মানুষ আল্লাহ তায়ালার অতি গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি, আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে ভূষিত করা হয়ে থাকে মানুষকে। শারীরিক গঠন কিংবা শক্তিমত্তার বিচারে এ শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়নি মানুষকে। বিবেক বুদ্ধির মাপকাঠিতে সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের অনুপম বৈশিষ্ট্য সৌন্দর্যমণ্ডিত হলো এ মানবজাতি। গোটা সৃষ্টি জগতকে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাসযোগ্য করার ব্যতিক্রমধর্মী দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এ জাতিকে; যা খিলাফতেরই অংশ বটে।
আল্লাহ তায়ালার নাযিলকৃত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী গ্রন্থ হলো আল কুরআন। যাতে রয়েছে পাহাড় পর্বতের চমৎকার বর্ণনা, আসমান জমিনের বিশালত্বের দৃষ্টান্ত উপস্থাপনা, মহাকাশ, চন্দ্র, সূর্য, রাত দিনের আবর্তন বিবর্তনের অসাধারণ বর্ণনাশৈলী, বাদ যায়নি এতে মশা, উকুন, মাছির মতো অতি নগণ্য জীবের আলোচনা; গরু, ছাগল, ভেড়ার মতো গৃহপালিত জন্তুর আলোচনা যেমন সন্নিবেশিত হয়েছে এ মহাগ্রন্থে, তেমন বাঘ, সিংহ, গাধার মতো বন্য প্রানীর আলোচনাও উপস্থাপিত হয়েছে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে। আকাশে বিচরণশীল পাখির বৈশিষ্ট্য যেমন তুলে ধরা হয়েছে, ঠিক পানিতে সাঁতার কাটা মাছেরও উল্লেখ রয়েছে এতে। কিন্ত গোটা কুরআনের কোথাও একবারের জন্যও উচ্চারিত হয়নি, “ওহে গরু” অথবা “ওহে আকাশ” সম্বোধন করে। অথচ বারবার উচ্চারিত হয়েছে, “ওহে মানব সকল।” এর দ্বারাই অনুমিত হয় মহাগ্রন্থ আল কুরআনের অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ই হলো মানুষ। নিম্মে কুরআনের আলোকে আমরা মানুষের সৃষ্টির সূচনা, গঠন প্রক্রিয়া, মানুষের দায়িত্ব কর্তব্য, মানুষের বৈচিত্রময়ী বৈশিষ্ট্যের একটা চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস পাব, ইনশাআল্লাহ।
মানব সৃষ্টির সূচনা ইতিহাস সবারই জানা। সুরা বাকারার ৩০ নং আয়াতে রয়েছে এর চমৎকার বর্ণনা। আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাগণকে নতুন এ সৃষ্টির ব্যাপারে ধারণা দিলেন, তাঁরা ভবিষ্যতে মানুষের দ্বারা সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা ও রক্তপাতের আশঙ্কা ব্যক্ত করে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন, নিজেদের ইবাদাত বন্দেগীর উপর আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে নতুন সৃষ্টির অপ্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। কিন্ত মহান আল্লাহ তায়ালা জ্ঞানের পরিক্ষায় প্রথম মানব আদমকে (আ.) শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে ফেরেশতাগণের উপর সম্মানিত করেছেন এবং এ জাতিকে খিলাফতের দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীকে সুশৃঙ্খলভাবে আবাদ করার মতো মহান জিম্মাদারীতে ভূষিত করেছেন। ফেরেশতার মোকাবিলায় যে মানুষকে সম্মানিত করা হয়েছে, সে মানুষ জাতির সদস্য হিসেবে আমাদের দায়িত্ববোধ কতটা মজবুত হওয়া কাম্য; তা ভাবতেই শরীরে অন্য রকম শিহরণ অনূভূত হয়।
মানুষের গঠনাকৃতি কাঠামোগত দিক থেকে সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্যের অর্ন্তভূক্ত। কিন্ত এর গড়ে উঠার প্রক্রিয়া অত্যন্ত দুর্বলভাবে রাখা হয়েছে, যাতে মানুষ নিজের সৃষ্টির তুচ্ছতা উপলদ্ধি করে অহংকার থেকে মুক্ত থাকতে পারে। যুগের পর যুগ মানুষ অস্তিস্তহীন থাকা, এক ফোঁটা বীর্যের মাধ্যমে জীবনের সূচনা হওয়া, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে বেড়ে উঠা, সামান্য অসুস্থতায় কাতর হয়ে নিজের প্রচণ্ড সীমাবদ্ধতা আঁচ করতে পারার মতো; এমন ব্যতিক্রমী গঠন প্রক্রিয়াই মানব জীবনের অনিবার্য বাস্তবতা। সুরা আম্বিয়ার ১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “আমি তোমদের নিকট কিতাব নাযিল করেছি, যাতে রয়েছে তোমাদের-ই আলোচনা, তোমরা কি ভাববে না?” সত্যিই কুরআনে রয়েছে আমাদেরই কথা, আমাদেরই বর্ণনা। আমরা মানুষ কী করব? কোথায় থেকে এসেছি আমরা? জীবনের নির্ধারিত সীমা শেষ করে আমরা আবার কোথায় ফিরে যাব? কী আমাদের দায়িত্ব? কেমন আমাদের বৈচিত্রময়ী বৈশিষ্ট্য? কোনটা অনালোচিত রয়েছে এ মহাগ্রন্থে? আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “এ মাটি থেকেই আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, এরই মধ্যে আমি তোমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যাব এবং এ থেকেই আবার তোমাদেরকে বের করব।” (সুরা ত্বহা : ৫৫)
“তোমরা কি মনে করেছ, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি? তোমাদেরকে কি আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না?” (সুরা মুমিনুন : ১১৫)
“আমি অবশ্যই জীন এবং মানুষকে আমার ইবাদাত ছাড়া ভিন্ন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি।” (সুরা যারিয়াত : ৫৬)
মানুষের বৈচিত্রময়ী বৈশিষ্ট্য : বলা হয়ে থাকে, “হাজার মানুষ হাজার মত।” বাস্তবিকই অজুত কোটি মানুষের চিন্তা-ভাবনা, জীবনাচার, অনূভূতি, দৃষ্টিভঙ্গি অজ¯্র ধরনের। মনে হয় যেন প্রতিটি মানুষ স্বতন্ত্র, কারো সাথে কারো সম্পূর্ণ মিলে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। কেউ রাগী আবার কেউ সরল, কেউ বিনয়ী আবার কেউ ঔদ্ধত্য প্রকাশকারী, কেউ অস্থির আবার কেউ সুস্থির, কেউ বিচক্ষণ আবার কেউ আনাড়ি, কেউ বিশ্বাসী আবার কেউ অবিশ্বাসী, কেউ কেউ জ্ঞান ও যুক্তিবোধের যথেষ্ট অনুরাগী আবার বিপরীতে কেউ হলো গোঁড়া প্রকৃতির; এভাবে মানুষের নানা বৈচিত্রময়ী বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে আল কুরআনে।
কুরআনে আমরা দেখি, মানুষ যখন আল্লাহ তায়ালার বিধানের যথাযথ আনুগত্য করে তখন তারা সেরা জীবের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখে, বিপরীতে যখন সে দেখেও দেখে না, শুনেও শুনে না, হৃদয় দিয়ে সত্য সুন্দরের উপলদ্ধি করে না; তখন সে চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও জঘন্য হিসেবে পরিগণিত হয়। অনেক মানুষ নিজের আত্মপরিচয় জানে না, সে নিজেকে এত তুচ্ছ ও হীন মনে করে যে, সে তার মতো অন্যান্য সৃষ্টি যেমন গাছ, পাথরের কাছে মাথানত করে আত্মমর্যাদা ভুলুণ্ঠিত করে। বিপরীতে এমন মানুষও আছে যারা নিজের সৃষ্টির সূচনা ভুলে গিয়ে আত্ম অহংকারে ফুলে উঠে, স্বয়ং তার স্রষ্টার সাথে বাক বিতণ্ডায় লিপ্ত হয়, নিজেকে সার্বভৌম দাবি করে বসে। যেমন ফেরাউন তার অধীনস্থদের বলেছিল, “আমিই তোমাদের সবচেয়ে বড়ো প্রভু।” (সুরা নাযিয়াত : ২৪)
এ জন্য আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “অতএব মানুষের দেখা উচিত, তাকে কোথায় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে? তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সবেগে উত্থিত (তুচ্ছ) পানি থেকে।” (সুরা তারেক : ৫-৬)
“মানুষ কি দেখে না, তাকে আমি সৃষ্টি করেছি শুক্রবিন্দু থেকে এবং তারপর সে দাঁড়িয়ে গেছে স্পষ্ট ঝগড়াটে হয়ে? এখন সে আমার ওপর উপমা প্রয়োগ করে এবং নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে যায় বলে, এ হাড়গুলো যখন পঁচে গলে গেছে এতে আবার প্রাণ সঞ্চার করবে কে? তাকে বলো, এদেরকে তিনি জীবিত করবেন যিনি প্রথমে এদেরকে সৃষ্টি করেছিলেন এবং তিনি সৃষ্টির প্রত্যেকটি কাজ জানেন।” (সুরা ইয়াছিন : ৭৭-৭৯)
কত নিখুঁত এবং আশ্চর্যজনক প্রক্রিয়ায় মানুষকে সৃষ্টি করা হযয়েছে, তা ভাবলে কৃতজ্ঞতায় মস্তক অবনত হয়ে আসে। এবং নির্ধারিত হায়াত শেষ করে আবার তাঁর কাছেই ফিরে গিয়ে কড়া গণ্ডায় হিসাব দিতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আমি মানুষকে তৈরি করেছি মাটির উপাদান থেকে, তারপর তাকে একটি সংরক্ষিত স্থানে টপকে পড়া ফোঁটায় পরিবর্তিত করেছি, এরপর সেই ফোঁটাকে জমাট রক্তপিণ্ডে পরিণত করেছি, তারপর সেই রক্তপিণ্ডকে মাংসপিণ্ডে পরিণত করেছি, এরপর মাংসপিণ্ডে অস্তি-পিঞ্জর স্থাপন করেছি, তারপর অস্তি-পিঞ্জরকে ঢেকে দিয়ছি গোশত দিয়ে, তারপর তাকে দাঁড় করেছি স্বতন্ত্র একটি সৃষ্টি রূপে। কাজেই আল্লাহ বড়ই বরকত সম্পন্ন, সকল কারিগরের চাইতে উত্তম কারিগর তিনি। এরপর তোমাদের অবশ্যই মরতে হবে, তারপর কিয়ামতের দিন নিশ্চিতভাবেই তোমাদের পুনরুজ্জীবিত করা হবে।” (সুরা মুমিনুন : ১২-১৬)
মানুষ এক সংগ্রামী জীব, তাকে সৃৃষ্টি করা হয়েছে পরিশ্রম প্রিয়তার মধ্যে। “আসলে আমি মানুষকে কষ্ট ও পরিশ্রমের মধ্যে সৃষ্টি করেছি, সে কি মনে করে রেখেছে, তার ওপর কেউ জোর খাটাতে পারবে না?” (সুরা বালাদ : ৪-৫)। এ চেষ্টা-প্রচেষ্টা, সংগ্রাম চলতে হবে মহান রবের কাক্সিক্ষত সান্নিধ্য পাওয়া পর্যন্ত। কুরআনের বাণী, “হে মানুষ! তুমি কঠোর পরিশ্রম করতে করতে তোমার রবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছো, পরে তাঁর সাথে সাক্ষাত করবে।” (সুরা ইনশিকাক : ৬)
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা যেভাবে মানুষের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন, প্রতিটি ব্যক্তিই তার নিজ বৈশিষ্ট্যের চিত্র কুরআনের মধ্যে দেখতে পাবে, সে যেমন মানুষই হোক না কেন ভালো কিংবা মন্দ। কোটি কোটি মানুষের এমন একজনও পাওয়া যাবে না, যার চিত্র কুরআনে না অঙ্কিত হয়েছে।
কুরআনে আলোচিত সাধারণত মানুষের কমন চিত্র হলো, বিপদে আল্লাহ তায়ালাকে কাতর কণ্ঠে ডাকে, বিপদ চলে গেলে অহংকারী হয়ে যায়, মনের চাহিদা অনুযায়ী পূর্ণ প্রাপ্তি না হলে হতাশ হয়ে, আবার কাক্সিক্ষত কিছু ফেলে অকৃতজ্ঞ হয়, একটু শক্তিমান হলেই দুর্বলের উপর জুলম চালায়, ভালো কাজের খুব দ্রুত পুরস্কার পেতে চায় অথচ মন্দ কাজের পরিণতি বহু পরে দেখলেও আঁতকে উঠে। কেউ কেউ প্রচÐ সংকীর্ণ মনা স্বভাবের, কারো জন্য হাত বাড়াতে চায় না।
পরকালের জবাবদিহিকে অসম্ভব মনে করে অস্বীকার করে, লাগামহীন উটের মতো চলতে চায়, দায়িত্ব পদ-পদবী পেতে যতটা উদগ্রীব থাকে, তা পালনে ততটা সচেতন থাকে না। দায়িত্বের মতো বিশাল আমানত বহন করে খেয়ানত করে নিজেকে জালিম হিসেবে গণ্য করে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত নিয়ামতকে তাঁর দান না মনে করে, নিজের জ্ঞান ও দক্ষতার ফল মনে করে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে। ভালো কিছু পাওয়ার জন্য দোয়া করতে ক্লান্ত হয় না, কিন্ত সামান্য মন্দ পরিস্থিতির শিকার হলেই হতাশ হয়ে যায়। সমজাতীয় মানুষকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে আল্লাহ তায়ালার কর্তৃত্ব ও গুণাবলীর সাথে শিরক করে। অনবরত অপরাধ করতেই থাকে এমনকি ভবিষ্যতেও অপরাধ অব্যাহত রাখতে চায়, এতকিছুর পরও নিজের অপরাধ স্বীকার না করে অজুহাত পেশ করে দায়মুক্তি চায়। সে মনে করে আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষা পাবে, কিন্ত তা মোটেই সম্ভব নয়।
এভাবেই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে মানুষের বাস্তব চিত্র অঙ্কন করেছেন। তিনি সব জানেন, তাঁর কাছে মানুষের হৃদয়ের গভীরে লুকায়িত অপ্রকাশিত মনোভাবও অজানা নয়, কারণ তিনিই স্রষ্টা। তিনি বলেছেন, “যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনিই কি জানবেন না? অথচ তিনি সূ²দর্শী ও সব বিষয় ভালভাবে অবগত।” (সুরা মুলক : ১৪)
অতএব সকল ধরনের মন্দ বৈশিষ্ট্য পরিহার করে, আল্লাহ তায়ালার কাঙ্ক্ষিত চরিত্র অর্জন করে, আশরাফুল মাখলুকাত এর মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখাই হলো মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব।
লেখক: ইসলামী চিন্তাবিদ