আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন আদর্শ পরিবার গঠন
ইসলাম একটি পূর্ণাংগ জীবন ব্যবস্থা। এতে অর্থনীতি-রাজনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ব্যবসানীতি সব কিছুই রয়েছে। ইসলামে পারিবারিক জীবনের যেমনি দিক নির্দেশনা রয়েছে তেমনি রাষ্ট্র পরিচালনার গাইড লাইনও আছে। তবে, ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী সমাজ উপহার দেওয়া সহজেই সম্ভব নয়। এরজন্য নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করতে হবে। কিন্তু মুসলমানেরা ইসলাম অনুসরণ করেই পরিবার পরিচালনা করলে মডেল জীবন উপহার দেওয়া সম্ভব। কিন্তু দুঃখজনক সত্য যে, অনেক মুসলিম পরিবারেও অশান্তি বিরাজমান, অনেক মুসলিম পরিবারও কলহ-বিবাদ লেগে থাকে, মুসলিম পরিবারগুলোতেও ডিভোর্স এর সংখ্যা বাড়ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানোর ক্ষেত্রে শয়তানের কূট কৌশল সফল হচ্ছে। হযরত জাবের থেকে বর্ণিত আছে যে হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন ইবলিশ শয়তান তার আসন পানিতে স্থাপন করে এবং সেখান থেকে তাঁর কর্মীদেরকে প্রেরণ করে মানুষকে পথভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্য। তার ছোট ছোট শয়তানরাও পৃথিবীতে বড়ো বড়ো গোমরাহী সৃষ্টি করে থাকে। অতঃপর তারা যখন মানুষকে গোমরাহ করে ফিরে আসে তখন প্রত্যেকই নিজ নিজ কার্যবিবরণী পেশ করতে থাকে। একজন বলে, আমি আজ অমুক খারাপ কাজ করিয়ে এসেছি। ইবলিশ তখন বলে এটা তোমার তেমন উল্লেখযোগ্য কাজ হয়নি। এরপর অন্যান্য শয়তান তাদের কার্যবিবরণী গর্বের সাথে পেশ করে। অবশেষে এক শয়তান এসে বলে যে আমি আজ এক মহৎ কাজ করে এসেছি- এক ব্যক্তি এবং তার স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে এসেছি। ইবলিস এই বিবরণ শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তাকে কাছে টেনে নেয় এবং বলতে থাকে, তুমি আজ সত্যি একটি বড় কাজ করে এসেছো।
ইসলামে পারিবারিক জীবনের লক্ষ্য শান্তি ও ভালবাসাপুর্ণ মায়ামমতার বন্ধন
ইসলামী পারিবারিক জীবনের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে সাকীনাহ; মুয়াদ্দাহ ও রাহমাহ অর্থাৎ, শান্তি, ভালবাসা ও মায়ামমতার বন্ধন। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, তাঁর নিদর্শনের মধ্যে হল এই যে, তিনি তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের সঙ্গিনি সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তার কাছে শান্তি লাভ করতে পার আর তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। এর মাঝে অবশ্যই বহু নিদর্শন আছে সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা চিন্তা করে। (সুরা রুম: ২১)। মূলত পারিবারিক জীবনে শান্তি না থাকলে সমাজ জীবনে শান্তি আসে না। সাইয়েদ কুতুব তাঁর বিশ্ব শান্তি ও ইসলাম বইতে যথার্থই বলেছেন, “বিশ্ব শান্তির জন্য প্রয়োজন পারিবারিক জীবনে শান্তি।” কিন্তু বর্তমানে পারিবারিক জীবনে অশান্তির দাবানল জ্বলছে। শুধু ইউরোপ কিংবা আমেরিকা নয় বরং মুসলিম দেশগুলোতেও বিবাহ বিচ্ছেদ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছুদিন আগে বিবাহবিডি.কম নামে একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিবাহ বিচ্ছেদের উপর একটি জরিপ করে। তাতে দেখা যায় বিভাগীয় শহরে বিচ্ছেদের হার ৪৯.৩ শতাংশ আর জেলা শহরে ৩৫.৫ শতাংশ। উচ্চশিক্ষিত আর শহরে অবস্থানরতদের বিবাহ বিচ্ছেদেরহ হার বেশি। ২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জে বিবাহ রেজিষ্ট্রি হয়েছে ৮১৮৩ আর বিচ্ছেদ হয়েছে ৩১৪২। সেই হিসাবে প্রতিদিন আটটি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। ২০১৮ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় সৌদি আরবে গড়ে প্রতি ঘণ্টায় সাতজন নারীকে তালাক দেওয়া হয়। সৌদি আরবে বিবাহের ৩৫% তালাক হয়ে যাচ্ছে; যা আশঙ্কাজনক। পারিবারিক অশান্তিসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় দশ হাজার নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করে মারা যায়। কিশোরী মেয়েরা যৌন নিপীড়ন এর শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কারণ মেয়েরা বেশি আবেগপ্রবণ হয়। অনেক সময় তারা আবেগ সংবরণ করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। এক সময় লোক লজ্জার ভয়ে কেউ সহজে ডিভোর্স দিতে চাইতো না। কিন্তু এখন ডিভোর্স অনেকটা মামুলী ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান অনুসারে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি আবেদন করে ।
পারিবারিক জীবনে অশান্তির অনেক কারন রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে; পরকীয়া বা পর নারীর প্রতি আসক্তি, ভুলবুঝাবুঝি, সাংসারিক দায়িত্ব পালনে অনীহা, সঙ্গীকে অবমূল্যায়ন করা, মাদকাসক্তি, পুরুষত্বহীনতা, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, সন্দেহ, শ্বশুরবাড়ির লোকদের দুর্বব্যহার, বদমেজাজ, সন্তানধারণে অক্ষমতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তি,স্বামী-স্ত্রী জীবন যাপনে অমিল, অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা, নারীর পেশাগত উন্নয়নের নেশা, বিদেশে গিয়ে দেশে না ফেরা, দীর্ঘদিন স্বামী-স্ত্রী এক সাথে বসবাস করতে না পারা, যৌতুক, বাল্যবিবাহ, ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী না চলা, স্বামীর অবাধ্যতা ইত্যাদি। আবার কেউ কেউ ঘরের বাহিরে সময় দেন প্রচুর কিন্তু নিজ পরিবারে সময় দিতে পারেন না। তাই মাওলানা মওদুদী তাঁর হেদায়েত বইতে চমৎকারভাবে উল্লেখ করেছেন নিজের ঘর সামলান; কারণ অনেকই আছেন অপরের ঘর নিয়ে ব্যস্ত কিন্তু নিজের ঘরের খবর নেই। নোমান আলী খানের মতে দারিদ্রতা, অর্থনৈতিক সমস্যা উম্মাহর মূল সমস্যা নয়- মূল সমস্যা হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
মডেল পরিবার এর জন্য আল্লাহর রাসুলই সর্বোত্তম উসওয়া
আদর্শ পারিবারিক জীবনই সমাজ ও সভ্যতা বিনির্মাণের মূল ভিত্তি। পারিবারিক জীবনে অশান্তি থাকলে অঢেল সম্পদ থাকলেও মনে শান্তি আসে না; রাতে ঘুম হয়না। দুঃখ-যাতনা নিয়েই দিনাতিপাত করতে হয়। আর পারিবারিক জীবনে শান্তি পেতে হলে আমাদেরকে আল্লাহর রাসুলের আদর্শ অনুসরণ করতে হবে।
আল্লাহর রাসুল (সা.) ছিলেন স্বামী হিসাবে রোল মডেল। তাই হযরত সাফিয়্যা গর্ব করে বলতেন আমি আল্লাহর রাসুলের চেয়ে উত্তম আচরণের কোন মানুষ দেখি নাই। হযরত আয়েশা আল্লাহর রাসুলকে লক্ষ্য করে বলেন, কেন আমার মত একজন নারী আপনাকে নিয়ে সন্মানবোধ করবে না। আল্লাহর রাসুলের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই হযরত উমর বলতেন, একজন স্বামী উচিত তার স্ত্রীর সাথে শিশুর মত খেলা করা। এই কারণেই জনৈক ব্যক্তি তার স্ত্রীর ব্যবহার সম্পর্কে উমর (রা.) এর কাছে অভিযোগ দিতে এসে যখন উমরের স্ত্রীর ব্যবহার দেখেন তখন তিনি চলে যান। উমর (রা.) তার চলে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি জবাব দেন আমি যেই জন্য এসেছি আমি দেখতে পেলাম আপনার অবস্থা আমার চেয়েও খারাপ। আমরা অনেক সময় আদর্শ পরিবার গঠন করার কথা বলি। কিন্তু ভুলে যাই আদর্শ পরিবার গঠন করতে হলে আমাদের পুরুষদেরকে আদর্শ স্বামী হতে হবে। আর নারীদেরকে হতে হবে আদর্শ স্ত্রী। তাহলেই আদর্শ পরিবার গঠন সম্ভব। আর সেই যুগলই হবে পরস্পরের জন্য চক্ষুশীতলকারী।
স্ত্রীদেরকে আল্লাহর রাসুল কখনও প্রহার করেননি বা তাদের অন্যায়ের কারণে কটু কথা বলেননি। একবার রাসুলে কারিম (সা.) হযরত আয়েশার ঘরে থাকার সময় হযরত সাফিয়্যা খাবার পাঠান। আয়েশা ঈর্ষাকাতর হয়ে খাবারসহ প্লেটটি ভেঙ্গে ফেলেন। রাসুলে কারিম (সা.) রাগ করলেন না। নিজ হাতে ভাঙ্গা পাত্রের টুকরা কুড়াতে কুড়াতে ভৃত্যকে বললেন তোমাদের মায়ের ঈর্ষা এসে গেছে। তাঁর স্ত্রীরা রাগ করে তাঁর সাথে কখনও অভিমানে সারাদিন কথা বলতেন না। আবার একবার সকলে ভরণ পোষনের চাহিদা ব্যক্ত করেন। এতে আল্লাহর রাসুল অসন্তুষ্ট হয়ে একমাস কারো কাছে যাননি। অবশ্য এক পর্যায়ে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারেন। রাসুলে কারিম (সা.) কোন স্ত্রীর প্রতি অসন্তুষ্ট হলে তার সাথে কথা একটু কমিয়ে দিতেন। হাঁসি-কৌতুক কমিয়ে দিতেন। এতে তাঁরা তাদের ভুল বুঝতে পারতো এবং ক্ষমা চেয়ে নিতো। একবার রাসুলে কারিম তাঁর এক স্ত্রীর ঘরে মধু পান করার পর আয়েশাসহ অন্যরা একজোট হয়ে বলা শুরু করল আপনার মুখে মাগাফিরের দুর্গন্ধ। এতে আল্লাহর রাসুল মধু আর পান না করার অঙ্গীকার করেন। অবশ্য আল্লাহ তায়ালা তারপর অহী নাযিল করে জানিয়ে দেন আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা নিজের উপর আপনি হারাম করতে পারেন না।
আল্লাহর রাসুলের জীবন থেকে তাঁর পারিবারিক জীবনের কয়েকটি চিত্র:
১.পরস্পরের জন্য দুআ করা ও সালাম দেওয়া: রাসুল (সা.) বাহির থেকে ঘরে আসলে প্রথমেই সালাম করতেন। হযরত আয়েশা বলেন আমি আল্লাহর রাসুলকে কখনও আগে সালাম দিতে পারিনি। একবার আমি আল্লাহর রাসুল আসার আগে দরজার ভিতর লুকিয়ে ছিলাম তাঁকে আগে সালাম দিতে। কিন্তু তিনি ঘরের দরজা খোলার আগেই সালাম দেন।
রাসুলে কারিম (সা.) বাহির হতে ঘরে ঢুকার আগে দুআ পড়তেন। কেননা দুআ না পড়লে অনেক সময় শয়তান সাথে সাথে ঘরে ঢুকে। একজন ব্যক্তি মাসনূন দুআ পড়ে সব কাজ করলে শয়তান সেক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। একটি হাদিসে বর্ণিত আছে যে, দুআ পড়ে ঘরে প্রবেশ করলে শয়তান তার সঙ্গী সাথীদেরকে ডেকে বলে এই ঘরে আজ তোমাদের থাকার জায়গা নেই এবং আহার নেই। আর দুআ না পড়ে ঘরে ঢুকলে শয়তান তার সঙ্গী সাথীদের ডেকে বলে তোমরা আস এই ঘরে তোমাদের থাকার জায়গা এবং খাবার রয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যেন চক্ষুশীতলকারী হয় এই জন্য সব সময় আল্লাহর কাছে দুআ করতেন। কুরআনে আল্লাহ তায়ালা সেই দুআ শিখিয়ে দিয়েছেন।
২.একে অপরের সর্বোত্তম বন্ধু ও সাহায্যকারী হওয়া: আল্লাহর রাসুল (সা.) ছিলেন তাঁর স্ত্রীদের সর্বোত্তম বন্ধু। হযরত খাদিজা (রা.) এর সাথে আল্লাহর রাসুল (সা.) বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করতেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) এর উপর যখন প্রথম অহী নাযিল হয় আল্লাহর রাসুল (সা.) ভীত সন্ত্রস্ত ছিলেন। হযরত খাদিজা (রা.) তাঁকে সাহস যোগান। যখন অন্যরা তাঁর রিসালাতে বিশ্বাস করেনি; খাদিজা (রা.) প্রথমেই দ্বিধাহীন চিত্তে ঈমান আনেন। ওয়ারাকা ইবন নওফেল এর কাছে নিয়ে যান। শিয়াবে আবু তালিবে যখন বন্দী ছিলেন; নানা ধরনের জুলম নির্যাতনের শিকার হন হযরত খাদিজা (রা.) তাঁর সকল সহায় সম্পদ ও ভালবাসা উজাড় করে আল্লাহর রাসুলের পাশে ছিলেন।
৩.সময় দান ও শারীরিক হক আদায়: রাসুলে কারিম (সা.) তাঁর স্ত্রীদের প্রতি সময় দিতেন এবং তাদের কথা ধৈর্য্যের সাথে শুনতেন। উম্মাহাতুল মুমীনীন সকলের জন্য পালাক্রমে সময় নির্দিষ্ট ছিল। সফরে যেতেও লটারীর মাধ্যমে একজন স্ত্রী সাথে নিতেন। তিনি তাঁর স্ত্রীদের কথা ধৈর্য্যের সাথে শুনতেন। একবার হযরত আয়েশা এক বিশাল গল্প বলা শুরু করেন। রাসুলে কারিম (সা.) ধৈর্যের সাথে পুরো গল্প শুনেন এবং আয়েশাকে খুশি করার জন্য তার উপর মন্তব্যও করেন। একজন স্ত্রী সাধারনত চায় তার স্বামীর পক্ষ থেকে প্রচণ্ড ভালবাসা ও তার প্রতি মনোযোগ। তারকথা মনোযোগ দিয়ে শোনলে খুশি হয়। স্ত্রী সাধারণত স্বামীর কাছে সময় চায়। আর এই সময় ঘড়ির কাঁটা হিসাব করে দিলে হবে না। তার মন-মানসিকতা লক্ষ্য করেই সময় দিতে হবে।
আল্লাহর রাসুল রাতের বেলা স্ত্রীদেরকে নিয়ে ঘুরতে বের হতেন। হালকা গল্প করতেন। স্ত্রীর সাথে দৌঁড় প্রতিযোগিতা করতেন। একবার তিনি পরাজিত হতেন আবার জিতে গিয়ে তার প্রতিশোধ নিতেন।
আল্লাহর রাসুল স্ত্রীদের সাথে শারীরিক হক আদায় করার ক্ষেত্রে মূল্যবান অনেক উপদেশ দিয়েছেন। যা ভালবাসাপূর্ণ পারিবারিক জীবনের জন্য অপরিহার্য। তিনি সাধারণত: তাহাজ্জুদ নামাযের জন্য উঠার পর ফজর নামাযের আগে এই হক আদায় করতেন এবং মাঝে মধ্যে এক সাথে গোসল করতেন।
৪.পারিবারিক কাজে সহযোগিতা: রাসুল (সা.) মাঝে মধ্যে ঘরের কাজে তথা রান্না-বান্নার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতেন। রাসুলে কারিম (সা.) মাঝে মধ্যে নিজে ছাগল যবেহ করে নিজেই রান্না করতেন এবং সকলকে দাওয়াত দিতেন। মহানবীর রান্না ছিল অত্যন্ত সুস্বাদু। তিনি ছাগলের দুধ ধৌত করতেন।
৫.হালাল বিনোদন: একবার হাবশিরা যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে খেলছিল। রাসুলে কারিম (সা.) হযরত আয়েশাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। তারপর রাসুলে কারিম (সা.) আয়েশাকে খেলা দেখতে নিয়ে যান। হযরত আয়েশা আল্লাহর রাসুল (সা.) এর কাঁধ ও কানের মধ্যে থুতলী রেখে তার পিছনে দাঁড়িয়ে খেলা দেখেন। আল্লাহর রাসুলের ওফাতের পর আয়েশা (রা.) বলেন, তাঁর উদ্দেশ্য খেলা দেখা ছিল না; মূলত তিনি আল্লাহর রাসুলের সংস্পর্শে থাকার জন্যই খেলা দেখার জন্য বের হতেন।
৬.স্ত্রীগণের সাথে আচার ব্যবহার ও তাঁদের অধিকারের বিষয়ে সমতা বজায় রাখা: যখন তিনি কোন সফর কিংবা যুদ্ধাভিযানে বের হতেন, তখন দু-একজন স্ত্রীকে সফর সঙ্গী করতেন। তিনি স্ত্রীগণের মাঝে লটারীর ব্যবস্থা করতেন। লটারীতে যার নাম আসত তাঁকেই নিজের সফর সঙ্গী করতেন। এ ব্যাপারে রাসুলল্লাহ (সা.) বলতেন “হে আল্লাহ! এ হলো আমার অধিকারভুক্ত বিষয়ে আমার কাজ (বণ্টন)। তাই যা আপনার মালিকানাধীন এবং যার মালিক (ভালোবাসা) আমি নই- এমন বিষয়ে আপনি আমাকে ভৎসনা করবেন না।
৭. আর্থিক অসচ্ছলতার মাঝেও দান সদকা: দুনিয়ার চাকচিক্য, ভোগ-বিলাস কখনো আল্লাহর নবীকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি নিজে যেমন সাধারণ জীবন-যাপন করতেন, তেমনি চাইতেন তাঁর পূত:পবিত্র স্ত্রীগণ তাঁর মতো সাধারণ জীবন-যাপন করেন। একদিন হযরত উম্মু সালামা একটি হার পরিধান করেন। হারটিতে স্বর্ণের কিছু মুতিদানা ছিল। নবীজি হারটি পরা পছন্দ করলেন না। এর প্রতি বিমুখতা প্রদর্শন করলেন। রাসুলল্লাহ (সা.)-এর এ অবস্থা দেখে উম্মু সালামা গলা থেকে হারটি খুলে ফেলেন।
রাসুলল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রীদের অনেকে ছিলেন আরবের বিভিন্ন গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের কন্যা সন্তান। রাসুল (সা.)-এর সাথে বিয়ের আগে তাঁরা নিজেদের পিতা এবং পূর্ব স্বামীর ঘরে অত্যন্ত স্বচ্ছলভাবে জীবনযাপন করতেন। মাদানি জীবনের শুরু থেকে দীর্ঘ ছয় বছর তাঁরা নবী সংসারে অভাব অনটন ও মিতব্যয়িতার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দেন। সপ্তম হিজরীতে খাইবার বিজয়ের পর নবীগৃহে পূর্বের চেয়ে কিছুটা আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে আসে। মাঝেমধ্যে রাসুলল্লাহ (সা.) স্ত্রীদের জন্য বাৎসরিক বরাদ্দকৃত খাদ্য-খাবার থেকে অভাবীদেরকে দান করতেন। নবীপত্মীগণও রাসুলল্লাহ (সা.)-এর সান্নিধ্যে এসে তাঁর রং-এ রঙিন হন। তাঁরাও অন্যদের অভাব অনটনকে নিজের উপর প্রাধান্য দিতেন। অসহায় অভাবী ও দরিদ্র লোকদেরকে দরাজ হস্তে দান করতেন। এসব কারণে তাঁদের জন্য বাৎসরিক বরাদ্দকৃত খেজুর ও যব বছর পূর্তির পূর্বেই ফুরিয়ে যেত।
নবুওয়াত লাভের পর মক্কী এবং পরবর্তীকালে মাদানী জীবনের প্রথম দিকে রাসুলল্লাহ (সা.)-এর আয়ের কোন উৎস ছিল না। যাকাত-ফিতরা খাওয়া নবী ও তাঁর পরিবার-পরিজনের জন্য ছিল হারাম। তাই দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য আনসারগণ কিছু খেজুরগাছ তোহফা হিসেবে নবী করীম (সা)-এর জন্য নির্দিষ্ট করে দেন। এছাড়া আনসারগণ বিভিন্ন সময়ে হাদিয়া হিসেবে যা কিছু পাঠাতেন তাই ছিল রাসুলল্লাহ (সা.) ও তাঁর পরিবারের খাদ্য-খাবার। আবার মাঝে মধ্যে রাসুলল্লাহ (সা.) অন্যের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতেন। হযরত আয়িশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.)-এর মদীনায় আগমনের পর তাঁর পরিবার-পরিজন একাধারে তিনদিন গমের রুটি পরিতৃপ্ত হয়ে খাননি। আর এ অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর পরিবার দৈনিক দুবেলা খাবারের একবেলা খেজুর খেয়েই কাটিয়ে দিতেন। হযরত আয়িশা (রা.) থেকে আরও বর্ণিত; তিনি উরওয়াকে বললেন, হে আমার বোনের ছেলে! আমরা দুমাসে তিনটি চাঁদ দেখতাম এবং আল্লাহর নবীর ঘরে আগুন জ্বলত না। উরওয়া বললেন, কিভাবে আপনারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনি বললেন, দুটি কালো জিনিস- খেজুর ও পানি দ্বারা। তবে রাসুলল্লাহ (সা.)-এর কিছু আনসারী প্রতিবেশী ছিল, যাদের ছিল দুগ্ধবতী উটনী ও বকরী। তারা নবীজিকে সেগুলোর দুধ দিত। আমরা তাই পান করতাম।
হিজরী ১ম বর্ষে সালমান ফারসী (রা.) ইসলামগ্রহণ করেন। তিনি বলেন, দাস থাকা অবস্থায় একদিন আমি রাসুলল্লাহ (সা.)-এর নিকট এসে বলি, হে আল্লাহর রাসুল! এগুলো সদকার মাল। রাসুল (সা.) তাঁর সাহাবীদেরকে খাওয়ার আদেশ করলেন, তাঁরা খেলেন কিন্তু তিনি খেলেন না। তারপর আরেকদিন আমি তাঁর নিকট কিছু খাবার নিয়ে এসে বলি, এ মালগুলো হাদিয়া। হাদিয়া হিসেবে আমি আপনাকে এগুলো দিয়েছি। এগুলো দিয়ে আপনাকে সম্মান করছি। আমিতো দেখলাম, আপনি সদকার মাল খান না। এবার রাসুলল্লাহ (সা.) তাঁর সাহাবীগণকে খাবার গ্রহণের নির্দেশ দিলেন এবং নিজেও তাঁদের সাথে খাবার খেলেন। (মুসনাদ)।
নবী পরিবারের মাঝে প্রাচুর্য ও আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। কিন্তু সেখানে ছিল পরম সুখ শান্তি ও স্বর্গীয় আবহের এক মনোরম পরিবেশ। হযরত উম্মু সালামা শৈশবকাল থেকে পিত্রালয় অতঃপর পূর্ব স্বামীর সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতার মাঝে জীবন অতিবাহিত করেন। আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর তিনি আস্তে আস্তে এ পরিবেশে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। স্বামী রাসুলল্লাহ (সা.)-এর সন্তুষ্টি কামনায় নিজ ভৃত্য সাফীনাকে এ শর্তে মুক্ত করে দেন যে রাসুলল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকাল পর্যন্ত সে তাঁর খেদমতে নিয়োজিত থাকবে।
উম্মুল মুমিনীনগণ খায়বার যুদ্ধের পর নিজেদের আর্থিক অবস্থা ও জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধির সুযোগ মনে করেন। তাই তাঁরা সকলে একজোট হয়ে রাসুল (সা)-এর কাছে নিজেদের ইচ্ছার কথাটি ব্যক্ত করেন। কিস্তু স্ত্রীদের দাবি দাওয়ার বিষয়টি রাসুলল্লাহ (সা.)-এর মনোপুত হয়নি। এ প্রসঙ্গে জাবির ইব্ন আবদিলল্লাহ্ (রা.) বলেন, একবার আবুবকর (রা.) নবী কারিম (সা.)-এর কাছে এসে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। তখন লোকজন তাঁর দরজায় উপবিষ্ট ছিল। নবীজি তাঁকে অনুমতি দিলেন না। কিছুক্ষণ পর উমার (রা.) এসে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। কিন্তু তাঁকেও অনুমতি দেওয়া হলো না। অতপর নবীজি আবু বকর ও উমার (রা.) দুজনকেই অনুমতি দিলেন। তাঁরা ভিতরে প্রবেশ করে দেখেন যে তাঁর স্ত্রীগণ তাঁর চারদিকে বসে আছেন এবং তিনি কোন কথা বলছেন না। উমার (রা.) বললেন, অবশ্যই আমি নবীজিকে কথা বলে হাসাব। উমার (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! যদি আপনি যায়িদের বেটি উমারের স্ত্রীকে দেখতেন। সে কিছুক্ষণ আগে আমার কাছে টাকা চেয়েছিল। আমি তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছি। উমার (রা.)-এর কথা শুনে রাসুল (সা.) এমনভাবে হাসলেন যে, তাঁর মাড়ির দাঁত দেখা গেল। নবীজি উমার (রা.) কে লক্ষ্য করে বললেন, তুমি দেখতে পাচ্ছ, এঁরা আমার কাছে খরচপত্রের জন্য টাকা চাচ্ছে। এ কথা শুনে আবুবকর (রা.) উঠে গিয়ে মেয়ে আয়িশা (রা.) কে মারতে গেলেন এবং উমার (রা.) উঠে গেলেন মেয়ে হাফসার দিকে। তাঁরা উভয়ে বললেন যে, তোমরা রাসুল (সা.)-এর কাছে এমন জিনিস চাচ্ছো যা তিনি দিতে পারছেন না।
উম্মুল মুমীনীনগণ প্রত্যেকেই রাসুলুল্লাহ (সা.) কে অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করেছেন। মন-প্রাণ উজাড় করে তাঁর মধুর ভালবাসায় নিজেদেরকে ধন্য করেছেন। দীনের কোন বিষয়ে তাঁরা আল্লাহর নবীর কোন আদেশ-নির্দেশ কিংবা নিষেধমূলক কোন কাজ লঙ্ঘন করেননি। তবে আমাদের এ কথা জানা উচিত যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) যেমন একজন রাসুল ছিলেন, তেমনি ছিলেন একজন স্বামী। নবীপত্মীগণ যেমন ছিলেন উম্মুল মুমিনীন, তেমনি ছিলেন নারী। তাই নারীদের স্বভাবজাত গুণ-এক সখীর প্রতি আরেক সখীর আত্মমর্যাদা ও ঈর্ষার বিষয়টি তাদের মাঝে লক্ষণীয় ছিল। স্বামী রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক নির্ধারিত অংশটুকু তারা কখনও অন্যকে দিতে চাইতেন না। প্রত্যেকেই ইচ্ছা করতেন স্বামীর সান্নিধ্যে তার অংশটুকু পূর্ণভাবে কাটাতে। তাঁরা যখন স্ব-স্ব দৃষ্টিতে তাদের পালানুক্রমিক অংশটুকু না পাওয়ার অভাব অনুভব করতেন, যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের একজনের সামনে অপরজনের প্রশংসামাখা কথা বলতেন, তখন বিষয়টি তাদের আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত হানত এবং ঈর্ষার উদ্রেক হতো। কিন্তু পরক্ষণে যখন তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারতেন তখন স্বামী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট অনুতপ্ত হয়ে নিজেদের ভুলের কথা অকপটে স্বীকার করতেন। তারপর এ বিষয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করতেন। এরূপ করার ক্ষেত্রে তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল স্বামীর ভালোবাসা লাভে নিজেরদেরকে ধন্য করা।
রাসুলুল্লাহ (সা.) পালাক্রমে প্রত্যেক স্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করতেন, তাদের সান্নিধ্যে যেতেন। তাঁদের সাথে হাসি-কৌতুক করতেন। নিজের সাধ্যমত স্ত্রীদের অধিকারের বিষয়ে সদা-জাগ্রত থাকতেন। কিন্তু স্ত্রীদের পক্ষ থেকে নিজের উপর সাধ্যাতীত কোন প্রস্তাবকে তিনি মেনে নিতেন না। এরূপ ক্ষেত্রে নবীজির অবস্থা দেখে উম্মুল মুমিনীনগণ বুঝতে পারতেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের উপর রাগান্বিত হয়েছেন। আস্তে আস্তে তাঁরাও স্বামীর উপর চাপিয়ে দেওয়া নিজেদের দাবী-দাওয়া উঠিয়ে নিতেন।
৮.স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মধুর সম্পর্ক সৃষ্টির জন্য এক সাথে খাবার: আমাদেরকে সম্ভব হলে অন্তত দিনের যে কোন এক বেলা এক সাথে খাবারের সময় বের করা ভাল। আল্লাহর রাসুল এক সাথে খাবার গ্রহণ করতেন। এক সাথে খাবারের সময় রাসুলে কারীম (সা) মাঝে মধ্যে স্ত্রীর মুখে খাবার তুলে দিতেন। রাসুল (সা.) বলেন, স্ত্রীর মুখে খাবার তুলে দেয়া সাদকার সওয়াব। রাসুল (সা) একই সাথে পনানাহার করতেন। হাদিসে উল্লেখ আছে যে , কখনও কখনও আল্লাহর রাসুল গ্লাসের সেই পাশ দিয়ে পানি পান করতেন যে পাশে হযরত আয়েশা পানি পান করেছেন। হযরত আয়েশা হাড্ডির যে পাশে কামড় দিতেন রাসুলে কারিম (সা.) ঠিক সেই পাশেই কামড় দিয়ে খেতেন। ওফাতের আগে আল্লাহর রাসুল হযরত আয়েশার ব্যবহার করা মেসওয়াক ব্যবহার করেন। যার ফলে দুইজনের মুখের লালা এক হয়ে যায়। আর আয়েশার কোলে মাথা রেখে তিনি মহান রব তাঁর প্রিয় বন্ধুর কাছে চলে যান।
৯.আদর করে বিভিন্ন নামে ডাকা: রাসুলে কারিম (সা.) হযরত আয়েশাকে আদর করে আয়েশা বা হুমাইরা ডাকতেন। তাই যারা স্ত্রীকে আদর করে ময়না পাখি, শান্তি, জান ইত্যাদি নামে ডাকেন তারা রাসুল কারিম (সা.) এর সুন্নাহ অনুসরণ করার কারণে সাওয়াব পাবেন। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি ব্যবহৃত শব্দের কারণে একে অপরের কাছে আসে আবার ব্যবহৃত কথার কারণেই দূরত্ব সৃষ্টি হয়। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের জন্য ব্যবহৃত শব্দ যত মধুর হবে সম্পর্ক ততই মধুর থাকবে। স্ত্রীকে বুঝতে দিতে হবে যে , আপনি তাকে ভালবাসেন। আর মাঝে মধ্যে তা বলতে হবে যদিও মনে হবে তা বারবার বলাতে কি ফায়দা। কিন্তু আমি তোমাকে ভালবাসি তা বলার মাঝে ম্যাজিক রয়েছে। একদিন হযরত আয়েশ (রা.) রাসুলে কারিম (সা.) এর কাছে জানতে চান আপনি আমাকে কি রূপ ভালবাসেন? রাসুলে কারিম (সা.) জবাব দেন, ‘তোমার প্রতি আমার ভালবাসা এমন শক্তিশালী বন্ধনের মত যা খুলবে না।’ কিন্তু তারপর একদিন দুজনের মধ্যে একটু বিতর্ক হয়। তখন আয়েশা (রা.) জানতে চান আপনার বন্ধন এখন কেমন। তখন আল্লাহর রাসুল হেঁসে জবাব দেন আগের মতই শক্তিশালী।
১০. প্রশংসা করা ও মিষ্টি হাসিতে বরণ: স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে মিষ্টি হাসি দিয়ে বরণ করা বা বিদায় দেওয়া। আল্লাহর রাসুল (সা.) মিষ্টি হাসিতে কথা বলতেন। বিভিন্ন কাজের জন্য উম্মাহাতুল মুমীনদের প্রশংসা করতেন। তিনি উম্মাহাতুল মুমীনদের রান্নার প্রশংসা করতেন। তাই স্ত্রীর কাজের সমালোচনা নয় প্রশংসা করুন। সমালোচনা করে কারো হৃদয় জয় করা যায় না। ভালোবাসা ও প্রশংসা করেই স্ত্রীর মন জয় করতে হয়। আল্লাহর রাসুল (সা) কখনও রান্নার সমালোচনা করেননি। পক্ষান্তরে, যখন একজন স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে প্রশংসা ও সম্মান পান, মানসিকভাবে তিনি অনেকটা সতেজ হয়ে ওঠেন। স্বামীর জন্য কোনো কিছু করতেই তিনি আর দ্বিধা করেন না।
১১. স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে সমঝোতা: স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যখন বোঝাপড়া ভাল হয় তখন সম্পর্ক মধুর হয়। আল্লাহর রাসুল পারস্পরিক বোঝা পড়ার ক্ষেত্রে মডেল ছিলেন। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তর্ক-বিতর্ক হলে নিজেরা সমাধান করা। প্রয়োজনে অভিভাবকদের সহযোগিতা নেওয়া। একবার রাসুলে কারিম (সা.) এর সাথে মা আয়েশার তর্ক হয়। আল্লাহর রাসুল (সা.) তখন বলেন হে আয়েশা তাহলে এই বিষয়ে মীমাংসা করার জন্য তোমার পিতা আবু বকরকে ডাকি। আয়েশা সন্মতি দিলে আবু বকরকে সংবাদ দেওয়া হয়। তিনি আসার পর রাসুলে কারিম (সা.) আয়েশাকে বলেন আয়েশা আমাদের মাঝে কি হয়েছে তা কি তুমি বলবে না আমি বলব। আয়েশা বললেন আপনি বলেন, তবে যা ঘটেছে তা হুবহু বলবেন; সঠিক কথা বলবেন। আবু বকর আয়েশার কথার টোন শুনে রেগে গিয়ে বলেন হে আয়েশা তুমি আল্লাহর নবীকে হক কথা বলার কথা বলছ। তোমাকে এই সাহস দিল কে? আল্লাহর রাসুল (সা.) কি কখনও না হক কথা বলবেন? এই জন্য তিনি আয়েশাকে ধমক দেন । তিনি আবার মারতে উদ্যত হলে আল্লাহর রাসুল আবু বকর ও আয়েশার মাঝখানে দাঁড়ান। তারপর আবু বকর চলে যান। আবু বকর চলে যাওয়ার পর আল্লাহর রাসুল বলেন আয়েশা আমি তো তোমাকে তোমার পিতার মার খাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিলাম। এই কথা বলে দুই জনেই হাঁসেন। আবু বকর তখনও ঘরের বাইরে। তিনি উভয়ের মাঝে চমৎকার কথা-বার্তা শুনে আবার ঘরে আসলেন এবং বললেন ইয়া রাসুলাল্লাহ। আপনারা যেমনিভাবে আপনাদের ঝগড়ার সময় আমাকে ডাকেন অনুরুপভাবে আপনাদের মাঝে শান্তি ও মায়াবী পরিবেশের সময়ও ডাকবেন।
আল্লাহ তায়ালা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পরিবার থেকে সালিশ সাব্যস্ত করার কথা বলেছেন। কেননা শুরুতেই বিষয়টি পরিবারের বাইরে নিয়ে গেলে তিক্ততা সৃষ্টি হতে পারে।
১২. একে অপরকে কখনও চিন্তিত দেখলে সঙ্গ দেওয়া এবং কি কারণে চিন্তিত তার কারণ জানার চেষ্টা করা: একবার রাসুলে কারিম (সা.) স্ত্রীদের নিয়ে সফরে বের হন। পথিমধ্যে হযরত সাফিয়্যার উটটি অসুস্থ হয়ে বসে পড়ল তখন হযরত সাফিয়্যা কেঁদে দিলেন। রাসুলে কারিম (সা.) এসে নিজ মায়াবী হাতে সাফিয়্যার চোখের পানি মুছে দিলেন। বিদায় হজের সময় তিনি লক্ষ্য করলেন হযরত আয়েশা কাঁদছেন। তিনি তাঁর কাছে আসার পর বুঝতে পারলেন তার মাসিক ঋতু্স্রাব শুরু হয়েছে। রাসুলে কারিম (সা.) আয়েশাকে সান্তনা দিয়ে বললেন সকল নারীদের জন্যই আল্লাহ এটা নির্ধারিত করে দিয়েছেন। হজে যা করা প্রয়োজন তুমি তার সবই কর শুধু তাওয়াফটা করো না। আয়েশার মাসিকের সময়ও রাসুলে কারিম (সা.) তাঁর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকতেন আর আয়েশা তাঁর মাথা আঁচড়িয়ে দিতেন। একবার রাসুলে কারিম (সা.) হযরত মায়মুনার সাথে শুয়ে ছিলেন। এমতাবস্থায় হঠাৎ মায়মুনা (রা.) এর মাসিক শুরু হলে তিনি দ্রুত উঠে সরে যান যাতে আল্লাহর রাসুলের দেহে রক্তের দাগ না লাগে। রাসুলে কারিম (সা.) তখন হযরত মায়মুনাকে আবার কাছে ডেকে আনেন এবং একই চাদরের নীচে শুয়ে থাকেন। অথচ ভারতে এখনও কিছু এলাকায় ঋতুস্রাবের সময় নারীকে শীতের মাঝেও গোয়াল ঘরে থাকতে হয়। রান্না ঘরে ঢোকার অনুমতি নেই। স্বামী-সন্তানদের থেকে আলাদা থাকতে হয়। স্ত্রীরা অসুস্থ হলে রাসুলে কারিম (সা.) নিজেই রুকিয়্যা করতেন। তাঁদের সেবা করতেন।
১৩.স্ত্রীর আত্মসন্মানবোধের প্রতি খেয়াল রাখা: বিদায় হজে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন , ‘‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সদয় হও। তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে পাঁজরের বাকা হাঁড় দিয়ে। একেবারে সোজা করতে চাইলে ভেংগে যাবে।” মক্কার কোরাইশ নারীরা ছিল স্বামীর প্রতি অধিক অনুগত। আর মদীনার আনসার নারীরা ছিল একটু বিপ্লবী স্বভাবের। হিজরাতের পর কুরাইশ নারীরা আনসার নারীদের সাথে মেলামেশা করার কারণে তাদের মাঝেও আত্মসন্মানবোধ বেশি জাগ্রত হয়। এমতাবস্থায় আল্লাহর রাসুল (সা.) সাহাবাদেরকে আনসার পুরুষদের মত ব্যবহার করতে বলেন।
১৪.আল্লাহর রাসুল তাঁর স্ত্রীদেরকে হাতে কলমে ইবাদত বন্দেগী শেখাতেন। রমযানের শেষ দশকে সকলকে শেষ রাতে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতেন। সকলকে আল্লাহর ইবাদত করতে বলতেন। ছোট ছোট গুনাহের ব্যাপারে সাবধান করে দিতেন। আবার স্ত্রীরা যেন ইবাদত বন্দেগীকে উগ্রপন্থায় চলে না যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতেন। কারণ হযরত উম্মে সালমা মসজিদে নববীতে নিজেকে বেঁধে রাখতেন যেন রাতের বেলায় ইবাদতে ঘুম না আসে। তিনি তা করতে নিষেধ করেন।
১৫.পরামর্শ গ্রহণ: সমাজ জীবনে দেখা যায় কেউ নারীকে অপূর্ণ বিবেকবান বলে তার পরামর্শ-যুক্তি একেবারেই অগ্রাহ্য করে যায়। কেউ আবার নিজ স্ত্রীকে মাত্রাতিরিক্ত মর্যাদার আসনে স্থান দেয়। তার সকল যুক্তি পরামর্শ কোন প্রকার বাদ-বিচার না করে স্ত্রীর মনোরঞ্জনে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করে। ফলে সে মনের দিক থেকে স্ত্রীর গোলামে পরিণত হয়। কিন্ত আমরা যদি আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর দাম্পত্য জীবনের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাব যে তিনি তার স্ত্রীদের কাছ থেকে নানা বিষয়ে পরামর্শ নিতেন এবং তা যথার্থ হলে গ্রহণ করতেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় হযরত উম্মু সালামা (রা.) ছিলেন রাসুল (সা.)-এর সফরসঙ্গিনী। বাহ্যত হুদায়বিয়ার সন্ধি মুসলমানদের স্বার্থ বিরোধী হওয়ায় মুসলমানদের মাঝে বিষণতার এক কালো মেঘ নেমে আসে। আল¬াহর নবী তাদেরকে সে স্থানে কুরবানী করে হালাল হয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন। তিন-তিন বার তিনি তাঁদেরকে এ ব্যাপারে নির্দেশ দেন। কিন্তু সাহাবায়ে কিরামের মাঝে নির্র্দেশ পালনে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। সন্ধির বাহ্যত ফলাফলে তাদেরকে এক প্রকারের নির্বাক অবস্থায় পেয়ে বসে। এ অবস্থায় আল্ল-াহর নবী হযরত উম্মু সালামার কাছে আসেন এবং সাহাবায়ে কিরামের অবস্থা খুলে বলে উম্মু সালামার কাছে পরামর্শ চান। উম্মে সালমা বললেন ইয়া রাসুলাল্লাহ আপনি আপনার কুরবানী করে নেন। দেখবেন তখন বাকীরাও আপনার অনুসরণ করবে। বাস্তবে তাই হলো। উম্মু সালামার পরামর্শ অনুযায়ী রাসূল (সা) উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে সক্ষম হন।
পারিবারিক জীবনে পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। আল্লাহ তায়ালা আল-কুরআনে সন্তানের দুধ পানের সর্বোাচ্চ সময়সীমা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তার আগে কখন তা বন্ধ করবে তা স্বামী-স্ত্রী পরামর্শক্রমে নির্ধারণ করার নির্দেশনা দিয়েছেন।
১৬.আল্লাহর রাসুল স্ত্রীদেরকে অযথা নিজের কাজ দিতেন না। নিজের কাপড় নিজে ধুতেন। নিজেই সিলাই করতেন। নিজের জুতা নিজ হাতেই ঠিক করতেন। নিজে ছাগলের দূধ ধুতেন।
১৭. তাঁর স্ত্রীরা কখন খুশি আর কখন অসন্তুষ্ট তা বুঝতেন। একবার তিনি হযরত আয়েশাকে বলেন আয়েশা তুমি কখন আমার উপর সন্তুষ্ট আর কখন অসন্তুষ্ট তা আমি জানি। আয়েশা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন কিভাবে আপনি তা বুঝেন। রাসুলে কারিম (সা.) বললেন তুমি যখন আমার উপর সন্তুষ্ট তখন আল্লাহর কাছে দুআ কর এই বলে মুহাম্মদের রবের কসম। আর যখন আমার উপর অসন্তষ্ট হও তখন বল ইবরাহীমের রবের কসম। আয়েশা বললেন আমি সেই সময় মুখে আপনার নাম মুখে উচ্চারণ না করলেও হৃদয়ে সব সময় আপনি থাকেন।
১৮. স্ত্রীদের মনে কোন বাসনা লুকিয়ে থাকলে তা পূরণের চেষ্টা করতেন। হযরত আয়েশা (রা.) মা হতে পারেননি। তাই তাঁর ছোট বোন আসমার ছেলে হলে তার নাম রাখেন আব্দুল্লাহ। সেই থেকে আল্লাহর রাসুল (সা.) আয়েশাকে মাঝে মধ্যে ডাকতেন উম্মে আব্দুল্লাহ বলে।
১৯. রাসুলে কারিম (সা.) স্মাট চলাফেরা করতেন। শরীরে কোন দুর্গন্ধ হতো না। ঘন ঘন মেসওয়াক করতেন। সুগন্ধি লাগাতেন।
২০. রাসুলে কারিম (সা.) স্ত্রীদের সাথে আনন্দঘন পরিবেশ উপভোগ করতেন এবং নিরপেক্ষ থাকতেন। একবার হযরত আয়েশা কৌতুক করে হযরত সাওদার গালে খাবার মাখিয়ে দেন। রাসুলে কারিম (সা.) মুচকি হাসি দিয়ে সাওদাকে বলেন আয়েশার মুখে খাবার মেখে দিতে। হযরত যয়নব একবার আয়েশাকে কড়া কথা বলার পর আয়েশা তার জবাব দেন। তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) আয়েশার পক্ষ নেন। আবার আয়েশা যখন সাফিয়্যার খাটো অবয়ব নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলেন তখন সাফিয়্যার পক্ষাবলম্বন করে আয়েশাকে বলেন, ‘‘তুমি এমন কথা বলেছো যা সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হলে সমুদ্রের পানি দুষিত হয়ে যেতো।” একদিন ঘরে এসে দেখলেন সাফিয়্যা কাঁদছেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করার পর সাফিয়্যা (রা.) জানান হাফসা (রা.) তাকে ইয়াহুদীর মেয়ে বলছে। তখন তিনি সাফিয়্যাকে সান্তনা দিয়ে বলেন, তুমি বংশগতভাবে একজন নবীর (হযরত হারুনের) কন্যা, আরেকজন নবী (হযরত মূসা) তোমার চাচা, আরেকজন নবী তোমার স্বামী। কিভাবে হাফসা তোমার চেয়ে উত্তম হয়?
চলবে……………….
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও গবেষক