দুনিয়া আখিরাতের শস্যক্ষেত্র। আল্লাহ তাআলা মানুষকে শ্রম শক্তি দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। শ্রম যেমন হবে ফলাফলও সে অনুযায়ীই হবে। শ্রমের ফলাফল যেমনই হোক আল্লাহর কাছে বান্দার শ্রমের মর্যাদা অনেক বেশি। কারণ এ শ্রমের মাধ্যমেই আখিরাতের সফলতা লাভের ঘোষণা এসেছে। যিনি শ্রম দেন বা কাজ বাস্তবায়ন করেন তিনি হলেন শ্রমিক। শ্রমিক যদি তাঁর কাজ যথাযথভাবে আদায় করে, তবেই সে পাবে তার সুস্পষ্ট ফলাফল। মানুষের জীবনের সকল কর্ম বা শ্রমের মধ্যেই রয়েছে দুনিয়া এবং আখিরাতের কর্মফল। যে কারণে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদায় সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন। পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম আলাইহিস সালাম নিজে কৃষিকাজে শ্রম দিয়ে সংসারে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতেন। পাশাপাশি মা হাওয়া আলাইহিস সালাম কাপড় বুনন, সেলাই এবং কৃষি যন্ত্রপাতি নির্মাণ করে হজরত আদম আলাইহিস সালামের শ্রম সহযোগিতায় অবদান রাখতেন।
হজরত নুহ আলাইহিস সালাম মহাপ্লাবনের পূর্বে আল্লাহর নির্দেশে নিজ শ্রমের মাধ্যমে এক বিশাল কিস্তি নির্মাণ করেছিলেন। তিনতলা ও বহু কক্ষবিশিষ্ট এই কিস্তি নির্মাণের শ্রম বিফলে যায়নি। এ শ্রমের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা দুনিয়ায় মানুষের অনেক কল্যাণ এবং সকল জীবের অস্তিত সংরক্ষণসহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের মহাপ্লাবন থেকে রক্ষা করেছিলেন। ইসলামে ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত করা হয়েছে হালাল রুটি এবং রুজিকে। মানুষের সঠিক ও কঠোর শ্রমের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দ্বারাই জীবিকা নির্বাহের নির্দেশনা রয়েছে। শ্রমের মধ্যে যদি ফাঁকি বা প্রতারণা থাকে তবে সে অর্থের জীবিকা ভক্ষণে ইবাদাত করলে তা হবে নিষ্ফল ইবাদাত। শ্রমকে মানুষ কষ্ট মনে করলেও প্রকৃতপক্ষে শ্রমের মাধ্যমেই মানুষ সুস্থ ও সবল দেহ লাভ করে থাকে। শ্রম মানুষের সুস্থ ও সবল থাকার কার্যকর টনিক হিসেবে কাজ করে। অলসতা ও কর্ম বিমুখতা মানুষকে অসুস্থ ও অন্যায় পথে পরিচালিত করে।
মুসলিম জাতির আদিপিতা হযরত ইবরাহীম (আ.) এবং তার পুত্র হযরত ঈসমাইল (আ.) আল্লাহর হুকুমে নিজ হাতে পবিত্র কাবাঘর নির্মাণ করেছেন। যেখানে আজও লক্ষ লক্ষ মুসলমান হজের উদ্দেশ্যে একত্রিত হয় সবই ঘরকে কেন্দ্র করে যার মাধ্যমে নির্মাণ শ্রমিকের মর্যাদা লক্ষ কোটিগুণ বৃদ্ধি করেছে।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিশু জীবনে দুধমাতা হালিমার গৃহ থেকে শুরু করে ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত সমগ্র জীবনই কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা করে গেছেন।
হজরত হালিমা সাদিয়ার গৃহে তিনি নীরবে নিভৃতে দুধভাই আব্দুল্লাহর সাথে ছাগল ও ভেড়া চড়াতেন। হাদিসে এসেছে, তিনি বলেছেন, “আল্লাহ দুনিয়াতে এমন কোন নবি পাঠাননি যিনি ছাগল ও ভেড়া চরাননি। তখন সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, হে রাসুল! আপনিও? তিনি বলেন, হ্যাঁ! আমিও কয়েক কীরাতের বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল ও ভেড়া চরাতাম।” (বুখারি)
যৌবনে চাচার সংসারের সহযোগিতায় ব্যবসায় আত্ম নিয়োগ করেন। এমনকি তিনি হজরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার ব্যবসায়ও শ্রম দিয়েছেন। নবুয়ত প্রাপ্তির পর ইসলামের প্রচার ও প্রসারে কঠোর শ্রম দেন। এমনকি হিজরতের পর মদিনার প্রায় মসজিদ নির্মাণে স্বশরীরে অংশ গ্রহণ করেন। ইসলামের বিজয় সুনিশ্চিত করতে সরাসরি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন। যুদ্ধ জয়ের কৌশল হিসেবে পরিখা খননেও অংশ গ্রহণ করেন। বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এর রকম অসংখ্য শ্রমের উদাহরণ রয়েছে।
শ্রম বিশ্বমানবতাকে দিয়েছে সম্মান ও মর্যাদার আসন। শ্রমের মাধ্যমেই মানুষ প্রমাণ করেছেন যে, তাঁরা সৃষ্টির সেরা জীব। তাই আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি জগতের অসংখ্য সৃষ্টিকে মানুষের অধীন করে দিয়ে বলেন, “তিনিই (আল্লাহ) তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রাত-দিন, চন্দ্র ও সূর্যকে এবং নক্ষত্ররাজিও অধীন হয়েছে তাঁরই বিধানে। অবশ্যই এতে রয়েছে বুদ্ধিমান জাতির জন্য নিদর্শন এবং তিনি সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের বস্তু তোমাদের জন্য।” (সুরা নহল : ১২-১৩)
সমাজে নির্মাণ শ্রমিকের অবদান ও মূল্যায়ন
যে সব শ্রমিক ভবন, সড়কপথ, রেল, বিমানবন্দর, স্টেডিয়ামসহ বড়ো বড়ো স্থাপনা নির্মাণ, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস-টেলিফোন লাইন স্থাপন ও মেরামত, জলাশয়, বাঁধ, জলাধার ও সুড়ঙ্গসহ যেকোন প্রকার উন্নয়ন প্রকল্পে যেকোন রকম স্থাপনা নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ এমনকি ভাঙার কাজ করছেন তাঁরাই নির্মাণ কর্মী বা রাজমিস্ত্রি। একজন নির্মাণ শ্রমিকের অধীনে কয়েকজন শ্রমিক কাজ করে থাকে।
সমাজে নির্মাণ শ্রমিকের অবদান
১. সভ্যতার বিনির্মাণ: একজন নির্মাণ শ্রমিকের অবদানে সভ্যতা সৃষ্টি হয়েছে। বড়ো বড়ো শহরের বড়ো বড়ো অট্টালিকা তৈরির পিছনে সবচেয়ে বড়ো অবদান রয়েছে একজন নির্মাণ শ্রমিকের। বলা যায় সভ্যতার বিনির্মাণ শুরু হয় নির্মাণ শ্রমিকের হাত ধরে।
২. রাস্তা-ঘাট নির্মাণ: আমাদের চলাচলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাঘাট নির্মাণ করে রাস্তাঘাট নির্মাণ করে নির্মাণ শ্রমিকরা। তারা সঠিকভাবে কাজ করে রাস্তাঘাট নির্মাণ করে বলেই আমরা অনায়াসে একস্থান থেকে অন্যস্থানে খুব দ্রæত যেতে পারি।
৩. অবকাঠামোগত উন্নয়নে ভূমিকা: একটি দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে নির্মাণ শ্রমিক শ্রমজীবী মানুষদের ভ‚মিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে যে কোন ধরনের স্থাপনা যেমন বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, স্টেডিয়াম, ভাস্কর্য, সেতু, উড়াল সড়ক, রাস্তা, বাঁধ, কৃত্রিম জলাধার, পানি-গ্যাস-তেল সঞ্চালন লাইন, পয়োনিষ্কাশন লাইনসহ নগরায়নের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে একজন নির্মাণ শ্রমিকের কাজ।
৪. জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা: একজন নির্মাণ শ্রমিক যখন উঁচু উঁচু ভবন নির্মাণের কাজ করেন তখন তাদের জীবনের অনেক ঝুঁকি থাকে। ১০/১৫ তলা ভবনের কাজে যখন একজন নির্মাণ শ্রমিক বিভিন্ন জিনিসপত্র ওঠানামার করেন তখন যে কোন মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে তারা কাজ করলেও তাদের সমস্যা দেখার কেউ নেই। এখন নির্মাণ শ্রমিকদের শ্রম আইনের আওতায় তাদের মজুরি নির্ধারণ করা হলেও ভবন নির্মাতারা সেটুকুও মানেন না। নিজেদের জীবনের মায়া না করে যারা পৃথিবীর সভ্যতা নির্মাণের কাজ করে যাচ্ছে সে সকল শ্রমিকদের সঠিক মূল্যায়ন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
নির্মাণ শ্রমিকদের সঠিক মূল্যায়নে করনীয়:
১. কাজের সঠিক পারিশ্রমিক দেওয়া: নির্মাণ পেশায় কাজ করা শ্রমজীবী মানুষদের কাজের পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক দিয়ে তাদের কাজের মূল্যায়ন করা ।
২. প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা: নির্মাণকাজ যেহেতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় সেহেতু এই কাজ করা লোকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাদের কর্ম দক্ষতা উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা ।
৩. অতিরিক্ত কাজের সম্মানী প্রদান: নির্মাণ শ্রমজীবী মানুষদের দিয়ে অতিরিক্ত কোন কাজ করার সাথে সাথে তাদের সেই কাজের অতিরিক্ত সম্মানী প্রদান করতে হবে।
৪. ঝুঁকিভাতা প্রদান: নির্মাণ শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করে থাকে। তাই তাদের কাজের ঝুঁকি অনুযায়ী তাদেরকে প্রয়োজনীয় ঝুঁকি ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫. নিরাপত্তা প্রদান: রাজ কাজে জড়িত মিস্ত্রিদের জীবনের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. সামাজিক অধিকারের নিশ্চয়তা: নির্মাণ কাজে জড়িত সকল নির্মাণ শ্রমিককে কোনোভাবেই সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। সকল সামাজিক সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে তাদের কাজের মূল্যায়ন ।
৭. পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রদান: একজন নির্মাণ শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সামগ্রী প্রদান করে তাদের কাজকে আরও সহজ ও গতিশীল করা।
৮. অতিরিক্ত চাপ থেকে বিরত রাখা: একজন নির্মাণ শ্রমিক যেহেতু অনেক বেশি কায়িক পরিশ্রম করেন তাদেরকে অবশ্যই অতিরিক্ত চাপ না দেওয়া উচিত। তাদের কাজকে সহজ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। রাসুল (সা.) শ্রমজীবী মানুষদের ওপর এমন কোন কাজের বোঝা চাপিয়ে দিতে নিষেধ করেছেন যা তার জন্য অসহনীয় হয়। (বুখারী)
৯. কর্মস্থানে নিহত শ্রমিকের পরিবারের ভরন পোষনের ব্যবস্থা: কোন নির্মাণ শ্রমিক কাজ করতে গিয়ে যদি মারা যায় তাহলে তার পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া।
বাংলাদেশে নয় শুধু পৃথিবীর অনেক দেশেই পরিবহনের পরপরই নির্মাণ খাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে বিভিন্ন সংগঠনের পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে। শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করছে এমন একটি সংগঠন বলছে, নির্মাণ খাতে গত বছর ১৩৪ জন শ্রমিক নিহত হয়েছে। তারপরও বিষয়গুলো অবহেলিতই থেকে যায়। কখনও অবস্থা চরমে পৌঁছালে তখন দু-একটা ঘটনা প্রকাশ হলে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশ্ন আসে। তবে ইদানীং ট্রেড ইউনিয়ন হওয়ার কারণে নির্মাণ শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায়ে সোচ্চার হয়েছে। শ্রমিকদের দাবি নিয়ে বিভিন্ন সমাবেশ করা হয়েছে । এসব সমাবেশে নির্মাণ শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন শ্রমিক নেতারা। তাদের দাবি-দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকদের একজীবনের সমপরিমান ক্ষতিপূরণ শ্রমআইনের আওতায় আনতে হবে। প্রতি মাসে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের বোর্ড সভা করতে হবে এবং শ্রমিকদের পেনশন স্কিম, রেশনিং ব্যবস্থা, বাসস্থান ও কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনও নির্মাণ শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে বেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
পরিশেষে বলবো
ইসলামের রীতি-নীতি ও বিধানের আলোকে দেশের সর্বোচ্চ মহল সরকার থেকে শুরু করে সমাজের প্রত্যেক দায়িত্বশীলের উচিত, শ্রমের মর্যাদা এবং শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার আদায় করা। কারণ সমাজের সবচেয়ে দামি ও উপকারী শ্রেণি হচ্ছে শ্রমিক সমাজ। মানব সমাজের উন্নতি ও অগ্রগতির চাকা ঘুরছে শ্রমিকদের হাতে। একটি টেকসই ও উন্নত সমাজ বিনির্মাণে সবাই শ্রমিকদের পরিশ্রমের কাছে ঋণী। আল্লাহ তাআলা সমাজের সর্বস্তরের দায়িত্বশীলদেরকে শ্রম ও শ্রমিকের মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠা এবং তাদের অধিকার রক্ষা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: কেন্দ্রীয় কর্মসংস্থান বিষয়ক সম্পাদক
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন