পবিত্র কুরআন মানবজাতির গাইড লাইন। মানুষের জীবনের সকল দিক ও বিভাগ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। পবিত্র কুরআনে হাতি, গাভি, মশা, মাছি, মাকড়শা থেকে শুরু করে বিভিন্ন নামে সুরা রয়েছে এবং মানুষের প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন জাগে শ্রমিকের বিষয়ে কুরআনুল কারিমে কি আলোচনা করা হয়েছে? উত্তর হলো, হ্যাঁ। আল্লাহ তায়ালা শুধু শ্রমিকের বিষয়েই আলোচনা করেননি বরং শ্রমিকের নেতা লোকমান এর নামে একটি সুরাও নাযিল করে শ্রমিকদের সম্মানিত করেছেন। আলোচ্য প্রবন্ধে লোকমানের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং তিনি কিভাবে দাস থেকে নেতা ও হাকিম হলেন সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
বর্তমান ইথিওপিয়ায় জন্ম গ্রহণকারী লোকমান ছিলেন হাবশি স¤প্রদায়ের লোক। প্রথম জীবনে তিনি তৎকালীন শাম দেশের অধিবাসী তথা বর্তমান সিরিয়ার এক ধনী ব্যক্তির অধীনে গোলামির জীবন শুরু করেন। তারপর তিনি গোলামির জীবন থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহ তায়ালার অপার অনুগ্রহে অফুরন্ত শিক্ষা-দীক্ষা ও প্রজ্ঞা লাভ করেন।
আমাদের দেশে আপামর জনতা তাঁকে লোকমান হাকিম নামে জানেন। এছাড়াও তিনি লুকমান নামেও পরিচিত; (আরবি: لقمان)। তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞ শ্রমিক নেতা যার নামে আল কুরআনের একত্রিশতম সুরা, সুরা লুকমান (আরবি: سورة لقمان) এর নামকরণ করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক একাদশ শতাব্দী বর্তমান সুদানের নুবিয়ায় বসবাস করতেন বলে ধারণা করা হয়। তাফসীরে ইবনে কাসীরসহ ফার্সি, আরবি ও তুর্কি সাহিত্য এবং প্রাথমিক ঐতিহাসিক গ্রন্থে লোকমান সম্বন্ধে অনেক ঘটনা পাওয়া যায়।
দাসত্ব জীবন
তাঁর বৈচিত্র্যময় জীবন শুরু হয় দাসত্বের জীবন দিয়ে। যে লোকটি লোকমানকে ক্রয় করেছিলেন তিনি খুব বুদ্ধিমান ও প্রশস্থ হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। তিনি বুঝতে পারেন লোকমান সাধারণ কোন দাস নন, তাই তাঁকে পরীক্ষা করার জন্য একটি ছাগল জবাই করে তার নিকৃষ্টতম অংশটি হাজির করার নির্দেশ দেন। লোকমান ছাগল জবাই করে তার হৃৎপিণ্ড ও জিহ্বা নিয়ে মনিবের সামনে উপস্থিত হোন। এগুলো দেখে তার মনিব মৃদু হাসেন বিচক্ষণতা দেখে মুগ্ধ হোন। কিছুদিন পরে মনিব লোকমানকে আবার একটি ছাগল জবাই করে, পশুর সেরা অংশগুলো তার কাছে উপস্থিত হতে নির্দেশ দেন। লোকমান তার মনিবকে অবাক করে দিয়ে আবার একই হৃৎপিণ্ড ও জিহ্বা নিয়ে হাজির হন। তার মনিব লোকমানকে জিজ্ঞাসা করলেন কীভাবে হৃদয় এবং জিহ্বা সর্বোৎকৃষ্ট এবং নিকৃষ্টতম অংশ হতে পারে। বুদ্ধিমান লোকমান উত্তর দেন, “জিহ্বা যার ভালো সেসব সময় ভালো। আর যদি সে খারাপ হয় তবে সে নিশ্চিত খারাপ।” এরপর থেকে লোকমানের মনিব তাকে স্বাধীন করে দেন এবং তাঁকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে নিজের কাছে রাখতেন। বহু লোক লোকমানের নিকট পরামর্শ নিতে আসেন এবং তার জ্ঞানের খ্যাতি চতুর দিকে বিস্তার লাভ করে। তাঁর জ্ঞান লাভের পেছনে তিনটি গুণ বিশেষ ভ‚মিকা রেখেছিল। স্বভাব তিনটি হলো-
১. কোন দিনই কারও সাথে মিথ্যা কথা বলেননি।
২. কখন কারও আমানতের খেয়ানত করেননি।
৩. কারো সাথে কখনও বাজে কথায় সময় নষ্ট করেননি।
লোকমান তার পুত্রকে উদ্দেশ্য করে বহু মূল্যবান উপদেশ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের সুরা লোকমানে তা বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত লোকমান হাকিম তাঁর পুত্র উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “হে আমার পুত্র! আল্লাহর সাথে তুমি কাউকে শরীক করো না; নিঃসন্দেহে আল্লাহর সাথে শরীক করা গুরুতর অপরাধ।” তিনি আরও বলতেন, “হে আমার পুত্র! সালাত কায়েম করো, আর সৎ কাজের নির্দেশ দাও এবং অসৎ কাজে নিষেধ করো। বিপদে-আপদে সবর করো। নিশ্চয়ই এটা সাহসিকতার কাজ।” লোকমান হাকিম মানুষকে গর্ব-অহংকার করা, উচ্চস্বরে কথা বলা, পিতা-মাতাকে কষ্ট দেওয়া, কুফরি করা, ভোগ-বিলাসে গা ভাসিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্যও উপদেশ দিয়েছেন।
দেখতে কালো এ মানুষটি কৃতদাস থাকাকালে তাঁর মনিবকে অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। এ সময় তাঁর জীবনে ঘটে যায় অনেক ঘটনা।
সৌভাগ্যক্রমে লোকমানের মনিব ছিলেন একজন বুদ্ধিমান ও রুচিশীল মানুষ। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি লোকমানের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বুদ্ধি, বিবেক, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও ঈমান দেখে মুগ্ধ হলেন। দেখতে দেখতে মালিক, লোকমান হাকিমকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতে লাগলেন। মনিব সব সময় চেষ্টা করতেন, লোকমানের মান-সম্মান যে কোন অবস্থায় বজায় রাখতে। তিনি যখন খেতে বসতেন তখন লোকমানকে সাথে নিয়েই খেতেন। লোকমান নিজে আগে খাবার খেতেন তারপর খাবারের বাকি অংশ খেতো তার মনিব এবং তারপর অন্যান্যরা। লোকমান যদি কোন কারণে কোন একটা খাবার না খেতেন তার মনিবও সেই খাবারে মুখ দিতেন না। লোকমানের মনিবের জন্য কোন এক ব্যক্তি একটি তরমুজ উপহার পাঠালেন। মনিব সঙ্গে সঙ্গে তার এক গোলামকে ডেকে বললো, “এখনই গিয়ে লোকমানকে ডেকে আনো। লোকমান এসে আগে তরমুজ খাবে তারপর আমি খাব।”
লোকমান আসার পর তার মনিব ছুরি দিয়ে তরমুজটি কাটল। প্রথম টুকরোটি দিল লোকমানকে। লোকমান তরমুজের ওই টুকরোটি এমনভাবে খেতে শুরু করলেন যেন মধুর চেয়েও মিষ্টি ওই তরমুজ। বেশ মজা করে খেল। লোকমান খুব মজা করে খাচ্ছে দেখে মনিব পরের টুকরোটিও তাকে খেতে দিল। এভাবে লোকমান পরপর সতের টুকরো তরমুজ খেলেন। অবশেষে একটি মাত্র টুকরো বাকি ছিল, ওই টুকরোটি মনিব নিজে খাবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু যখনই মনিব তরমুজের শেষ টুকরোটি মুখে দিল এবং খেল, তিতা স্বাদ আর অন্যরকম একটা উটকো ঝাঁঝে তার চেহারা বিকৃত হয়ে গেল। এতো বেশি ঝাঁঝ আর তিতা ছিল ওই তরমুজ যে মনিবের জিহ্বার পাশাপাশি গলাও তিতা হয়ে গেল। অতিরিক্ত তিতার কারণে লোকটি অজ্ঞান হয়ে পড়ার উপক্রম হলো। বেশ কিছু সময় পর কিছুটা স্বস্তি বোধ করল মনিব। এরপর লোকমানকে লক্ষ্য করে বললেন, হে বৎস! তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল তরমুজটি খুবই সুস্বাদু। কিন্তু আমি খেতে গিয়ে বুঝলাম, ওটা ছিল ভয়ানক তিতা। এখন বল, কেন তুমি বিষয়টি গোপন রাখলে? কি দরকার ছিল এত তিতা তরমুজ খাওয়ার? এবার মনিবের উদ্দেশ্যে হযরত লোকমান বললেন, “আহা! কতই না ভালো হতো যদি তরমুজটার শেষ টুকরাও আমাকে দিতেন এবং আমার প্রতি আপনার মমতা ও স্নেহ নিয়ে তৃপ্ত ও আনন্দিত থাকতেন; যেমনি করে আমি আপনার মহত্ত্ব ও উত্তম আচরণের কারণে আপনার নিকট চির ঋণী হয়ে আছি।”
লোকমান কিভাবে তার মনিবের প্রতি কৃতজ্ঞতার নজির স্থাপন করলেন? আমাদেরও উচিত আমাদের অভিভাবক, পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া। তবে সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত মহান আল্লাহর প্রতি যিনি আমাদেরকে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধি-বিবেক দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আর মহান আল্লাহর নির্দেশও কিন্তু এরকমই। তিনি সুরা লোকমানের ১২ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “আমি লোকমানকে প্রজ্ঞা প্রদান করেছি এই মর্মে যে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। যে কৃতজ্ঞ হয়, সে তো কেবল নিজের কল্যাণের জন্যই কৃতজ্ঞ হয়। আর যে অকৃতজ্ঞ হয়, সেক্ষেত্রে আল্লাহ প্রকৃতপক্ষেই অমুখাপেক্ষী ও প্রশংসিত।”
তার জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহকে ভালোবাসতে হবে। তাহলে আল্লাহ তায়ালাও আমাদের ভালোবাসবেন। জীবনে চলার পথে বহু রকমের কষ্ট ও আমাদের সামনে বাধা আসতে পারে। সে সব কষ্ট ও বাধা উত্তীর্ণ হয়ে দ্বীনের পথে অবিচল থাকতে হবে। আল্লাহর প্রতি কোন রকম আক্ষেপ বা ক্ষোভ না দেখিয়ে লোকমানের মতো কঠিন কষ্টগুলোকে হাসতে হাসতে বরণ করে নিতে হবে। তিনি যেভাবে সন্তানাদি, পরিবারের সদস্যদেরকে যে, উপদেশগুলো দিয়েছেন তা হুবহু নিজেদের পরিমণ্ডলে বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বশীল ভ‚মিকা পালন করতে হবে। এছাড়াও তিনি নিজের প্রচেষ্টায় যেভাবে তাওহীদের জ্ঞানার্জন করেছেন এবং মাঠে মনিবের কাজের ফাঁকে ফাঁকে এবং অবসর সময়ে শ্রমিকদের মঝে দাওয়াতি কাজ করে শ্রমিক থেকে হাকিম হয়েছিলেন আমাদেরকেও ঠিক অনুরূপভাবে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। আমরা যদি লোকমানের মতো মনিব ও রবের দায়িত্ব একনিষ্ঠভাবে পালন করি তাহলে আল্লাহ তায়ালাও আমাদেরকে তার মতো মর্যাদার আসনে সমাসীন করবেন।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন, নাটোর জেলা।