স্টিল ও রি-রোলিং সেক্টর মানব সভ্যতার সামগ্রিক অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। পৃথিবী সৃষ্টি হতে অদ্যাবধি পৃথিবীতে অবকাঠামোগত যত উন্নয়ন হয়েছে তার পিছনে রয়েছে স্টিল ও রি-রোলিং শিল্পের অবদান। স্টিল ও রি-রোলিং মিল হল রোলিং মিল শিল্পে ব্যবহৃত স্টিল রি-রোলিং মিলগুলোর মধ্যে একটি। যেগুলো বিভিন্ন ধরনের ধাতাববস্তুকে পছন্দসই আকার, বেধ, ঘনত্ব এবং বক্ররেখা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়। এগুলি প্রধানত ইস্পাত, তামা, লোহা, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি থেকে তৈরি পণ্যগুলি রোল বা প্রক্রিয়াজ্ঞাত করতে এবং সেগুলিকে বার, বিম, কোন, চ্যানেল, রড, প্লেট পছন্দসই আকার এব বেধে রূপান্তর করতে ব্যবহৃত হয়। স্টিল রি-রোলিং মিলগুলি ব্যাপকভাবে রোলিং মিল প্লান্ট, সিমেন্ট শিল্প উপাদান, হ্যান্ডেলিং শিল্প, ইস্পাত কারখানা, খনি শিল্প, সার শিল্প, পাওয়ার প্লান্ট, স্পঞ্জ আয়রণ শিল্প এবং সংশ্লিষ্ট খাতে নিযুক্ত হয়।
আকৃতির উপর ভিত্তি করে ইস্পাত শিল্পকে ৩টি ভাগ করা হয়েছে। টিএমটিবার, ফ্ল্যাট স্টিল এবং স্টেইনলেস স্টীল। টিএমটি বারগুলি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং এই শক্তিবৃদ্ধি বারগুলি তাদের কমক্ষয়ের কারণে নির্মাণ শিল্পে সবচেয়ে জনপ্রিয়। ফল স্বরূপ বিশ্বের বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশের নির্মাণ কাজে শুধুমাত্র টিএমটি বার ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে টিএমটি বারগুলি সাধারণ শক্তিশালী কংক্রিট কাঠামো, সেতু এবং ফ্লাইওভার, বাঁধ, তাপ ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প কাঠামো এবং উঁচু ভবন গুলোতে ব্যবহৃত হয়।
ফ্লাট স্টিল গুলো প্রধানত স্বয়ং চালিত শিল্প, গৃহস্থালী যন্ত্রপাতি, জাহাজ নির্মাণ এবং নির্মাণ খাতে ব্যবহৃত হয়। স্টেইনলেস স্টিলগুলো সাধারণ নির্মাণ, রান্নাঘরের জিনিসপত্র এবং চিকিৎসা সরঞ্জামসহ অন্যান্য খাতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে সরকারি খাতে ৬০ শতাংশ স্টিল ব্যবহৃত হয়। ২৫ শতাংশ গৃহস্থালীতে এবং ১৫ শতাংশ বানিজ্যিক নির্মাণে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশে ইস্পাত শিল্পের গোড়াপত্তন হয় চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ এলাকায়। প্রথম ইস্পাত কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫২ সালে। এইটির নাম ছিল ইস্ট বেঙ্গল স্টিল রি-রোলিং মিলস। স্বাধীনতার পরে নাম বদলে হয় বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস বা বিএসআরএম। এটি ছিল দেশে প্রথম ইস্পাত তৈরির কারখানা। ভারতের গুজরাটের বাসিন্দা আকবর আলী আফ্রিকাওয়ালা প্রথম চট্টগ্রামের নাছিরাবাদে এই শিল্প প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে তার ছেলে আলী হোসাইন বাংলাদেশের ইস্পাত শিল্পের আধুনিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে নজর দেন। গড়ে তুলেন বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস বা বিএসআরএম।
এরপর ধীরে ধীরে এ শিল্প চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬০ সালের দিকে সরকারিভাবে পতেঙ্গা এলাকায় বাংলাদেশে প্রথম সরকারি ইস্পাত কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এইটির নাম ছিল চিটাগাং স্টিল মিলস। পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক ইস্পাতের চাহিদা বিবেচনায় রেখে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এটি প্রতিষ্ঠা করে। কারখানাটি বানিজ্যিক উৎপাদনে যায় ১৯৬৭ সালে।
ইস্পাত কারখানাটির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ছিল প্রায় দেড় লাখ টন। যদিও ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় আবুল খায়ের স্টিল, জিপিএইচ ইস্পাত, রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস, কবির স্টিল রি-রোলিং মিলস। গোল্ডেন ইস্পাত, শীতলপুর অটো স্টিল মিলস, এইচ এম স্টিল, বায়েজিদ স্টিল, সীমা স্টিল, পিএইপি ইন্টিগ্রেটেড মিল ইত্যাদি। এইসব কারখানাই দেশের ইস্পাত খাতের রড উৎপাদনের প্রায় ৭০ শতাংশ চাহিদা পূরন করে। বর্তমানে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে দ্রুত বিকাশ মান হচ্ছে ইস্পাত শিল্প। বাংলাদেশে যে পরিমাণ ইস্পাত তৈরি হয় তার ৭০ শতাংশ চট্টগ্রামে উৎপাদন হয়। আমাদের দেশের স্টিল মিলগুলোতে বিশ্বের সর্বোচ্চ উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। দেড়যুগ আগেও এদেশে রড আমদানি করা হতো। এখন সেই চিত্র পাল্টে গেছে। বাংলাদেশ থেকে এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রড রপ্তানি হচ্ছে। দেশের সবগুলো মেগা প্রকল্পসহ পদ্মা সেতু, টানেল নির্মাণেও দেশের তৈরি রড ব্যবহার করা হচ্ছে। মূলত সরকারি বেসরকারিভাবে অব কাঠামোগত উন্নয়নের ফলে ১৯৯০ সালের পর থেকে দেশের লৌহ-শিল্পের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। চট্টগ্রাম বন্দর কেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ঘিরে এই অঞ্চলে শিল্পের বিপ্লব ঘটে। বর্তমানে চট্টগ্রামে প্রায় ১০টির মতো অটোমেটিক স্টিল ও সনাতনী স্টিল মিল রয়েছে প্রায় ২০টি।
ইস্পাত পণ্য প্রস্তুত কারক সমিতি ও উদ্যোক্তাদের তথ্য অনুযায়ী ১০ বছর আগেও দেশে বছরে সম্মিলিতভাবে এস এস রড উৎপাদন হতো ২৫ লাখ টন। বর্তমানে চাহিদা অনুযায়ী বছরে গড়ে উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে প্রায় ৬০ লাখ টন। যদিও বর্তমানে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কারখানা সম্প্রসারণ পদক্ষেপ ইস্পাতের (রড) সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা এখন ৯০ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। কারখানার সক্ষমতা যে গতিতে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে তাতে আগামী বছরে অর্থ্যাৎ ২০২৩ সালে এক কোটিমেট্রিক টনে উন্নীত হবে। এখানে উদ্যোক্তাদের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্প সেক্টরে জড়িত হয়েছে।
৬ কোটি ৩৫ লাখ শ্রম জনশক্তির বাংলাদেশে ৪৩টি সেক্টরে মজুরি বোর্ড আছে। রি-রোলিং স্টিল মিলস তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু বাংলাদেশে শ্রমিকদের সবচেয়ে কষ্টকর এবং সবচেয়ে অবহেলিত সেক্টরের নাম স্টিল রি-রোলিং মিলস। ৪ শতাধিক ছোট বড় রি-রোলিং ও স্টিল মিলে প্রায় ২ লাখ শ্রমিক কী কঠোর পরিশ্রম ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করে। বাংলাদেশে রডের চাহিদা গড়ে ৮০ লাখ টন। এর অধিকাংশই তৈরি হয় রি-রোলিং সেক্টর থেকে। আমাদের দেশে আকরিক বা ক্র্যাপ থেকে লৌহার চাহিদা মেটানো হয়। লৌহা দ্বারা প্রয়োজনীয় দ্রব্য তৈরির জন্য লৌহাকে গলিয়ে বিভিন্ন আকৃতি দিতে হয়। ১৫৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় লৌহা গলানো হয়। ফলে যে ফার্নেস লৌহা গলানোর কাজ হয় তার বাইরে ৬০-৬৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপ থেকে। স্বাভাবিকভাবে আমরা দেখি ৩৫-৩৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেখানে ৬০-৬৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় কী কঠিন পরিস্থিতি হয় তা অনুমান করাও কষ্টকর।
রি-রোলিং সেক্টরটা প্রচলিত অন্যান্য শিল্পকারখানা থেকে একটু ভিন্নতর। কারখানায় কর্মঘণ্টার ধরন, ঝুঁকি ও পরিবেশের ম্যানুয়াল চালিত কারখানায় একজন শ্রমিক ৪৫ মিনিট কাজ করে ১৫ মিনিট বিরতি নিয়ে ২ ঘন্টা কাজ করে। প্রচণ্ড গরম ও পরিশ্রমের কাজ বলে শ্রমিকদের দরদর করে ঘায়ের ঘাম ঝরতে থাকে।
শ্রম আইনে উল্লেখ থাকলেও অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য বেশিরভাগ কারখানায় শ্রমিকদের নিয়োগপত্র বা পরিচয়পত্র নেই। ৫ বছর পরপর মজুরি ঘোষণা করার আইন থাকলেও রি-রোলিং সেক্টরে ২০১১ সালের পর গত ২০২০ সালের ২৮ জুন শ্রমিকদের জন্য যে মজুরি কমিশন ঘোষণা করা হয় তাতে শ্রমিকদের প্রত্যশা অনুযায়ী হয়নি। এই কমিশনে ন্যূনতম সর্বোচ্চ মজুরি ১২৪০০/- টাকা এবং ন্যূনতম সর্বনিন্মমজুরী স্কেল ৫৯০০/- টাকা নির্ধারণ করা হয়। এতে রি-রোলিং মিলের শ্রমিক কর্মচারীরা সারাদিন রাত শরীরের ঘাম ঝরিয়ে অনাহারে অর্ধহারে, অনাহারে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকরা অকালে মৃত্যুমুখে ধাবিত হয়। যে কোন অবকাঠামো অভ্যন্তরে যেমন লৌহা থাকে তেমনি উন্নয়ন ও উৎপাদনের অভ্যন্তরে আছে লৌহা উৎপাদনের সাথে শ্রমিকদের শ্রম এবং ঘাম। কিন্তু এর মূল্য ও স্বীকৃতি দুটো থেকেই বঞ্চিত শ্রমিকরা। রি-রোলিং শ্রমিক কর্মচারীদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে নিন্মের সমস্যাসমূহ সমাধান করা একান্ত প্রয়োজন।
১. রি-রোলিং মিলে কর্মরত প্রত্যেক শ্রমিকের নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র প্রদান করা।
২. পে-স্কেল শিপ ব্রেকিং শ্রমিকদের মজুরি এবং বাজারদরের সাথে সংগতি রেখে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা।
৩. রি-রোলিং মিলে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দিতে হবে, যাতে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ মালিকদের সাথে বসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
৪. কর্মস্থলে নিরাপত্তা, আজীবন আয়ের সমান মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ, আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
৫. শ্রমিকদের জন্য সরকার কর্তৃক রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
স্টিল রি-রোলিং সেক্টরে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হল অপর্যাপ্ত কাঁচামাল। বাংলাদেশে ইস্পাত উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল এখনো আমদানি করতে হয়। বর্তমানে দেশে কর্মরত শিপ ব্রেকিং শিল্পের মালিকগণ ইস্পাত শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যথেষ্ট পরিমাণে সরবরাহ করতে পারছে না। ফলে এই অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল আমদানি করা খুবই কষ্টসাধ্য এবং সময় সাপেক্ষ কাজ যা বেশ চ্যালেঞ্জিং। কাঁচা মালের ঘাটতি এবং উচ্চ মূল্যের কারণে অনেক রি-রোলিং মিল বর্তমানে বন্ধ হয়ে আছে। ফলে এই শিল্পে কর্মরত হাজার হাজার শ্রমিক বেকারত্বের কারণে অনাহারে অর্ধহারে দিনাতিপাত করছে। সরকারের নীতি এবং প্রবিধান পরিবর্তনের ফলে রি-রোলিং শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ননীতি প্রায়ই শুল্ক আইন, আয়কর, মূল্য সংযোজন কর অথবা অন্যান্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থার ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। এই ধরনের নীতি পরিবর্তনের ফলে রি-রোলিং সেক্টর বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। কাঁচামালের ঘাটতি পূরণে দিনাজপুরে লৌহ আকরিকের রিজার্ভের সন্ধান পাওয়ায় আশার সঞ্চার হয়েছে। দিনাজপুরে এই নতুন লৌহ আকরিকের উৎসের সন্ধান নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে যা আগামী ৩০ বছরের জন্য লৌহা আকরিক সরবরাহ করতে পারে।
বাংলাদেশের ইস্পাত শিল্পের বিকাশের জন্য অভ্যন্তরীন উৎপাদন এবং মূলধনী পণ্য ক্রয় বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তাছাড়া বাংলাদেশের ইস্পাত খাতে গবেষণা ও উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য ঘাটতি রয়েছে। যা পূরণ করা হলে প্রবৃদ্ধি আরো বাড়বে। দক্ষ শ্রমের বিকাশকে কাজে লাগিয়ে এবং সেক্টরে কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করতে পারলে দেশের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব। উপরন্তু ইস্পাত শিল্পের শ্রমশক্তির নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করা আজ সময়ের দাবী।
লেখক, সভাপতি বাংলাদেশ ব্যক্তিমালিকানাধীন স্টিল রি-রোলিং শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন, রেজি: নং- বি-১৮৩৭