নাগরিকদের আবাসস্থল। আর পূর্ব পাকিস্তান দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকদের। যদিও সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করতো। পদে পদে পূর্ব পাকিস্তানকে অবহেলা ও শোষণের শিকার হতে হয়। ১৯৪৭ সালে যেখানে দুই পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল সমান সেখানে ১৯৭১ সালে পশ্চিমের মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়ে যায়।
এই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে শত শত স্কুল বন্ধ হয়ে যায় বিনিয়োগের অভাবে। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে স্কুলের সংখ্যা তিনগুণ হয়ে যায়। সরকারি অফিস-আদালতে বাঙালিদের নিয়োগ দেওয়া হতো না। পূর্ব পাকিস্তানে পর্যাপ্ত কাঁচামালের যোগান থাকলেও বিনিয়োগের অভাবে সেভাবে শিল্প-কলকারখানা গড়ে ওঠেনি। পূর্বের কাঁচামাল দিয়ে চলতো পশ্চিমের কলকারখানা। ফলে পশ্চিমের উৎপাদিত পণ্যের বাজার হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তান।
অন্যদিকে সরকারের উন্নয়ননীতি ছিল চরম একপেশে। পশ্চিমের তুলনায় পূর্বে জনসংখ্যা বেশি হলেও উন্নয়নের জন্য সরকারি বরাদ্দ ছিল বৈষম্যমূলক। পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী (১৯৫০-৫৫) পরিকল্পনায় কেন্দ্রীয় সরকার থেকে মাত্র ২০ শতাংশ উন্নয়ন বরাদ্দ পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী (১৯৬৫-৭০) সেই বরাদ্দ বাড়লেও তা ছিল ৩৬ শতাংশ। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের বরাদ্দ দেওয়া জন্য বিভিন্ন প্রকল্প থেকে অর্থ প্রকাশ্যে ও গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানের তহবিলে নিয়ে যেতো। বিভিন্ন জটিল কর ব্যবস্থার আড়ালে ও তহবিলের বিভিন্ন খরচ দেখিয়ে ২৫ বছরে ২৬০ কোটি ডলার নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
অবকাঠামোগত উন্নয়নের বৈষম্যের পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে পূর্ব পাকিস্তান চরম বৈষম্যের শিকার হয়। ১৯৫১ সালের পূর্বে পাকিস্তানে গ্রাজুয়েট ছিল ৪১ হাজার এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ৪৫ হাজার। ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে গ্রাজুয়েট হয় ২৮ হাজার এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ৫৪ হাজার। উচ্চ শিক্ষায় ১০ বছরে পূর্বে শিক্ষার্থী ৩২ শতাংশ কমে গিয়েছিল। আর পশ্চিমে বেড়েছিল ২১ শতাংশ। এই সময় সরকারি বৃত্তি, অনুদান পশ্চিমের শিক্ষার্থীরা পেতো। পূর্বের শিক্ষার্থীরা বৃত্তি, অনুদানের খবর (বিজ্ঞাপন) যখন জানতো ততদিনে আর আবেদনের সময় থাকতো না। চাকরি যেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রার্থীরা না পায় এক্ষেত্রে একই কৌশল তারা অবলম্বন করতো।
আগেই বলেছি পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের উৎপাদিত শিল্প পণ্যের প্রধান বাজার হয়ে উঠেছিল। সরকারি হিসাব মতে ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের বাণিজ্যে পশ্চিমের উদ্বৃত্ত দাঁড়ায় ১০ কোটি ডলার। এই বৈষম্যমূলক বাণিজ্যের কারণে পশ্চিমের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নত হলেও পূর্বের জনগোষ্ঠীর জীবনমান অবনমন হয়েছিল।
এটি থেকে উত্তরোণের একমাত্র পথ ছিল পূর্বে প্রচুর পরিমাণ বিনিয়োগ। কিন্তু সরকারি বেসরকারি বিনিয়োগ করা হয়নি। বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল নামমাত্র। অন্যদিকে সরকারি বিনিয়োগ সময়মত কখনো আসেনি। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল যৎ সামান্য।
১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। এতো বড়ো দুর্যোগে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী নীরবতার ভূমিকা পালন করে। তারা দেশের কোথাও গিয়ে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়ায়নি। ঘূর্ণিঝড়ের একমাস পরেও বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণ পৌঁছানো যায়নি। অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান কতটা দুর্বল ছিল এটি তার একটি উদাহরণ।
পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে রাখার পাশাপাশি পশ্চিমরা পূর্বের মানুষদের সরকারি চাকরি ও সেনাবাহিনীতে প্রতিনিধিত্ব করা থেকে বিরত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণের পর ঘোষণা দেন সেনাবাহিনীতে বাঙালি নিয়োগ বাড়ানো হবে। কিন্তু তার এই ঘোষণা বাস্তবায়িত হয়নি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর একজন বাঙালি সচিব পেতে ১৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৯৬৪ সালে দুইজন বাঙালি সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়।
সরকারি-বেসরকারি এহেন বৈষম্য পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এবং তাদের মন মানসে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। বছরের পর বছর চলা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বাঙালির সংস্কৃতির ওপর শাসকগোষ্ঠীর হস্তক্ষেপের চূড়ান্ত ফলাফল হিসাবে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ঘটে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং শ্রেণিবৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এদেশের আপামর মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই সময়ের ৮৫ শতাংশ মানুষ ছিল কৃষক ও কৃষি শ্রমিক। সুতরাং চোখ বন্ধ করে দিয়ে বলা যায় এই স্বাধীন ভূমি প্রতিষ্ঠার জন্য কৃষক ও শ্রমিকরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের তালিকা যেদিন প্রকাশ হবে সেদিন দেখা যাবে দেশের এই মেহনতি মানুষরাই নিজেদের সর্বোচ্চ সম্পদ দেশমাতৃকার জন্য বিলিয়ে দিয়ে লাল সবুজের পতাকা অঙ্কন করেছে। শোষকের শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে।
৩.
যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুর্নগঠনে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা রেখেছে কৃষক-শ্রমিক ও মজুররা। তাদের ঘামে শ্রমে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ আজকের এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে রফতানিমুখী সেক্টরে নিয়োজিত শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিক ও কৃষকদের সম্মিলিত প্রয়াস গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
কৃষক-শ্রমিকরা দেশের স্বাধীনতা এনে ক্ষান্ত হয়নি। এই স্বাধীনতা অর্থবহ করতে দিনরাত অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। বিশেষত একটি নতুন দেশকে স্বাভাবিক ধারায় পরিচালিত করতে শত প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়। বাংলাদেশ এই প্রতিকূল পরিস্থিতি কৃষক-শ্রমিকের শ্রমের ওপর ভর করে পেরিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবে দুর্যোগ প্রবণ দেশ। বছরের একটি দীর্ঘ সময় এদেশে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরাসহ নানা দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। এসব দুর্যোগ মাড়িয়ে কৃষকরা তাদের কর্মের দৃঢ়তা দিয়ে কৃষির অগ্রগতি বজায় রেখেছেন। বর্তমানে দেশের ৪৭ শতাংশ শ্রমশক্তি কৃষিখাতে নিয়োজিত।
অন্যদিকে দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনে রফতানি খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দেশের পোশাক শিল্প ও অন্যান্য রফতানিমুখী শিল্প দেশকে ইতোমধ্যে দেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নিয়ে যেতে অসামান্য অবদান রেখেছে। বিশেষত স্বাধীনতার পর পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা আমূল বদলে দিয়েছে। এই খাতে দিনরাত অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করছে পোশাক শ্রমিকরা।
দেশে পরিবার পরিজন রেখে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করতে অসংখ্য শ্রমিক প্রবাস জীবনকে বেছে নিয়েছে। প্রবাসে তারা কঠোর পরিশ্রম করে প্রতিদিন কোটি কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে মজবুত করছে।
দেশের স্বাধীনতাকে যারা অর্থবহ করতে এতো এতো অমানুষিক পরিশ্রম করে যাচ্ছে সেই শ্রমিকদের কাঙ্ক্ষিত মূল্যায়ন করতে পারেনি রাষ্ট্র। যারা দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা পদে পদে লাঞ্চনা-বঞ্চনা, নির্যাতন-নিপীড়ন ও শোষণের শিকার হচ্ছে। আজ তাদের সমাজ রাষ্ট্রে সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান নেই। এটি রাষ্ট্রের জন্য যতটা দুঃখজনক তার চেয়েও বেশি আঘাত স্বাধীনতার ওপর। এই শ্রমিকদের পূর্ব পুরুষরা দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল।
অন্যদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের যে লক্ষ্য গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি। এটি আমাদের সফলতা। কিন্তু স্বাধীন ভূখণ্ডকে অর্থবহ করতে পারে মানুষের অর্থনৈতিক সামর্থ্য। কিন্তু এটি গত ৫১ বছরে কতটুকু অর্জিত হয়েছে আজ সর্বমহলে সেই প্রশ্ন উঠছে।
দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কৃষক-শ্রমিক। তারা দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে পরিশ্রম করে যাচ্ছে। তার ওপর ভর দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু কৃষক শ্রমিকের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। স্বাধীনতার আগে তারা যে বৈষম্যের শিকার হতো আজ কিছুটা কমলেও খুব বেশি যে কমেছে তার জোর গলায় বলা যায় না। আমাদের দেশের শ্রমিকদের অবস্থা কতটা অসহায় তা করোনা মহামারী চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে। এই কঠিন দুর্যোগে দুবেলা খাবারের জন্য শ্রমিকদের সমাজের বৃত্তবানদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে।
অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে কৃষক-শ্রমিকদের এই করুণ দশা থাকার কথা না। পাকিস্তান আমলে দেশের কৃষক-শ্রমিকদের ওপর যারা বৈষম্য চালিয়েছিল তারা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী শোষক গোষ্ঠী। কিন্তু আজকে কারা আপন ভূমিতে কৃষক শ্রমিকদের ওপর শোষণ-নিপীড়ন ও জুলুম চালাচ্ছে? বলা হয় পাকিস্তান আমলে ২২টি পরিবারের হাতে পাকিস্তানের অর্থনীতি বন্দি ছিল। আমাদের দেশে কারা অর্থনীতিকে কুপোকাত করে রেখেছে?
আজ জাতীর সামনে প্রশ্ন কেন কৃষকরা তাদের উৎপন্ন পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত। কেন শ্রমিকরা দিনরাত পরিশ্রম করে তাদের শ্রমের ন্যায্যমূল্য পায় না। এই সকল প্রশ্নের উত্তর যতদিন না পাওয়া যাবে ততদিন দেশের সমৃদ্ধি বাধাগ্রস্থ হবে।
৪.
পাকিস্তান আমলের ২২ পরিবার থেকে আজ বাংলাদেশে ২২ হাজার পরিবার তৈরি হয়েছে। যারা শ্রমজীবী মানুষের স্বপ্ন ও শ্রমকে গলাটিপে হত্যা করে নিজেরা বিলাসী জীবন-যাপন করছে। এই সুবিধাভোগী ও উচ্চবিলাসী মানুষদের জন্য আমরা আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম লক্ষ্য শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা আজও করতে পারিনি। সুবিধাভোগীরা যারা যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকে তাদের সাথে মিশে গিয়ে কৃষক-শ্রমিকদের ওপর শোষণ-নিপীড়ন ও জুলুম অব্যাহত রাখে। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার জন্য শাসকগোষ্ঠীকে অবশ্যই এই সিন্ডিকেটের করাল গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাদের অশুভ শক্তি থেকে দেশের মেহনতি কৃষক ও শ্রমিকদের রক্ষার জন্য শাসকদের ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিশেষত দেশের কৃষকদের উৎপন্ন পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাইয়ে দিতে সরকারকে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণে ইতোমধ্যে বহু কৃষক চাষাবাদ ছেড়ে দিয়েছে। কৃষকরা চাষাবাদ না করার কারণে আমদানী নির্ভরতা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ফলে চাপ বাড়ছে অর্থনৈতির ওপর।
আর যে সকল শ্রমিকরা প্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রম দিচ্ছে তাদেরও শ্রমের ন্যায্যমূল্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নামমাত্র মজুরি দিয়ে অনেক মালিকপক্ষ নিজেদের পকেট ভারী করে বিদেশে অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। সরকারকে এক্ষেত্রে কঠোর নজরদারি করতে হবে। যেন আমার দেশের শ্রমিকের হাড় ভাঙা পরিশ্রমের সুফল অন্যদেশ না পায়।
দেশের শ্রমশক্তির দুই তৃতীয়াংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। এরাই সবচেয়ে করুণ অবস্থায় জীবন-যাপন করে। এদের ঘরে এখনো স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়নি। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জীবনমান ন্যূনতম স্বাভাবিক ধারায় আনার জন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সাথে একীভূত করতে হবে। ওয়ার্ড বা ইউনিয়ন ভিত্তিক শ্রমিকদের নাম ডিজিটাল ব্যবস্থার সুফল নিয়ে তালিকা করতে হবে। এই তালিকা অনুযায়ী সপ্তাহ বা মাস ভিত্তিক তাদের বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে। বিশেষ করে করোনা মহামারীর মত আর কোন দুর্যোগ এলে যেন তারা সবার আগে সরকারি সহযোগিতা পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে।
সর্বোপরি দেশের শ্রমজীবী মানুষদের ঘরে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ পৌঁছিয়ে দিতে দেশে একটি আদর্শিক শ্রমনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই শ্রমনীতি হচ্ছে ইসলামী শ্রমনীতি। ইসলামী শ্রমনীতিতে মালিক-শ্রমিক উভয়ের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এতে কারও প্রতি অবিচার বা শোষণের সুযোগ রাখা হয়নি।
আজকে দেশে ইসলামী শ্রমনীতি প্রতিষ্ঠা না থাকার কারণে শ্রমজীবী মানুষের এতো দুর্দশা। আর এই সুযোগে একশ্রেণির অসাধু মালিকপক্ষ ও ব্যবসায়ীরা কৃষক ও শ্রমিকদের শ্রমের অবমূল্যায়ন করছে।
বর্তমানে দেশে প্রচলিত পুঁজিবাদ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কৃষক-শ্রমিকদের জীবন দুঃসহ করে তুলেছে। মানুষ রচিত মতবাদ দিয়ে মেহনতি মানুষের মুক্তি অসম্ভব। কেননা এসব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রচিত হয় ধনীকে আরও ধনী করার জন্য। আর গরিবদের আরও নিঃস্ব করার জন্য। এসব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এমন ফাঁক ফোকর রাখা হয় যেন ধনীরা সহজে বেড়িয়ে যেতে পারে।
দেশের স্বার্থে ও স্বাধীনতার পরিপূর্ণ স্বাদ পেতে কৃষক শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ভ্রান্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে সরে আসতে হবে। তার স্থলে আদর্শিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে। এই আদর্শিক অর্থনীতি ব্যবস্থার নাম ইসলামী অর্থনীতি। ইসলামী অর্থনীতি সকল কালের সকল মানুষের জন্য কল্যাণ স্বরূপ। এটি মালিক-শ্রমিক উভয়ের ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করেছে। ইসলামী অর্থনীতিতে সকল সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিহিত রয়েছে।
বাংলাদেশ তার বিজয়ের ৫০তম বছর পেরিয়ে গেছে। এটি একটি রাষ্ট্রের জন্য যেমন মাইলফলক। তেমনিভাবে যখন পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখতে হয় এখনো বহু বনি আদম রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে রাত্রি যাপন করে। অসংখ্য মানুষ দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার জন্য দিকবেদিক ঘুরে বেড়ায়। যখন স্বল্পমূল্যে পণ্য কেনার জন্য টিসিবি ট্রাকে প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই হাজারও মানুষের ভীড় বাড়তে থাকে। তখন আর বুঝতে বাকি না দেশে স্বাধীনতা কতটা অর্থবহ হয়েছে।
তাই আসুন আর দেরি না করে ভ্রান্ত মতবাদ ও পথ ছুড়ে ফেলে দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত চির শান্তির পথে ফিরি আসি। কৃষক-শ্রমিকের জীবনে অনাবিল শান্তি ও কল্যাণ ফিরিয়ে আনতে এই বিজয় দিবসে দীপ্ত শপথ গ্রহণ করি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
mahmudashish@yahoo.com