বাংলাদেশে অর্থনীতির নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে নিত্যপণ্যের বাজারে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। ক্রমেই নানা অজুহাতে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় বাজারে গিয়ে হিসেব মিলাতে পারছে না ক্রেতারা। ফলে ব্যয়ের ক্ষেত্রে কাটছাঁট করতে একরকম বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ। এখন বাংলাদেশের প্রধান আলোচ্য বিষয় নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধি। ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধিপাচ্ছে এসব পণ্যের মূল্য। কোন কোন পণ্যের মূল্য দ্বিগুণ, তিনগুণ বেড়েছে। গত কয়েকমাস ধরে এসব পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে চরম বিপাকে পড়েছেন দেশের সাধারণ মানুষ। শ্রমজীবীদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। চাল, ডাল, ডিম, চিনি ও তেলসহ প্রায় প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম এখন আকাশচুম্বী। সাধ্যের বাইরে মুরগি, গরু ও খাসির গোশত।
একথা বর্তমানে অকাট্য সত্য যে, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসহ প্রায় সকল প্রকার সামগ্রীর মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে পড়েছে। এমন কোন আইটেম নেই, যার দাম কমেছে বলে শোনা যায়। একজন খেটে খাওয়া শ্রমজীবী অসহায় সাধারণ নাগরিকের ব্যক্তিগত আয় রোজগারের সাথে এই মূল্যবৃদ্ধির কোন সামঞ্জস্য নেই। বাজারের অবস্থা বর্তমানে এমনই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, বাজার ব্যবস্থার যে একটি স্বাভাবিক নিয়ম-কানুন থাকে, তাও ভেঙে পড়ার উপক্রম। একের পর এক মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কাই এখন বাজারের স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা দেশের সীমিত আয়ের শ্রমজীবী মানুষের জীবনে যে কিভাবে শোচনীয় অবস্থা ডেকে আনে, তা বোধকরি না বললেও চলে। ২০২২ সালে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বিগত দিনের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
চাল নিয়ে চালবাজি থামছেই না। কোনভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম স্বাভাবিক থাকার কথা থাকলেও বাজারে দেখা যাচ্ছে তার উল্টো চিত্র। মে ২০২২ এর শেষ সপ্তাহ থেকে চালের বাজার রহস্যজনকভাবে অশান্ত হয়ে উঠে। প্রতিদিনই দাম বাড়তে থাকে। চালের দাম বাড়ায় চরম বিপাকে পড়ছে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ। এ সময় প্রতিবছর চালের দাম কমে। এবার তার উল্টো চিত্র। মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের কারসাজি, দুর্ভিক্ষ ধেয়ে আসছে ক্ষমতাসীনদের শীর্ষ মহল থেকে এমন বক্তব্য এবং মজুদদারি দামবৃদ্ধির কারণ। চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন করে মোটা চালের দাম না বাড়লেও বেড়েছে চিকন চালের দাম। সরকারের বিপণন সংস্থা টিসিবির ভাষ্যমতে চিকন চালের কেজি ৩ টাকা বাড়িয়ে ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা, মাঝারি বা পাইজাম চাল ২ টাকা বাড়িয়ে ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা এবং মোটা চালের কেজিতে ২ টাকা বাড়িয়ে ৪৮ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছে, টিসিবির তথ্যের থেকে কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা বেশি দামে চাল বিক্রি হচ্ছে। মাঠ থেকে আমন ধান কৃষকের গোলায় উঠতে শুরু করেছে। আর নতুন চাল ইতোমধ্যে বাজারেও এসেছে। বর্তমানে দাম বৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণ না থাকলেও চালের দাম বাড়ছেই। মূলত ২০২৩ সালের সম্ভাব্য বিশ্বমন্দাকে পুঁজি করে একটি চক্র এখন থেকেই চালের দাম বাড়াতে শুরু করেছে, যাতে দীর্ঘ সময় তারা বাড়তি মুনাফা করতে পারে।
নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসহ প্রায় সকল প্রকার সামগ্রীর মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে পড়েছে। এমন কোন আইটেম নেই, যার দাম কমেছে বলে শোনা যায়। একজন খেটে খাওয়া শ্রমজীবী অসহায় সাধারণ নাগরিকের ব্যক্তিগত আয় রোজগারের সাথে এই মূল্যবৃদ্ধির কোন সামঞ্জস্য নেই। বাজারের অবস্থা বর্তমানে এমনই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, বাজার ব্যবস্থার যে একটি স্বাভাবিক নিয়ম-কানুন থাকে, তাও ভেঙে পড়ার উপক্রম। একের পর এক মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কাই এখন বাজারের স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা দেশের সীমিত আয়ের শ্রমজীবী মানুষের জীবনে যে কিভাবে শোচনীয় অবস্থা ডেকে আনে, তা বোধকরি না বললেও চলে।
চালের বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের খুচরা বাজার, পাইকারি কিংবা মিলগেট-কোথাও চালের ঘাটতি নেই। তারপরও নানান অজুহাতে দিনের পর দিন অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে চালের দাম। দাম বৃদ্ধির ফলে মধ্যবিত্ত, নি¤œ আয়ের মানুষ ও শ্রমজীবীদের নাভিশ^াস ওঠেছে। ইতোমধ্যেই শ্রমজীবী মানুষদের দুর্ভোগও শুরু হয়ে গেছে। দাম বাড়ার কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য মতে ৪টি কারণ সামনে এসেছে। এগুলো হচ্ছে-
১. অতিরিক্ত উৎপাদন খরচ; আমনে উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
২. বাজার থেকে কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর চাল মজুদ;
৩. সাম্প্রতিক সময়ে সংকটের খবরে সাধারণ মানুষের হঠাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাল ক্রয়, আগামী বছর সংকট হতে পারে সেই খবরে মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাল কিনছে।
৪. কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে মজুদ করছেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা।
আটা আর চিনি দাম নিয়ে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। আটার দাম বেড়েছে প্রতি কেজিতে ১০-১৫ টাকা পর্যন্ত। রাজধানীর বাজার সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, সব দোকানেই প্যাকেটজাতও খোলা আটার দাম বেড়েছে। এখন প্রতিকেজি খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা। যা আগে ছিল ৫০-৫৫ টাকা কেজি। আর দুই কেজি ওজনের প্যাকেটজাত আটা বিক্রি হচ্ছে ১৪৫-১৫০ টাকা। যা আগে ছিল ১২৫-১৩৫ টাকা। প্যাকেট ময়দা প্রতি কেজি ৫ টাকা বেড়ে ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চিনি দাম এখন আকাশচুম্বী। জানা গেছে, ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে চিনির দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। প্রতিকেজি খোলা চিনি ১০২ ও প্যাকেটজাত চিনি ১০৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বাজারে সে নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে না পারায় চিনি বিক্রি বন্ধ রেখেছেন বলে জানান খুচরা ব্যবসায়ীরা। বাজারে এখন সব ধরনের চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১৫-১২০ টাকা কেজিতে। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে চাহিদা মতো চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের চিনি কেনাই পড়ে ১১২ টাকা। তাই তারা চিনি কেনেনও না; বিক্রিও করেন না।
অন্যদিকে প্রতি কেজি আমদানি করা রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৪০ টাকায়। বোতলজাত তেল প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকায়। এছাড়া বাজারে প্রতি কেজি গরুর গোশত ৭০০ টাকা ও খাশির গোশত ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সোনালী মুরগি ২৮০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা ও দেশি মুরগি ৫০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মুরগির ডিম প্রতি ডজন ১২০ টাকা আর হাঁসের ডিম প্রতি ডজন ২১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে শুধু উপরিউক্ত পণ্য নয় বরং সকল পণ্যের দামই প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অথচ নানাবিধ কারণেই এখন সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের ক্রয়ক্ষমতা একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে নেমে এসেছে।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ
বাংলাদেশে ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণসমূহ নিম্নরূপ:
১. ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট: দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ। সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণেই বাংলাদেশের মূল্য পরিস্থিতি একেবারে অসহনীয় পর্যায়ে উঠে এসেছে। মধ্যস্বত্বভোগী আর সিন্ডিকেটের কবলে দেশবাসী। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কুটিল কারসাজির মাধ্যমে পণ্যদ্রব্যের দাম বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা হস্তগত করে, এটি ইসলামে নিষিদ্ধ। অন্যের হক এভাবে হস্তগত করার কারণে আখেরাতে তো বিপর্যয় আসবেই, দুনিয়াতেও এর কুফল দেখা দেয় মারাত্মকভাবে।
২. মজুদদারি: মজুদদারি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এক শ্রেণির অতি মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপণ্যের মজুদ গড়ে তুলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বলে প্রায়ই অভিযোগ ওঠে। অন্যকথায় মজুদদারির মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে হঠাৎ করে বা পরিকল্পিতভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়। অবৈধ মজুদদাররা ইসলামে ঘৃণিত। মহানবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যবসায়ী খাদ্যপণ্য গুদামজাত করে এ উদ্দেশ্যে যে, মূল্যবৃদ্ধি হলে তা বিক্রি করবে, আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে দুনিয়াতে অভাব অনটন ও রোগব্যাধির মধ্যে রাখবেন। সংকটকালে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো ব্যবসায়ী মজুদদারদের একটা কৌশল।
৩. চাঁদাবাজি: মূল্যবৃদ্ধির কারণের মধ্যে পরিবহনে যত্রতত্র চাঁদাবাজিও একটি কারণ। সড়কে মহাসড়কে এবং বাজারে, ফুটপাতে, পণ্য বিক্রয় স্থানে চাঁদাবাজির ফলে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। শিল্প মালিক, উদ্যোক্তা, উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের ওপর মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ব্যবসায়ী এবং উৎপাদকরা চাঁদাবাজদের প্রদত্ত চাঁদার ক্ষতি দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি করে পুষিয়ে নেয়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভোক্তারা। অন্য কথায় চাঁদাবাজির কারনেই সাধারণ মানুষ পণ্যমূল্য আগ্রাসনের শিকার হয়। উৎপাদক তার পণ্যের সঠিক মূল্য না পেলেও চাঁদাবাজদের প্রাপ্তিতে কোন ঘাটতি নেই। নানা উপলক্ষ্যেও চাঁদা দাবি করা হয়। ব্যবসায়ী, আড়তদার, দোকানদার প্রতিদিন অভিনব চাঁদাবাজির শিকার হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের দাবিকৃত মোটা অংকের চাঁদা দিতে ব্যত্যয় ঘটলে ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তারা সন্ত্রাসী হামলার শিকার হচ্ছে। চাঁদাবাজরা জোরপূর্বক অর্থ আদায় করে থাকে। চাঁদাবাজি এক ধরনের জুলুম।
৪. আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি: আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব অভ্যন্তরীন বাজারেও পড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে কোন পণ্যের দাম বেড়ে গেলে অভ্যন্তরীণ বাজারে স্বাভাবিক ভাবেই এর মূল্য বেড়ে যায়। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার জন্য ব্যবসায়ীরা প্রায়শই আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে কয়েকগুন বেশি মূল্যে পণ্য বিক্রি করছেন পাইকারী ব্যবসায়ীরা।
৫. অভ্যন্তরীণ বাজারে সুশাসনের অভাব: এদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থায় সুশাসনের অভাব রয়েছে। যে কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু মূল্যস্ফীতিই নয় বরং বাজারভেদে একই পণ্যের মূল্যের ভিন্নতা নিয়ে সম্প্রতি গুরুতর প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি সরকারি সংস্থাগুলোর মূল্য তালিকায় রয়েছে নানা ধরনের অসঙ্গতি। যা বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থার নৈরাজ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
৬. অতি মুনাফালোভী চক্রের ষড়যন্ত্র: অতি মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ী একটি চক্র প্রায়ই বাজারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালিয়ে থাকে, যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাগণ, অসহায় শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষজন।
৭. জবাবদিহির অভাব: সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তুলে ধরা অসঙ্গত নয় যে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় কর্তৃপক্ষের জবাবদিহির মনোভাব কমে গেছে। ফলে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে নাগরিকদের দুর্ভোগ অনেক বাড়লেও কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনছেন না কেউ।
৮. রিবা বা সুদ: রিবা বা সুদের উপস্থিতির ফলে দ্রব্যমূল্য ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। সুদবিহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদনকারী, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী উৎপাদনের খরচের উপর পরিবহন খরচ, শুল্ক (যদি থাকে), অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় এবং স্বাভাবিক মুনাফা যোগ করে থাকে। কিন্তু সুদভিত্তিক অর্থনীতিতে পণ্যদ্রব্যের এই স্বাভাবিক মূল্যের ওইসব অনুষঙ্গের সঙ্গে উপুর্যপরি সুদ যোগ করে দেওয়া হয়। দ্রব্য বিশেষের উপর তিন থেকে চারবার পর্যন্ত, ক্ষেত্রবিশেষে তারও বেশিবার সুদ যুক্ত হয়ে থাকে ফলে দ্রব্যসামগ্রী মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে থাকে। মানুষ নিষ্পেষিত হয় দ্রব্যমূল্যের জাঁতাকলে। ভোক্তাকে নিরুপায় হয়েই সুদের জন্য সৃষ্ট এই চড়া মূল্য দিতে হয়। সুদনির্ভর অর্থনীতিতে এ ছাড়া আর গত্যন্তর নেই।
৯. অতিরিক্ত পরিবহন ভাড়া: অতিরিক্ত পরিবহন ভাড়াও দ্রব্যমূল্যের উপর প্রভাব ফেলে। পরিবহন খরচ বেশি এ অজুহাতে ব্যবসায়ীরা দফায় দফায় জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি; শ্রমজীবী মানুষের দুর্ভোগ ও করণীয়
দেশে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির ফলে শ্রমজীবী মানুষের ভোগান্তি আজ চরমে। শ্রমজীবীরা আজ বড়ো অসহায়। ক্রয় ক্ষমতা শ্রমজীবীদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। প্রতিনিয়তই কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে। শ্রমজীবীদের কষ্ট কেবলই বাড়ছে। দেশে একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠী ছাড়া বেশিরভাগ মানুষের আয় বাড়েনি। উপরন্তু অনেকের বিশেষ করে শ্রমজীবীদের আয় কমে গেছে। অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। শ্রমজীবীদের অনেকের কর্ম নেই। অথচ এমন অবস্থাতেও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। এমন পরিস্থিতিতেও গত বেশ কয়েক মাস ধরে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম অত্যন্ত চড়া। আমদানি করা পণ্যের ক্ষেত্রে যেমন, দেশে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম কেবলই বাড়ছে যৌক্তিক কারণ ছাড়া। আগেই বলা হয়েছে এ অবস্থার জন্য যেমন দায়ী আমাদের ব্যবসায়ী সমাজের অতি মুনাফা লোভ, তেমনি বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। মূল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়ায় দুরবস্থার মধ্যে পড়েছেন সাধারণ শ্রমজীবী অসহায় মানুষ। শাসক শ্রেণির মাত্রাতিরিক্ত গোষ্ঠীপ্রীতি এ সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
এসময়ে করণীয় সমূহ নিম্নরূপ হতে পারে:
১. খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে রেখে জরুরি খাদ্য সরবরাহ যাতে ঠিক থাকে, সেটিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
২. বাজার ব্যবস্থাপনায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়াতে হবে।
৩. বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সঠিক মূল্যসহ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে নাগরিক সাধারণ এবং শ্রমজীবীগণ তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে পারেন।
৪. সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় শ্রমজীবী মানুষকে নিয়ে আসতে হবে।
৫. অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
৬. অপচয় রোধ করতে হবে।
৭. একটি ভারসাম্যপূর্ণ স্বল্পকালীন অর্থনৈতিক কৌশল নিতে হবে। এজন্য গবেষণায় আরও নজর দিতে হবে।
৮. শ্রমিকদের বেতন/শ্রমমূল্য বাড়াতে হবে যাতে অন্তত দুবেলা কোনমতে খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে।
৯. শ্রমিকদের দুর্দিনে মালিকপক্ষ, সকল বিত্তবানকে সহায়তার মনোভাব নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
১০. ইসলামী শ্রমনীতিকে সর্বমহলে জনপ্রিয় করতে হবে, মনে রাখতে হবে এর মধ্যেই শ্রমজীবীদের কল্যাণ রয়েছে।
সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাহায্য কামনা করতে হবে, যিনি প্রকৃতঅর্থে রিজিকের মালিক।
লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্যাংকার।