বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাবেক এমপি আ ন ম শামসুল ইসলাম বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী, কৃষক, শ্রমিক, নিম্ন মধ্যবিত্তের দেহ থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত টেনে নেয়ার প্রস্তাবই করা হয়েছে। পূর্ববর্তী বছরের বাজেটগুলোর সঙ্গে এই বাজেটের কোনো পার্থক্য নেই। বরং অবস্থা আগের চাইতে আরও খারাপ দাঁড়িয়েছে।এমনকি করের বোঝা জনগণের ওপর যেভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তাতেই বুঝা যায় বাজেটে শ্রমিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
গত ১১ জুন অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থ বছরের জন্য মোটা অংকের যে উচ্চাকাক্ষী অবাস্তব বাজেট পেশ করেছেন সে সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে গতকাল শনিবার এক বিবৃতিতে এই কথা বলেন।
তিনি বলেন, জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী ৫ লাখ ৬৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকার মোটা অংকের যে অবাস্তব বাজেট প্রস্তাব পেশ করেছেন তা সরকারের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না বলেই দেশের অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন।বিশেষ করে এই মহাদুর্যোগকালে স্বাস্থ্য খাতে দুর্বল বরাদ্দ দেশের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞসহ গোটা জাতিকে হতাশ করেছে।
বিবৃতিতে তিনি অারো বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী মোটা অঙ্কের ঋণ নির্ভর বাজেট পেশ করেছেন। বাজেটের শিরোনাম করা হয়েছে ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা’। বলা হয়েছে এটি হবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং মানুষের জীবন রক্ষার বাজেট। বাজেটে প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ, আর বাজেট ঘাটতি হচ্ছে জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫.৪ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেট এবং প্রবৃদ্ধির হার বাস্তবতা বিবর্জিত ও কল্পনা নির্ভর। বাজেটে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে বড় ব্যবধান রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে মোট এডিপি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা, রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা, বৈদেশিক ঋণ ধরা হয়েছে ৭৬ হাজার ৪ কোটি টাকা, ব্যাংক ঋণ ধরা হয়েছে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। ঘাটতি ধরা হয়েছে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের প্রায় ৩ ভাগের এক ভাগই ঋণ নির্ভর। এই ঋণের সুদ পরিশোধ করতেই সরকারের নাভিশ্বাস উঠে যাবে।’
তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে করোনাকালে দিনে আনে দিনে খায়—এ শ্রেণির মানুষের জন্য এবং বেকারত্ব মোকাবিলায় কোনো গঠনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। করোনায় সাধারণ মানুষের আয়ে ঝুঁকি বাড়লেও সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণে বরাদ্দ আগের অর্থবছরের তুলনায় শূন্য দশমিক ২ শতাংশ কমেছে, যা মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এ খাতে চলতি বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৪ দশমিক ৯ শতাংশ।
তাছাড়া বাজেটে কর্মহীন প্রবাসীদের দেশে পুনর্বাসন ও আত্মনির্ভরশীল করে তোলার কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের অস্থিরতা কাটানোর জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ৬ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যে গার্মেন্টসগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু এ সময়টুকু টিকে থাকার মতো সাপোর্ট তাদের দিতেই হবে। অন্যথায় পোশাক খাত মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, করোনা দুর্যোগে আক্রান্ত খাতগুলো আলোচনায় যতটা এসেছে বাজেটে ততটা গুরুত্ব পায়নি। বাস্তবতাকে বিবেচনায় না নিয়ে প্রবৃদ্ধি বেশি দেখানোর প্রবণতা বাজেটের বাস্তবায়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। উচ্চ আয়ের ক্ষেত্রে গত বাজেটে ৩০ শতাংশ কর ধার্য করা ছিল এবার সেটা কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে অথচ মাসে ২৫ হাজার টাকার উপর আয় করলে তাকে করের আওতায় আনা হয়েছে। ভ্যাটের আওতা বাড়ানো হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষ পরোক্ষ কর দিতে বাধ্য হবে। কিন্তু যারা সৎ-অসৎ নানা উপায়ে বিপুল সম্পদ ও প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে কর বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বরং উৎস কর, কর্পোরেট করসহ নানা ক্ষেত্রে রেয়াত দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, ফলে দেশে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ছে।
তিনি সাধারণ মানুষের মোবাইল ও সিমের ওপর কর বৃদ্ধির সমালোচনা করে বলেন, বাজেটে একদিকে সোনার দাম কমানো হয়েছে যা কিনা সমাজের সুবিধাভোগী একটা শ্রেণী ব্যবহার করে। অথচ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ। সেই মোবাইল, সিম ও সার্ভিসের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে বাজেটে। যা সাধারণ জনগণের সাথে তামাশা ছাড়া কিছুইনা।
তিনি আরো বলেন, শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালুর বরাদ্ধ রাখা হয়নি। বেসরকারি খাতের শ্রমিকের আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষে তহবিল গঠন, জাতীয় পেনশন স্কিম প্রণয়নে মধ্যে দিয়ে সকল শ্রমিকের জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু করার যে দাবি ছিল তা বাজেটে প্রতিফলন হয়নি।
তিনি আরো বলেন, ব্যর্থ সরকারের উচ্চাভিলাসী ও অবাস্তব কৌশলী বাজেট দেশের দরিদ্র শ্রমিক জনগোষ্ঠীকে আরো হতাশ করবে। বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫.৪ শতাংশ। বিরাট অংকের বাজেট পেশ করার ফলে মুদ্রাস্ফীতি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রমিক জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ আরো বেড়ে চরম আকার ধারণ করার আশংকা করা হচ্ছে।
আ ন ম শামসুল ইসলাম উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পাট কলগুলোকে চালু করে সেগুলোকে আধুনিকিকরণে বাজেট এবং রাষ্ট্রায়াত্ত পাটকলের শ্রমিকদের শতশত কোটি টাকার পাওনা পরিশোধের কোনো ঘোষণা এ বাজেটে নেই। ফলে পাট শিল্পের শ্রমিকদের এ ন্যায্য দাবিতে আবারও শ্রমিক অসন্তোষের আশংকা রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, জেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ব্যয়ে বিশেষ বরাদ্ধ, শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং হাসপাতাল স্থাপন করা, বন্ধ কল- কারখানা চালু সহ নূন্যতম বেতন মজুরীর জন্য শ্রমিক কর্মচারীদের প্রত্যাশিত কোন ঘোষণা নেই। মালিকপক্ষ কর্তৃক শ্রমিকদের স্বাস্থ্য বীমা প্রণয়ন করা,জাতীয় মজুরি কমিশন/নিম্নতম মজুরি বোর্ডকে শক্তিশালীকরণ ও পুনর্গঠনে কর্মকৌশল প্রণয়ন সংক্রান্ত কোন নির্দেশনা বাজেটে দেওয়া হয়নি।
তিনি নারী শ্রমিকদের জন্য পৃথক ও নিরাপদ বাসস্থান ও ডরমেটরির ব্যবস্থা করা, দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর জন্য (লেস অব ইয়ার আরনিং) মৃত্যুর সময় থেকে চাকরির মেয়াদকাল পর্যন্ত ইনক্রিমেন্ট, মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে মজুরি নির্ধারণ করে ক্ষতিপূরণের জন্য ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেটে উল্লেখযোগ্য বরাদ্ধ না থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার জনগণের নির্বাচিত সরকার নয়। দেশের জনগণের প্রতি এ সরকারের কোন দায়বদ্ধতা নেই। তাই প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের বৃহৎ শ্রমিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থ উপেক্ষা করে সরকারের দলীয় লোকদের ভোগবিলাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ধনীকে আরো ধনী এবং গরিবকে আরো গরিব করা, ধন-বৈষম্য ও শ্রেণি-বৈষম্য বৃদ্ধি করা, সামাজিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্য বৃদ্ধি করা ইত্যাদি হবে এই বাজেটের ফলাফল। এই বাজেট জাতির অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমন্ডলে নৈরাজ্য, অস্থিতিশীলতা বাড়িয়ে তুলবে। তাই শ্রমিক সমাজ প্রস্তাবিত বাজেট ২০২০-২১ প্রত্যাখ্যান করছে।