رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ (১০০) فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ (১০১) فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ (১০২) فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ (১০৩) وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ (১০৪) قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ (১০৫) إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ (১০৬) وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ (১০৭) وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ (১০৮)
অনুবাদ: ১০০. হে পরওয়ারদিগার! আমাকে একটি সৎকর্মশীল পুত্র সন্তান দাও। ১০১.(এ দোয়ার জবাবে) আমি তাকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। ১০২. সে পুত্র যখন তার সাথে কাজকর্ম করার বয়সে পৌঁছলো তখন (একদিন ইবরাহীম তাকে বললো, “হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি তোমাকে আমি জবেহ করছি, এখন তুমি বলো তুমি কি মনে করো ?” সে বললো, “হে আব্বাজান! আপনাকে যা হুকুম দেওয়া হচ্ছে তা করে ফেলুন, আপনি আমাকে সবরকারীই পাবেন ইনশাআল্লাহ। ১০৩. শেষ পর্যন্ত যখন এরা দু’জন আনুগত্যের শির নত করে দিল এবং ইবরাহীম পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিল। ১০৪. এবং আমি আওয়াজ দিলাম, “হে ইবরাহীম! ১০৫. তুমি স্বপ্নকে সত্য করে দেখিয়ে দিয়েছো। আমি সৎকর্মকারীদেরকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। ১০৬. নিশ্চিতভাবেই এটি ছিল একটি প্রকাশ্য পরীক্ষা। ১০৭. একটি বড় কুরবানির বিনিময়ে আমি এ শিশুটিকে ছাড়িয়ে নিলাম। ১০৮. এবং পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে চিরকালের জন্য তার প্রশংসা রেখে দিলাম।
নামকরণ:
প্রথম আয়াতের (وَالصَّافَّاتِ صَفًّا) শব্দ থেকে সুরার নাম গৃহীত হয়েছে ‘আস-সফ্ফাত’।
নাজিলের সময়কাল:
এ সুরাটি সম্ভবত মক্কি যুগের মাঝামাঝি সময়ে ও শেষের দিকে নাজিল হয়। এ সময় ইসলাম বিরোধিদের চরম বিরোধিতা চলছিলো এবং নবি (সা.) ও তাঁর সাহাবিগণ অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছিলেন।
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:
এ সময় নবি (সা.) এর তাওহীদ ও আখেরাতের দাওয়াতের জবাব দেওয়া হচ্ছিল নিকৃষ্ট ধরনের রঙ-তামাসা ও ঠাট্টা-বিদ্রুপের মাধ্যমে। রসুল (সা.) এর রিসালাতকে জোরে-শোরে অস্বীকার করা হচ্ছিল। মক্কার এ সকল কাফেরদেরকে অত্যন্ত কঠোরভাবে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে এবং পয়গম্বরকে বিদ্রুপ করার পরিণাম খুব শিগগির জানতে পারবে। ঈমান ও সৎকাজের ফল কত মহান ও গৌরবময় তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতিহাস বর্ণনা করে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন নবিদের এবং তাঁদের অনুসারীদের সাথে ইসলামের শত্রুরা কি ব্যবহার করেছে। আল্লাহ তাঁর বিশ্বস্ত বান্দাদেরকে কিভাবে পুরস্কৃত করেছেন এবং কিভাবে তাদের প্রতি মিথ্যা আরোপকারীদেরকে শাস্তি দিয়েছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি শিক্ষণীয় হচ্ছে হযরত ইবরাহীম (আ.) এর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আল্লাহর একটি ইশারাতেই তিনি নিজের একমাত্র পুত্রকে কুরবানি দিতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন। এ ঘটনা শুনিয়ে ইসলামী সমাজ কায়েমের কর্মীকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, একজন সত্যিকার মুমিনকে কিভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির খাতিরে নিজের সবকিছু কুরবানি করে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।
ব্যাখ্যা
১০০ ও ১০১ নং আয়াত:
হে পরওয়ারদিগার! আমাকে একটি সৎকর্মশীল পুত্র সন্তান দাও। (এ দোয়ার জবাবে) আমি তাঁকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।
হযরত ইবরাহীম (আ.) ছিলেন আল্লাহর প্রেরিত নবি ও রসুল। যার পিতা ছিলো একজন মূর্তিপূজক ও নির্মাতা। সে দেশের রাজা নমরুদও ছিল একজন জালিম শাসক যিনি নিজেকে রব হিসেবে ঘোষণা দিত, নিজে মূর্তিপূজা করত এবং সকলকে সেটা করতে বাধ্য করত। হযরত ইবরাহীম (আ.) জাতির উপাস্য মূর্তিগুলোকে পূজা না করে উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করলেন, “হে আমার সম্প্রদায় তোমরা যাদেরকে আল্লাহর শরীক বলে মনে কর তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবল সেই মহান সত্তাকেই ইবাদাত-বন্দেগীর জন্য নির্দিষ্ট করলাম যিনি সমস্ত আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের মধ্যে শামিল নই।” (সুরা আল আন’আম: ৭৮-৭৯)
অতঃপর যখন হযরত ইবরাহীম (আ.) কে বাধ্যকরা হলো নমরুদকে রব হিসেবে মেনে নিতে, তখন তিনি বাদশাহর প্রকাশ্য দরবারে স্পষ্ট ভাষায় বললেন, “তুমি আমার ‘রব’ নও, আমার ‘রব’ তিনিই যাঁর মুষ্টিতে তোমার আমার সকলেরই জীবন ও মৃত্যু নিহিত রয়েছে।” রাজ দরবার থেকে শেষ পর্যন্ত ফয়সালা হলো, ইবরাহীম (আ.) কে জীবন্ত জ্বালিয়ে ভষ্ম করা হবে। কিন্তু ইবরাহীম (আ.) এর দিল ছিল পর্বত অপেক্ষা অধিকতর শক্ত। একমাত্র আল্লাহর ওপরেই ভরসা করে ভয়াবহ শাস্তি ভোগ করতে তিনি অকুন্ঠ চিত্তে প্রস্তুত হলেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে আগুনের মধ্যে ফেলে দেওয়া হলো। কিন্তু আল্লাহ তাআলা সে আগুনকে নিভিয়ে দিলেন। আল-কুরআনের ভাষায়, “তারা বললো, ‘তাকে আগুনে পুড়িয়ে দাও এবং তোমাদের দেবদেবীদেরকে সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও’। আমি বললাম, ‘হে আগুন, তুমি শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও ইবরাহীমের জন্য’।” (সুরা আম্বিয়া: ৬৮-৬৯)
এর পর তিনি জন্মভূমি, জাতি, আত্মীয়-স্বজন সবকিছু পরিত্যাগ করে শুধু নিজের স্ত্রী ও ভ্রাতুষ্পুত্র লুত (আ.) কে সাথে নিয়ে পথে পথে, দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন এবং সমগ্র দুনিয়াকে রবের দাসত্ব কবুল করার আহŸান জানাতে লাগলেন। এই বর্ণাঢ্য জীবনে আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম (আ.) কে একের পর এক পরীক্ষা নিয়েছিলেন এবং তিনি প্রতিটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, অতঃপর আল্লাহ তাঁকে সারা দুনিয়ার নেতা বানিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, স্মরণ করো যখন ইবরাহীমকে তার রব কয়েকটি ব্যাপারে পরীক্ষা করলেন এবং সেসব পরীক্ষায় সে পুরোপুরি উত্রে গেলো, তখন তিনি বললেনঃ “আমি তোমাকে সকল মানুষের নেতার পদে অধিষ্ঠিত করবো।” ইবরাহীম বললোঃ “আর আমার সন্তানদের সাথেও কি এই অঙ্গীকার?” জবাব দিলেনঃ “আমার এ অঙ্গীকার যালেমদের ব্যাপারে নয়।” (সুরা আল বাকারা: ১২৪)
হযরত ইবরাহীম (আ.) এর উপরে আর একটি নির্দেশ ছিল বৃদ্ধ বয়সে খাতনা করা। তিনি ৮০ বছর বয়সে নিজেই নিজের খাতনা করে আল্লাহর সে নির্দেশ পালন করেছিলেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, “আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ইব্রাহীম (আ.) কুড়াল দ্বারা নিজের খাতনা করেছিলেন এবং তখন তাঁর বয়স ছিল আশি বছর। (সহীহ আল বুখারী)
সারা জীবন দ্বীনের প্রচার-প্রসারে কাটিয়েছেন, পরীক্ষায় পড়েছেন আবার উত্তীর্ণ হয়েছেন। এভাবে দ্বীনের দাওয়াতী কাজ করতে করতে বয়সন্ধিক্ষণে উপনীত হলেন। বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত অবস্থায় তিনি মনে করলেন আমার মৃত্যুর পরে দ্বীনের এই কাজের আঞ্জাম দিবে কে ? মনে মনে ভাবলেন, আমার একটা সন্তান থাকলে আমার পরে এই পৃথিবীতে দ্বীনের প্রচারের কাজ করতে পারবেন। অতঃপর তিনি আল্লাহর কাছে সন্তান প্রার্থনা করলেন এবং আল্লাহও সে দোয়া কবুল করে প্রথমে একজন আনুগত্যশীল সন্তান হযরত ইসমাইল (আ.) কে দান করলেন। আল্লাহ বলেন, “আর স্মরণ কর এই কিতাবে ইসমাঈলকে। সে ছিল সত্যিকারের ওয়াদা পালনকারী এবং সে ছিল রসুল ও নবি।” (সুরা মরিয়ম: ৫৪-৫৫)
পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ.) কে ইসহাক (আ.) নামে আরও একটি সন্তান উপহার দেন। আল্লাহ বলেন, “আর আমি তাকে ইসহাকের সুসংবাদ দিয়েছিলাম, সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত একজন নবি হিসেবে।” (সুরা সাফ্ফাত: ১১২)
১০২ নং আয়াত
সে পুত্র যখন তার সাথে কাজকর্ম করার বয়সে পৌঁছলো তখন (একদিন ইবরাহীম তাঁকে বললো, “হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখি তোমাকে আমি জবেহ করছি, এখন তুমি বল তুমি কি মনে করো ?” সে বললো, “হে আব্বাজান! আপনাকে যা হুকুম দেওয়া হচ্ছে তা করে ফেলুন, আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ সবরকারীই পাবেন।”
নবিদের স্বপ্ন সত্য হয় কারণ নবিরা ঘুমালেও তাদের অন্তর জাগ্রত থাকে। এ সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, এক রাতে নবি (সা.) ঘুম থেকে উঠলেন এবং রাতের কিছু অংশ চলে যাবার পর রসুলুল্লাহ (সা.) একটি ঝুলন্ত মশক থেকে হালকা অজু করলেন। রাবী আমর (রা.) বলেন, তখন তিনি যেভাবে অজু করেছেন আমিও সেভাবে অজু করলাম এবং এসে তাঁর বাঁয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। তারপর রসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে ঘুরিয়ে তাঁর ডান দিকে দাঁড় করালেন। এরপর যতক্ষণ ইচ্ছা ততোক্ষণ তিনি নামাজ আদায় করলেন। এরপর কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন, এমনকি তাঁর নাক ডাকতে থাকল। এরপর মুয়াজ্জিন এসে তাঁকে সালাতের কথা জানিয়ে দিলেন। তিনি তাঁর সঙ্গে সালাত এর জন্য রওয়ানা হলেন এবং সালাত আদায় করলেন, কিন্তু অজু করলেন না। আমরা আমরকে বললাম, লোকে বলে যে, রসুলুল্লাহ (সা.) এর চোখ ঘুমায় কিন্তু তাঁর অন্তর ঘুমায় না। তখন আমর (রা.) বলেন, আমি উবায়দ ইবনু উমায়র (রা.) কে বলতে শুনেছি, নবিগণের স্বপ্ন ওহী। এরপর তিনি তিলাওয়াত করলেন, إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ ‘আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে জবেহ করছি’। (সহীহ আল বুখারী)
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ (যখন ইসমাঈল (আ.) চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছল) এর ব্যাখ্যায় তাবারী বলেন, তখন ইসমাঈল (আ.) যৌবনে পদার্পন করেছেন এবং কাজ-কর্ম করার বয়স হয়েছে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ইসমাইল (আ.) কে যখন কুরবানি করা হয় তখন বালক অবস্থায় ছিলেন।
ইমাম কুরতুবী ইবনে আব্বাসের বরাত দিয়ে বর্ণনা করেছেন, যখন ইবরাহীম (আ.) কে ইসমাইল (আ.) কে কুরবানি করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল, তখন শয়তান তাঁর কাছে এসে ধোঁকা দিয়েছিলো তিনি পাথর মেরে বিতাড়িত করেছিলেন। অতঃপর জিবরাঈল (আ.) তাঁকে জামারাতুল আকাবায় নিয়ে গেলেন সেখানে শয়তান ধোঁকা দিলো তিনি ৭টি পাথর মেরে শয়তানকে বিতাড়িত করলেন। অতঃপর আল-জামরাহ আল-উস্তাতে শয়তানকে আবার দেখালেন, তখন তিনি তার দিকে ৭টি পাথর নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর ইসমাঈল (আ.) পিতার কথামত আনুগত্য প্রদর্শন করে নিজেকে কুরবানির জন্য পেশ করলেন, ইবরাহীম (আ.) সন্তানের গলায় ছুরি চালানো শুরু করবেন তখন তাঁর পেছন থেকে জিবরাঈল (আ.) ডাক দিলেন, “হে ইব্রাহীম, তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছো।” অতঃপর তিনি পিছনে ফিরে একটা দুম্বা দেখতে পেলেন যার শিং ছিলো বড়ো বড়ো দেখতে খুবই সুন্দর। এটা দ্বারা তারা কুরবানি করলেন। (মুসনাদে আহমদ)
পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরে আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম (আ.) কে সারা পৃথিবীর নেতা বানালেন এবং মুসলিম মিল্লাতের পিতা হিসেবে আখ্যা দিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, “এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের দ্বীন। তিনিই তোমাদের নাম রেখেছেন ‘মুসলিম’ পূর্বে এবং এ কিতাবেও। যাতে রসুল তোমাদের জন্য সাক্ষী হয় আর তোমরা মানুষের জন্য সাক্ষী হও।” (সুরা আল হাজ্জ ৭৮)
১০৩-১০৫ নং আয়াত
শেষ পর্যন্ত যখন এরা দু’জন আনুগত্যের শির নত করে দিল এবং ইবরাহীম পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিল। এবং আমি আওয়াজ দিলাম, “হে ইবরাহীম! তুমি স্বপ্নকে সত্য করে দেখিয়ে দিয়েছো। আমি সৎকর্মশীলদের এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি।
আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য তাঁরা দুজনেই চূড়ান্তভাবে আনুগত্যের শির নত করলেন। অর্থাৎ ইবরাহীম (আ.) নিজপুত্র ইসমাইল (আ.) কে কুরবানি করার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য প্রস্তুত হলেন। আর ইসমাইল (আ.) ধৈর্যের চরম পরাকাষ্টা প্রদর্শন করে পিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে কুরবানি হতে রাজি হয়ে গেলেন এবং পিতাকে বললেন, আপনি আমাকে কুরবানি করুন, এ ব্যাপারে আমাকে আপনি ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। অতঃপর হযরত ইবরাহীম ও ইসমাইল (আ.) দুজন আল্লাহর আত্মনিবেদিত বান্দা মক্কা নগরীর অদূরে জনমানবহীন ‘মিনা’ প্রান্তরে গেলেন। একজন কুরবানি হবেন, আর একজন কুরবানি দিবেন। যখন ইবরাহীম (আ.) ছুরি চালাবেন তখন আল্লাহ ডাক দিলেন, ‘হে ইবরাহীম’। এ আয়াতে এটাই বলা হয়েছে, وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ (আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, ‘হে ইবরাহীম)
যখন কোন মুমিন একনিষ্টভাবে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে তখন আল্লাহ তার জন্য রাস্তা বের করে দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, “যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন। এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেনই। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।” (সুরা আত-ত্বালাক: ২-৩) তারা দু’জনেই যখন আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন, তখন আল্লাহ তাঁকে ডাক দিয়ে বললেন, قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا ‘ইবরাহীম তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছো’।
১০৬ ও ১০৭ নং আয়াত
নিশ্চিতভাবেই এটি ছিল একটি প্রকাশ্য পরীক্ষা। একটি বড়ো কুরবানির বিনিময়ে আমি এ শিশুটিকে ছাড়িয়ে নিলো।
ইবনে যায়েদ (إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, এটি সেই পরীক্ষা যা ইবরাহীম (আ.) এর উপর এসেছিল যে, সে তার ছেলেকে জবাই করেছিল এবং এটি ছিলো অত্যন্ত কষ্টদায়ক পরীক্ষা। (তাফসীরে তাবারী)
হযরত ইবরাহীম (আ.) পুত্র সন্তানকে জবেহ করা উদ্দেশ্য ছিলো না। বরং দুনিয়ার কোনো জিনিসকে আল্লাহর মোকাবিলায় বেশি প্রিয় মনে করে কি না, সে পরীক্ষা নেওয়াই ছিল আল্লাহর আসল উদ্দেশ্য। ইবরাহীম (আ.) সেটাই করেছিলেন নিজের সবকিছুকে নিচে ফেলে আল্লাহর নির্দেশ পালন করেছিলেন। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَإِبْرَاهِيمَ الَّذِي وَفَّى “আর ইবরাহীমের কিতাবের নির্দেশ, তিনি পূর্ণ করেছিলো।” (সুরা আন নজম: ৩৭)
অতঃপর তারা দু’জনে যখন পরীক্ষায় পাস করলেন, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা মহান জবেহের মাধ্যমে তাঁদেরকে মুক্ত করা হলো। وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ এ আয়াতে ইবরাহীম (আ.) এর কুরবানির মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে। আরবীতে عَظِيم (আজীম) বলা হয় ঐ জিনিসকে যার কোনো তুলনা হয় না। আল-কুরআনে ইবরাহীম (আ.) এর কুরবানিকে আজীম বলা হয়েছে এবং রসুল (সা.) এর চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ عَظِيم (আজীম) শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন- وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ “আর নিশ্চয় তুমি মহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত।” (সুরা আল কলম: ৪)
অর্থাৎ ইবরাহীম (আ.) এর কুরবানির মতো কোনো কুরবানি যেমন হবে না ঠিক তেমনি রসুল (সা.) এর চরিত্রের মতো চরিত্র দুনিয়ায় আর কারো হবে না।
১০৮ নং আয়াত
এবং পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে চিরকালের জন্য তার প্রশংসা রেখে দিলাম।
আমাদের সমাজে যে কুরবানির নিয়ম চালু আছে তা হযরত ইবরাহীম (আ.) এর স্মৃতিচারণ। হযরত ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক শিশুপুত্র ইসমাঈল (আ.) কে আল্লাহর রাহে কুরবানি দেওয়ার অনুসরণেই আমরা ঈদুল আযহায় কুরবানি করে থাকি। তাই এই কুরববানীকে ‘সুন্নাতে ইবরাহীমী’ হিসাবেও অভিহিত করা হয়। আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ ও নিজেকে একনিষ্ঠভাবে তাঁর কাছে সপে দেওয়ার প্রকৃষ্ট নমুনা এই কুরবানিতে ফুটে ওঠে। নিম্মে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
কুরবানির গুরুত্ব:
আল-কুরআন ও হাদিসে কুরবানির ব্যাপারে অনেক তাকীদ দেওয়া হয়েছে। আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, “আর কুরবানীর পশু সমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে।” (সুরা আল হাজ্জ: ৩৬)
অন্য আয়াতে নামাজের সাথে সাথে পশু কুরবানির কথা বলা হয়েছে,“তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং কুরবানি কর।” (সুরা আল কাওছার: ২)
হাদিসে বলা হয়েছে, সামর্থ্য থাকার পরেও যদি কেউ কুরবানি না করে তাহলে সে যেন ঈদগাহে না যায়। “যার কুরবানি করার সামর্থ্য রয়েছে তবুও কুরবানি করল না। তবে যেন সে আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।” (সুনান আন-নাসায়ী ও মুসনাদে আহমদ)
কুরবানি করার দিন ও সময়:
আরবি জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে এই কুরবানির ইবাদত পালন করতে হয়। যেটা জবেহ করতে হবে ঈদের নামাজের পরে, আগে নয়। যেমন- “যে ব্যক্তি নামাজ আদায়ের আগে জবেহ করল সে নিজের জন্যই জবাই করল। আর যে ব্যক্তি নামাজ আদায়ের পর জবেহ করল তার কুরবানি পূর্ণ হলো এবং সে মুসলিমদের নীতি অনুসরণ করল।” (সহীহ আল বুখারী)
কুরবানির গোশত বণ্টনের বিধান:
কুরবানির পশুর গোশত নিজে ভক্ষণ করা এবং সমাজের অসহায়-দরিদ্র মানুষের মাঝে বিতরণ করা সুন্নাত। “তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু থেকে যে রিজিক দিয়েছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে। অতঃপর তোমরা তা থেকে খাও এবং দুস্থ-দরিদ্রকে খেতে দাও।” (সুরা আল হাজ্জ: ২৮)
কুরবানির সওয়াব:
ঈদুল আজহার দিনে পশু কুরবানি করার চাইতে অধিক ভালো কাজ আর নেই। “কুরবানির দিনে আদম সন্তানগণ এমন কোনো কাজ করতে পারে না যা আল্লাহর নিকট রক্ত প্রবাহিত করার (অর্থাৎ কুরবানি করা) চেয়ে বেশি প্রিয় হতে পারে। কুরবানির সকল পশুর শিং, পশম, এদের ক্ষুরসহ কিয়ামতের দিন (কুরবানিকারীর নেকীর পাল্লায়) এসে হাজির হবে। কুরবানীর পশুর রক্ত মাটি স্পর্শ করার পূর্বেই আল্লাহর নিকট মর্যাদাকর স্থানে পৌঁছে যায়। তাই তোমরা কুরবানির মাধ্যমে তোমাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করো। (তিরমিযী, ইবনু মাজাহ)
“রসুলুল্লাহ (সা.) এর সাহাবিগণ বললেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! এই কোরবানি কী ? তিনি বলেন, তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ.) এর সুন্নাত। তারা পুনরায় জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রসুল! এতে আমাদের জন্য কী (সওয়াব) রয়েছে ? তিনি বলেন, প্রতিটি পশমের পরিবর্তে পূণ্য হবে। এদের পশম তো অনেক বেশি ? তিনি বললেন, পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে। (সুনান আন-নাসায়ী ও আহমদ)
কুরবানির শিক্ষা:
কুরবানি কেবল শুধু পশু জবেহ করা নয়, বরং নিজের পশুত্ব, নীচতা, স্বার্থপরতা, হীনতা, আমিত্ব ও অহংকার কুরবানি করা। নিজের নামাজ, কুরবানি, জীবন-মরণ সব কিছু কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য চূড়ান্তভাবে ত্যাগ করাই হচ্ছে প্রকৃত কুরবানি।
“বলো, ‘নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু আল্লাহর জন্য, যিনি সকল সৃষ্টির রব’। তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমাকে এরই নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। আর আমি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম’। (সুরা আনআম: ১৬২-১৬৩)
স্ত্রীর মুহাববত, সন্তানের ভালোবাসা, সম্পদের মোহ, ভোগ-বিলাসের আকর্ষণ সবকিছুর ঊর্ধ্বে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণ করাই হলো কুরবানির মূল শিক্ষা। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মানতে ইবরাহীম (আ.) নিজ জীবনে সেটাই প্রমাণ করেছিলেন।
“যখন তার রব তাকে বললেন, ‘তুমি আত্মসমর্পণ কর’। সে বলল, ‘আমি সকল সৃষ্টির রবের কাছে নিজকে সমর্পণ করলাম’।” (সুরা আল বাকারা: ১৩১)
উপরিউক্ত দারস থেকে বলা যায়, ইবরাহীম (আ.) এর মতো নিজের পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততির চাইতে আল্লাহকে বেশি ভালোবাসতে হবে, মহান রবের কাছে আত্মসমর্পণকারী ও তাঁর জন্য আত্মত্যাগী হতে হবে। আমাদের ইবাদত-বন্দেগী, নামাজ-কুরবানি, জীবন-মরণ সবকিছু আল্লাহর জন্যই উৎসর্গ করতে হবে। তাহলেই প্রকৃত মুমিন ও মুসলিম হওয়া সম্ভব হবে।
লেখক: বিশিষ্ট দায়ী ও ইসলামী চিন্তাবিদ