মহিলাটি রাসুল (সা.) এর কাছে দৌড়ে এসে আরয করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার স্বামী যিহার করেছে। আপনি এটা বাতিল করে দিন। আমার মাতা-পিতা আপনার উপর কুরবান হোক, আমার এবং আমার সন্তানদের জীবন ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচান। রাসুল (সা.) বললেন, আমার ধারনা তুমি তার জন্য হারাম হয়ে গিয়েছ। (শরীয়তের বিধান তখনও আসেনি) নবী (সা.) এর জবাব শুনে মহিলাটি কান্নাকাটি করতে লাগলেন এবং বার বার আরজ করতে লাগলেন, তালাক হয়ে গেলে আমি কোথায় যাব, আমার কি হবে? আমার ছোট ছোট বাচ্চাদের কি হবে? আমার মা বা আপনজনেরা কেউ নেই। আমার যৌবন শেষ হয়ে গিয়েছে। আমি আমার যৌবন তাকে দিয়েছি। তার সন্তান ধারণ করেছি। উনি বৃদ্ধ মানুষ আমি চলে গেলে কে তাকে দেখবে। আমার অর্থবিত্তও শেষ। যেভাবেই হোক এ তালাক বাতিল করে দিন। আমার স্বামীর বার্ধক্যের কারণে তার মেজাজে রুক্ষতা এসে গিয়েছিল, সে সামান্য কারণে রেগে বলে ফেলেছে। ‘অবনতি আলাইনা কাজাহরি উম্মি’ (অর্থাৎ তুমি আমার নিকট তেমন যেমন আমার মায়ের সৃষ্টদেশ) (সে যুগে এ ধরনের কাজকে বলা হল ‘জিহার’ এবং তালাকের মতই পরস্পর পরস্পরের জন্য হারাম হয়ে যেতো) এখন আমার স্বামী অনুতপ্ত, সে রাগান্বিত হয়ে একথা বলে ফেলেছে, আমি কসম করে বলছি এটা তালাক নয়। এমন কোন পথ বলে দিন যাতে আমার, আমার বৃদ্ধ স্বামী এবং সন্তানদের জীবন ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা পায়। রাসুল (সা.) নিরুপায়, কিছু বলতে পারলেন না, মাথা নামিয়ে নিলেন। মহিলাটি নিরাশ হলেন না, বারবার রাসুল (সা.) কে রাজি করানোর চেষ্টা করলেন। অতঃপর টলটল চোখে তাকালেন আরশের মালিকের দিকে। পরম আস্থা নিয়ে হাত উঠালেন, আর হৃদয়গ্রাহী শব্দে গভীর আবেগ মিশ্রিত সুরে বললেন, ‘হে মাওলা! আমি আপনের নিকট নিজের কঠিন মুসিবতের ফরিয়াদ করছি। হে আল্লাহ, যা আমাদের জন্য রহমতের কারণ হয়, তা নবীর (সা.) মুখ দিয়ে প্রকাশ করুণ।’
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) বলেন, এ দৃশ্য এত করুণ ছিল যে, ঘরের সকল লোকের চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে যায়। মহিলার হাত তুলে আর্তনাদ তখনও চলছিল। এ বেদনাহত আর্জিতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের আরশ কেপেঁ উঠে, তার রহমতের দরজা ততক্ষণে খুলে যায়। রাসুল (সা.) এর উপর ওহী নাযিলের অপার্থিব প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠে। জিবরাইল (আ.) ওহী নিয়ে এলেন। মহিলাটিকে আয়েশা (রা.) বললেন, হাত নামাও, ওহী এসে গেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) তার মুক্তার দানার মত চকচকে ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘খাওলা’ তোমাকে মোবারকবাদ। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা তোমার ফয়সালা করে দিয়েছেন।
অতঃপর তিনি সুরা মুজাদালা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করলেন। সুরাটির প্রথম চার আয়াতই হযরত খাওলার (রা.) প্রসঙ্গে ছিল। পুরো নাম খাওলা বিনতে সালাবা (রা.), আউস ইবনে আল সামিত (রা.) এর স্ত্রী। মুজাদালাহ অর্থ সেই নারী যে কাতরভাবে অনুনয় বিনয় করে অথবা যে নারী বাদানুবাদ, তর্কাতর্কি করে। এই সেই নারী যে রাসুলের (সা.) দরবারে ফয়সালার জন্য তর্কাতর্কি করেন অবশেষে কাতরকণ্ঠে আল্লাহর দরবারে ধর্না দেন বিচারের জন্য। ওহী না আসা পর্যন্ত বলেই যাচ্ছিলেন। অবশেষে সরাসরি আল্লাহর ফায়সালা পেয়ে ক্ষান্ত হন এবং সন্তুষ্ট হন।
অতঃপর এ সুরায় নাযিলকৃত নির্দেশ মুতাবিধ রাসুল (সা.) খাওলাকে (রা.) বললেন, তোমার স্বামীকে বল একটি গোলাম আযাদ করতে। খাওলা (রা.) আরজ করলেন “ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমার স্বামীর কোন গোলাম নেই।” রাসুল (সা.) বললেন, “তাহলে সে অব্যাহতভাবে ৬০ দিন রোজা রাখবে।”
খাওলা (রা.) বললেন “হে আল্লাহর রাসুল (সা.) আল্লাহর কসম, আমার স্বামী খুবই দুর্বল, সে যদি দিনে তিনবার খানা পিনা না করে তাহলে চোখে দেখতে পায় না। অব্যাহতভাবে ৬০ টি রোজা রাখা তার জন্য অসম্ভব ব্যাপার।” রাসুল (সা.) বললেন ঠিক আছে, তাহলে তাকে ৬০ জন মিসকিনকে খাবার খাওয়াতে বল।
খাওলা (রা.)বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল(সা.) আমার স্বামীর এরও সামর্থ্য নেই, আপনি যদি সাহায্য করেন।” দয়ার সাগর রাসুল (সা.) সাহায্য করলেন যা দিয়ে হযরত আওস (রা.) বিন সামিত সাদাকাহ দিয়ে নিজের জিহারের কাফফারা আদায় করেন। সুরা মুজাদালা নাজিল হবার পর হযরত খাওলা (রা.) মর্যাদা অনেক বেড়ে যায়। বড়ো বড়ো সাহাবারও অনেক সম্মান দিতে লাগলেন, উমর (রা.) তখন আমিরুল মুমিনীন মসজিদে বাহিরে খাওলা (রা.) এর সাথে দেখা, উমর (রা.) তাকে সম্মানের সাথে সালাম জানালেন, কুশল জিজ্ঞাসা করলেন, খাওলা (রা.)ও ততদিনে বয়স হয়েছে কিন্তু উনার প্রগলভতা এতটুকু কমেনি। তিনি উমর (রা.) কে বললেন, হে উমর তোমাকে আমি তখন থেকে চিনি যখন তুমি উকাজের মেলায় বাহিরে হাতে ছড়ি নিয়ে ভেড়া চড়াতে। এখন তোমার উপাধি আমিরুল মুমিনীন। তাই খলিফা হিসাবে আল্লাহকে ভয় কর। মানুষের দেখভালের দায়িত্ব এখন তোমার উপর এবং জেনে রাখো যে আখিরাতের শাস্তিকে ভয় করে সে যেন বুঝতে পারে সেইদিন বেশি দূরে না। আর যে মৃত্যুকে ভয় করে সে এই দুনিয়ার অনেক সুযোগ সুবিধা ছেড়ে দেয়।”
সাহাবি আল জারদ আল আবদি, উমর (রা.) এর পাশেই ছিলেন, তিনি অবাক হয়ে বললেন “এই যে মহিলা, আপনি কিন্তু ভীষণ রুক্ষভাবে আমিরুল মুমিনীনের সাথে কথা বলছেন।” জবাবে উমর (রা.) বললেন, “তাকে বলতে দাও, জান না উনি খাওলা, যার কথা স্বয়ং আল্লাহ পাক সাত আসমানের উপর থেকে শুনেছেন। সে মোতাবেক উমর বাধ্য তার কথা শুনতে।”
অন্য আরেক দিনে এমনই এক ঘটনায় উমর (রা.) বলেছেন, “উনি হলেন খাওলা বিনতে সালাবা, যার কথা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা সাত আসমানের উপর থেকে শুনেন, আল্লাহর কসম যদি না সে আমাকে রাত নেমে আসার আগ পর্যন্ত না ছাড়ে, আমি ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে যেতে বলবোনা, যদি না নামাজের সময় হয়ে যায় এবং আমাকে নামাজ পড়তে যেতে হয় তবে আমি নামাজ পড়ে আবার তার কাছেই ফিরে আসবো যতক্ষণ না যে কাজে সে আমার কাছে এসেছে তা পূরণ হয়।
এতো সেই মহিলার যার ব্যাপারে ‘কাদ সামিয়াল্লাহু’ নাযিল হয়েছে।
লেখক: কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদিকা
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন