সাফিয়্যাকে উটের পিঠে উঠতে হাঁটু গেড়ে সহযোগিতা
সাফিয়্যা ছিলেন নবী করিম (সা.) এর অন্যতম স্ত্রী। তিনি কিছুটা খাটো ছিলেন ফলে উটের পিঠে আরোহন করতে কষ্ট হতো। তাই রাসুলে কারিম (সা.) তাঁকে সাহায্য করার জন্য নিজের হাঁটু পেতে দিতেন। সাফিয়্যা সেই হাঁটুতে পা রেখে উটের হাওদায় উঠতেন। (সহীহ বুখারী)। সাফিয়্যা (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) তাঁর স্ত্রীদের সাথে হজে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে আমার উট বসে পড়ল। কারণ আমার উট ছিল দুর্বল। তাই আমি কেঁদে ফেললাম। নবী (সা.) আমার কাছে আসলেন। আমার চোখের পানি নিজের জামা ও হাত দিয়ে মুছে দিলেন। (মুসনাদে আহমদ)।
উম্মুহাতুল মুমীনদের জীবন থেকে কতিপয় ঘটনা
দাম্পত্য জীবনে রাসুল (সা.) ছিলেন একজন উত্তম ও আদর্শবান স্বামী। তিনি এগারজন বিবির সাথে ঘর-সংসার করেছেন। তন্মধ্যে দুজন হযরত খাদীজা ও যায়নাব বিনতে খুযাইমা (রা.) তাঁর জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন। নয়জন স্ত্রী তাঁর ইন্তেকালের পর জীবিত ছিলেন। এ ভাগ্যবতী নারীগণ রাসুলে কারিমের সান্নিধ্যে এসে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নারীদের কাতারে নিজেদেরকে শামিল করেছেন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তাঁদেরকে নারী জাতির আদর্শিক মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা সাধারণ মহিলাদের মত নও। যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তবে পর-পুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে কথা বলো না, যাতে রোগাগ্রস্থ দিলের মানুষ লোভে পড়ে যায়, বরং সোজাসুজি ও স্পষ্টভাবে কথা বলো। তোমরা স্ব-গৃহে অবস্থান কর এবং জাহেলি যুগের মতো সাজ-সজ্জা দেখিয়ে বেড়িও না। নামাজ কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য কর। আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।” এখানেই মহান আল্লাহ নবীপতœীদের মর্যাদার ইতি টানেননি। বরং তাঁদেরকে মুসলিম উম্মার মায়ের আসনে স্থান দেন। এর মাধ্যমে তাদের সম্মান ও মর্যাদার চূড়ান্ত স্বীকৃতির ঘোষণা দেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন: النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنفُسِهِمْ وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ “অবশ্য নবী ঈমানদারদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও বেশি অগ্রগণ্য। আর নবীর স্ত্রীগণ তাদের মাতা।
উম্মুহাতুল মুমীনগণ রাসুল (সা.) আসার আগে ঘর গুছিয়ে রাখতেন এবং নিজেরা সুন্দর পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন। তিনি বাহির থেকে আসার শব্দ শুনলে দরজা খুলে মুচকি হেসে অভ্যর্থনা জানাতেন। হযরত আয়েশা রাসুলে কারিম (সা.) এর গায়ের কোট খুলতে সাহায্য করতেন। রাসুল (সা.) ঘর থেকে বের হওয়ার আগে চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে দিতেন এবং ঘর থেকে বের হতে কাপড় চোপড় প্রস্তুত করতে সাহায্য করতেন। হযরত আয়েশা রাসুলে কারিম (সা.) এর ইন্তেকালের আগে বলেছেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ আপনি মেসওয়াক চিবাতে কষ্ট হচ্ছে আমি একটু চিবিয়ে নরম করে দিই?
সহীহ বুখারীতে এসেছে, রাসুল (সা.) এর স্ত্রীগণ দুটো দলে বিভক্ত ছিলেন। ১ম দলে ছিলেন হযরত আয়েশা, হাফসা, সাফিয়্যাহ, সাওদা (রা.)। ২য় দলটিতে ছিলেন হযরত উম্মে সালমা (রা.) সহ রাসুল (সা.) এর অন্যান্য স্ত্রীগণ। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, নবী পরিবারে যারা বসবাস করতেন তারা ছিলেন মানুষ। মানবীয় গুণাবলির ঊর্ধ্বে তাঁরা ছিলেন না। এছাড়া রাসুল (সা.) নিজেও ছিলেন সেরা মানুষ। অবশ্য রাসুলুল্লাহর (সা.) জীবনের ছোট বড়ো ঘটনা মধ্যে রয়েছে মানবজাতির জন্য শিক্ষণীয় বিষয়। আল্লাহ তায়ালা এসব ঘটনার মাধ্যমে মানবজাতিকে বিভিন্ন বিধি-বিধান ও আচরণের বাস্তব শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। তা না হলে নবীর জীবনে এসব ঘটনা না ঘটালেও পারতেন। বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে নবী পরিবারের বিভিন্ন ঘটনাবলী এবং তাঁরা আল্লাহর রাসুলের সাথে কিভাবে জীবন যাপন করেছেন তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আমি কয়েকটি দিক উল্লেখ করছি।
উম্মুহাতুল মুমীনগণ রাসুল (সা.) আসার আগে ঘর গুছিয়ে রাখতেন এবং নিজেরা সুন্দর পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন। তিনি বাহির থেকে আসার শব্দ শুনলে দরজা খুলে মুচকি হেসে অভ্যর্থনা জানাতেন। হযরত আয়েশা রাসুলে কারিম (সা.) এর গায়ের কোট খুলতে সাহায্য করতেন। রাসুল (সা.) ঘর থেকে বের হওয়ার আগে চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে দিতেন এবং ঘর থেকে বের হতে কাপড় চোপড় প্রস্তুত করতে সাহায্য করতেন। হযরত আয়েশা রাসুলে কারিম (সা.) এর ইন্তেকালের আগে বলেছেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ আপনি মেসওয়াক চিবাতে কষ্ট হচ্ছে আমি একটু চিবিয়ে নরম করে দিই?
হযরত আয়িশাকে জিবরীলের সালাম ও চড়–ইভাতি এবং পুতুল খেলার ঘটনা:
عَائِشَة শব্দের অর্থ: জীবিত ও সুখী জীবন যাপনকারী। নবী করীম (সা.) আয়িশাকে কখনো عَائِشَة (আয়িশু) বলে ডাকতেন। ইমাম বুখারী (রহ.) আয়িশা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন: একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে ডেকে বললেন, হে আয়িশু, জিবরাইল (আ.) তোমাকে সালাম জানাচ্ছেন। সাধারণত রাসুল (সা.) তাঁকেيَابِنْتَ السِّدِّيْقِ, يَابِنْتَ أَبِىْ بَكْرٍ (হে সিদ্দীকের মেয়ে। হে আবু বকরের মেয়ে) বলে ডাকতেন। আয়িশা (রা.) ও অন্যসব শিশুদের মত খেলাধুলার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তিনি দৌড়-বাজি, চড়–ই-ভাতি, দোলনায় চড়া ও পুতুল খেলায় খুব বেশি আনন্দ, উপভোগ করতেন। সমবয়সী প্রতিবেশি মেয়েরা তাঁর কাছে আসত এবং তিনি অধিকাংশ সময় তাদের সাথে খেলাধুলা করতেন। দৌড় প্রতিযোগিতায় তিনি কখনো হারেননি। সর্বদা বিজয়ী হতেন। প্রতিযোগিতায় জিতে তিনি কখনো আনন্দ উল্লাস করতেন না, হাসতেন না, গর্ব করতেন না, এমনকি পরাজিতাদের সাথে তিনি এমন আচরণ করতেন না, যাতে তারা মনে কষ্ট পায়, বরং তিনি তাদের সাথে এমন আচরণ করতেন, যাদ্বারা তারা পরাজয়ের গ্নানি ভুলে যেত। আয়িশা (রা.) এর বান্ধবী আসমা বিনত ইয়াযীদ বলেন, আমি যখন দৌড় প্রতিযোগিতায় হেরে যেতাম, তখন আয়িশা (রা.) আমাকে এবং অন্যান্য পরাজিত বান্ধবীদেরকে নিয়ে তাঁর বাসায় মায়ের কাছে নিয়ে যেতেন এবং বলতেন, আম্মা, তাদেরকে খেতে দিন, প্রতিযোগিতায় হেরে তাদের মন বেজায় খারাপ। তাঁর এরূপ সদয় আচরণ দেখে মা উম্মু রুমান খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়তেন এবং আল্লাহর কাছে এ বলে দুআ করতেন, “হে রাব্বুল আলামিন! আমার এই হৃদয়ের ধনের খ্যাতি তুমি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিও।”
আয়িশা প্রায়ই বান্ধবীদেরকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে চড়ুই ভাতি খেলতেন। মাঝে মাঝে বড়ো বোন আসমাও তাতে অংশগ্রহণ করতেন। চড়–ই ভাতি প্রস্তুত হয়ে গেলে আয়িশা সকল বান্ধবীদেরকে নিয়ে খেতে বসতেন এবং সকলের মাঝে তা অল্প অল্প করে বণ্টন করে দিতেন। বড়ো বোন আসমা বলেন, একদা আয়িশা চড়–ই ভাতি খেতে বসছেন। এমন সময় এক ভিক্ষুক এসে চিৎকার করে বলতে লাগল, “আমি বড়ো ক্ষুধার্ত! আমাকে খাবার দাও।” ডাক শুনে আয়িশা তার সামনে খাবার নিয়ে উপস্থিত হলো। মা এ দৃশ্য দেখে বলে উঠলেন, “কি করছিস তোর এ খাবারে ভিক্ষুকের পেট ভরবে? ভিক্ষুককে বসতে বল, ঘর থেকে খাবার নিয়ে যা।”
আসমা আরও বলেন, “একদা আমার ঘরে মেহমান আসলেন। তখন আয়িশা চড়–ই ভাতি খাচ্ছে। মেহমানকে দেখে আয়িশা চড়–ই ভাতি নিয়ে তার সামনে গিয়ে বলল, খান। আমি তখন তাকে বললাম, চড়–ই ভাতি দিয়ে কি মেহমানদারী করতে হয়? তার স্বার্থত্যাগ ও আতিথেয়তা দেখে আমার মনে হয়েছিল সে আব্বুর মতই দয়া, দানশীলতা ও আতিথেয়তার জগৎ বিখ্যাত হয়ে উঠবে।” কিন্তু খেলার মধ্যে দুটি খেলা ছিল তাঁর কাছে খুব বেশি প্রিয়, একটি পুতুল খেলা ও দ্বিতীয় দোল খাওয়া।
শৈশবের স্মৃতি সাধারণত বিস্মৃতির অতল গহবরে হারিয়ে যায়, কিন্তু তিনি ছিলেন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তাঁর মেধা ছিল প্রখর এবং প্রজ্ঞা ছিল অসাধারণ এবং উপস্থিত বুদ্ধি ছিল তুলনাহীন। মদীনায় হিজরতের সময় তাঁর বয়স আট-নয় বছর হলেও হিজরতের ঘটনার যত বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, তা আর কোন সাহাবি দিতে পারেননি।
আল্লাহর রাসুলের প্রতি সাফিয়্যার মহব্বত
রাসুলে কারিম (সা.) যখন মৃত্যু শয্যায় শায়িত ছিলেন। তখন তাঁর কষ্ট দেখে সাফিয়্যা বললেন হে আল্লাহর রাসুল আল্লাহর শপথ আপনার জায়গায় যদি আমি থাকতে পারতাম। তাঁর কথা শুনে অন্য স্ত্রীরা মুখচেপে হাসলেন। রাসুল (সা.) তাঁদের দেখে ফেললেন এবং বললেন তোমাদের মুখ ধুয়ে ফেল। তাঁরা বলল হে আল্লাহর রাসুল কেন? তিনি জবাবে বললেন কারণ তোমরা তাকে বিদ্রুপ করছো। আল্লাহর শপথ সে সত্য বলছে। (তাবাকাত ইবনে সাদ)।
আয়িশা ও সাফিয়্যা কর্তৃক খাবার প্রস্তুত করা ও ঝাঁকুনি দিয়ে প্লেট ভাঙার ঘটনা
আয়িশা (রা.) বলেন, সাফিয়্যা (রা.) অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন। তিনি চমৎকার খাবার তৈরি করতে পারতেন। তাঁর এই পারদর্শিতা স্বীকার করেন এভাবে “আমি তাঁর চেয়ে ভাল খাবার তৈরি করতে পারে এমন কাউকে দেখিনি।” একদা দুজনই রাসুল (সা.) এর জন্য খাবার প্রস্তুত করতে লাগলেন। সাফিয়্যা (রা.) এর রান্না আয়িশা (রা.) এর রান্নার পূর্বেই শেষ হয়ে গেল। তাই তিনি বাদীর মাধ্যমে খাবার আয়িশা (রা.) এর কক্ষে পাঠিয়ে দিলেন, যেখানে রাসুল (সা.) অবস্থান করছিলেন। আয়িশা (রা.) নিজের শ্রম বিফলে যাবে ভেবে এমন জোরে বাদীর হাতে ঝাকুনি দিলেন, যার ফলে বাদীর হাতের খাবারের পাত্রটি পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। রাসুল (সা.) কোন উচ্চ-বাচ্য না করে ভাঙা টুকরোগুলো একত্রিত করতে করতে বাদীকে বললেন, “তোমার মা রাগান্বিত হয়েছেন।” কিছুক্ষণ পর রাগ প্রশমিত হওয়ায় আয়িশা (রা.) নিজ কর্মের জন্য লজ্জিত হয়ে বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার ভুল হয়েছে। এর কাফফারা কি হতে পারে? জবাবে তিনি বলেন, “এরূপ খাদ্য এবং এরূপ পেয়ালা।” তখন আয়িশা (রা.) নতুন একটি পেয়ালায় সাফিয়্যার (রা.) এর জন্য নিজের তৈরি খাবার পাঠিয়ে দিলেন। আয়িশা (রা.) বলেন, সাফিয়্যা (রা.) বিভিন্ন পদ্ধতিতে গোশত রান্না করে আমাদেরকে খাওয়াতেন। আমরা তাঁর মধুর আচরণে সকলে তাঁর উপর সদা সন্তুষ্ট থাকতাম। তিনি আমাকে ছোট বোনের ন্যায় স্নেহ করতেন। আমিও তাঁকে বড়ো বোনের মত শ্রদ্ধা করতাম। তাঁর মত এত দয়াবর্তী এবং নিজ আত্মীয়-স্বজনদের আশ্রয়দাত্রী আর কাউকে দেখিনি।”
সুরা তাহরীমের আয়াত নাযিল ও মারিয়া কিবতির ঘটনা
উম্মুল মুমিনীন হাফসা (রা.) আয়িশা (রা.) এর পালার দিনে রাসুলে কারিম (সা.) কে মারিয়া কিবতিয়ার সাথে একান্তে দেখতে পেয়ে বললেন, অবশ্যই আমি এ বিষয়ে আয়িশাকে অবহিত করব। তখন রাসুল (সা.) বললেন, ভবিষ্যতে আমি তার সান্নিধ্যে আসলে সে আমার জন্য হারাম হবে। কিন্তু তা সত্তে¡ও হাফসা (রা.) আয়িশা (রা.) কে বিষয়টি অবহিত করেন। এদিকে আল্লাহ্ তাআলা তাঁর রাসুলকে এ বিষয়ে হাফসা কর্তৃক ঘটনাটি ফাঁস করা সম্পর্কে অবহিত করেন। এসকল কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর স্ত্রীদের নিকট থেকে এক মাস যাওয়া আসা থেকে বিরত থাকার প্রতিজ্ঞা করে ‘মাশরাবায়’ অবস্থান করেন। ‘মাশরাবায়’ রাসুলুল্লাহ্ (সা.) উনত্রিশ দিন অবস্থান করেন। তারপর সেখান থেকে বের হয়ে আসেন। বলা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি তো এক মাসের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, মাস কখনো কখনো উনত্রিশ দিন হয়ে থাকে। (ফাতহুল বারী- ৯/২২৬-২২৭; ইমাম ওয়াহিদী, সহীহ আসবাব আন-নুযূল পৃ. ১১৪-১১৫)।
সাধারণত সতীনওয়ালা ঘরে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক ঈর্ষা পরিলক্ষিত হয়। এ ক্ষেত্রে হাফসা ব্যতিক্রম কিছু ছিলেন না। একজন নারী স্বভাবগতভাবেই তাঁর স্বামীকে ভালবাসেন। একাই স্বামীর সবটুকু ভালবাসা পেতে চান। সব সময় স্বামীকে কাছে পেতে চান। রাসুল (সা.) এর স্ত্রীরাও তাঁকে এমনই ভালবাসতেন। সবাই রাসুলের ভালবাসার অধিকারী হতে চাইতেন। এক্ষেত্রে তাঁদের পারস্পরিক ঈর্ষার ঘটনা ঘটা অবাস্তব ছিল না। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও সীরাত গ্রন্থকারগণ এসব ঘটনা উল্লেখ করেছেন।
হিজরী ৯ম সালে নাযিল হয় আল-কুরআনের সুরা আত-তাহরীম। এই সুরায় দুধরনের বর্ণনা পাওয়া যায় (ক) রাসুলে কারিম (সা.) নিজ দাসী মারিয়া কিবতিয়্যাকে সঙ্গ দেওয়ার ঘটনা (খ) রাসুলে করীম (সা.) এর মধু পানের ঘটনা।
ফাতহুল কাদীর গ্রন্থকার আল্লামা শাওকানী (রহ.) আয়াতটির শানে নযুল বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ৭ম হিজরি সালে মিসরের তৎকালীন বাদশা ‘মুকাত্তকিস’ রাসুলুল্লাহ (সা.) জন্যে ‘মারিয়া কিবতিয়্যা’ নামে একজন দাসীকে উপঢৌকন হিসেবে প্রেরণ করেন। একদিন সাইয়্যেদা হাফসা (রা.) ঘরের বাইরে ছিলেন। তিনি তাঁর বাবা হযরত ওমর (রা.) এর বাড়িতে গিয়েছিলেন। সে সময় আল্লাহর রাসুল (সা.) হাফসার ঘরে আসেন এবং দাসী মারিয়া কিবতিয়্যাকে ডেকে সঙ্গ দেন। বাবার বাড়ি থেকে ফিরে এসে যখন হাফসা তার ঘরে তারই বিছানায় দাসী মারিয়াকে দেখতে পান, তখন তিনি ভীষণ কষ্ট পান। অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে তিনি আল্লাহর রাসুল (সা.) কে বললেন! আপনি আমার বিছানায় একি করলেন? জবাবে আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, হাফসা! তুমি কি সন্তুষ্ট নও যে, আমি মারিয়াকে আমার উপর হারাম করে নিব। আর কোন দিন তার কাছেও যাব না। তখন হযরত হাফসা (রা.) বললেন হ্যাঁ অবশ্যই। আমি এতে সন্তুষ্ট। সে সময় আল্লাহর রাসুল (সা.) মারিয়ার সাহচার্যকে নিজের উপর হারাম করে নেন। আর এ কথা তিনি হাফসাকে গোপন রাখতে বলেন। কিন্তু তিনি তা গোপন রাখতে পারলেন না। আয়েশা ছিদ্দিকা (রা.) এর নিকট প্রকাশ করে দেন। এরপর আল্লাহ পাক তাঁর নবী (সা.) কে এসব কিছু জানিয়ে সুরা আত-তাহরীমের এই আয়াতসমূহ নাযিল করেন; হে নবী! যে জিনিসকে আল্লাহ আপনার জন্য হালাল করেছেন তাকে আপনি কেন হারাম করেন? (শুধু এ জন্য যে) আপনি আপনার বিবিদের খুশি চান? আল্লাহ ক্ষমাশীল ও মেহেরবান। ২. আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের কসমের দায়-দায়িত্ব থেকে বাঁচার পথ ঠিক করে দিয়েছেন। আল্লাহই তোমাদের মনিব এবং তিনি মহাজ্ঞানী ও সুকৌশলী। ৩. (এ ঘটনাটিও ভেবে দেখার মতো যে) নবী তাঁর এক বিবির কাছে একটা কথা গোপনে বলেছিলেন। তারপর যখন ঐ বিবি (আর এক বিবির কাছে) ঐ গোপন কথা ফাঁস করে দিলো, তখন আল্লাহ নবীকে ঐ ফাঁস করার খবর জানিয়ে দিলেন। তখন নবী (ঐ বিবিকে) কতকটা সাবধান করে দিলেন এবং কিছুটা মাফ করে দিলেন। তারপর যখন নবী তাঁকে (গোপন কথা ফাঁস করার বিষয়) জানালেন তখন সে জিজ্ঞেস করলো যে, আপনাকে এ খবর কে দিয়েছে? নবী বললেন, “আমাকে তিনিই খবর দিয়েছেন, যিনি সব কিছু জানেন ও সব কিছুর খবর রাখেন।” (সুরা তাহরিম: ১-৩)।
হযরত আয়েশার সাথে আল্লাহর রাসুলের রোমান্টিকতা
হযরত আয়িশা বলেন, এক রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার নিকট ছিলেন। আমি বললাম, আপনি ঘুমের মধ্যে কোথায় ছিলেন? রাসুল (সা.) বললেন, হুমায়রা (আয়িশার উপনাম)! আমি ঘুমের ঘোরে উম্মু সালামার নিকট ছিলাম। আমি বললাম, উম্মু সালামা থেকে পরিতৃপ্ত হয়েছেন তো? রাসুল (সা.) মুচকি হাসলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি নিজের সম্পর্কে আমাকে অবহিত করবেন? তাহলো, যদি আপনি এমন দুটি চারণভ‚মির নিকট অবতরণ করেন, যার একটিতে কেউ বিচরণ করেনি এবং অপরটিতে বিচরণ করা হয়েছে, তাহলে কোনটিতে আপনি চরতেন? রাসুল (সা.) বললেন, যাতে কেউ বিচরণ করেনি সেটিতে। আয়িশা বলেন, আমি বললাম, আমি আপনার অন্য স্ত্রীগণের কারো মতো নই। আমি ছাড়া আপনার প্রত্যেক স্ত্রীই ইতোপূর্বে অন্য স্বামীর অধীনে ছিল। এতে রাসুলুল্লাহ (সা.) মুচকি হাসেন। এভাবে উম্মুল মুমিনীনগণ রসিকতা করতেন। আর রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁদের সাথে রসিকতায় অংশগ্রহণ করতেন।
আরেক দিন রাসুলে কারিম (সা.) আয়েশার ঘরে এসে দেখলেন আয়েশা মাথা ব্যথার কারণে বলছে হায় মাথা ব্যথা। রাসুলে কারিম (সা.) মজা করে বললেন আয়েশা আমার মাথা ব্যথা হয়েছে তোমার কোন সমস্যা নেই। তুমি যদি আমার পূর্বে মারা যাও তাহলে আমি তোমার পাশে থাকব। তোমাকে গোসল দিব, তোমার কাফন দিব, তোমার জানাযার সালাত আদায় করব। আয়েশা জবাব দিলেন, হ্যাঁ আমি মারা যাই আর আপনি সে রাতেই আমার ঘরে অন্য বিবি নিয়ে থাকেন। আয়েশার কথা শুনে রাসুলে কারিম (সা.) হেঁসে ফেলেন।
হযরত আয়েশার ছোট বেলায় আল্লাহর রাসুল (সা.) একবার আয়েশার পুতুল দেখে জানতে চাইলেন এটা কি? আয়েশা জবাব দিলেন ঘোড়া। তিনি আবার জানতে চাইলেন ঘোড়ার মধ্যে এই দুইটা কি? আয়েশা বললেন এটা হচ্ছে ঘোড়ার ডানা। তিনি কৌতুক করে বললেন ঘোড়ার আবার ডানাও রয়েছে। আয়েশা তার জবাবে বললেন , “বারে আপনি কি জানেন না সোলাইমান (আ.) এর ঘোড়ার দুইটা পাখা ছিল।” আয়েশা (রা.) এর জবাব শুনে রাসুলে কারিম (সা.) এমনভাবে হাঁসলেন যে তাঁর দাতের মাড়ি দেখা যায়।
উম্মে সালমা ও সাফিয়্যা প্রসঙ্গ
হযরত উম্মে সালমার সাথে আল্লাহর রাসুলের বিবাহের প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত সমস্যার কথা তুলে ধরে উম্মু সালামা (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার প্রতি আমার আগ্রহের কমতি নেই। তবে কথা হলো আমি একজন ভীষণ অভিমানী নারী। তাই আমার ভয় হচ্ছে, না জানি আমার পক্ষ থেকে আপনি এমন কোন আচরণের সম্মুখীন হন যার কারণে মহান আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিবেন। এর সাথে সাথে উম্মু সালামা (রা.) নিজের বয়সের আধিক্য এবং বিপদগ্রস্থ পরিবারের (কয়েকজন ইয়াতিম সন্তানের জননী) কর্ত্রী হওয়ার কথাও উল্লেখ করেন। রাসুল (সা.) তার কথার জবাবে বলেন, আমি আল্লাহর নিকট দোয়া করব, আল্লাহ তোমার অভিমান মিটিয়ে দিবেন। বয়সের যে আধিক্যের কথা বলছ, আমি তো বয়সে তোমার বড়ো। তারপর সন্তান-সন্তুতির যে সমস্যার কথা বলছ তা আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও। আল্লাহ তোমার সন্তানদের জন্য যথেষ্ঠ। তারা হবে আমারই সন্তান।
হযরত আবদুর রহমান ইবনুল হারিছ থেকে বর্ণিত যে তিনি বলেন, কোন এক সফরে রাসুল (সা.) এর সাথে তাঁর বেগমদ্বয় সাফিয়্যা ও উম্মু সালামা (রা.) ছিলেন। নবীজি উম্মু সালামার হাওদা মনে করে সাফিয়্যার হাওদায় চলে আসেন। ঐ দিনটি ছিল পালাক্রমে উম্মু সালামার নির্ধারিত দিন। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাফিয়্যার সাথে কথা বলতে শুরু করেন। এতে উম্মু সালামার ঈর্ষা হয়। পরক্ষণে রাসুল (সা.) জানতে পারেন তিনি সাফিয়্যা। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মু সালামার কাছে ফিরে আসেন। এবার উম্মু সালামা ঈর্ষান্বিত হয়ে বলে ফেললেন, আমার নির্ধারিত দিনে আপনি একজন ইয়াহুদীর মেয়ের সাথে কথা বলেছেন, অথচ আপনি আল্লাহর রাসুল! উম্মু সালামা (রা.) বলেন, অতঃপর একথার জন্য আমি লজ্জিত হই। তিনি এ কথার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতেন। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করুন। আমার ঈর্ষাই আমাকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে।
বিভিন্ন রেওয়ায়াত দ্বারা প্রমাণিত যে রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মু সালামাকে সম্মান করতেন, তাঁকে যথোপযুক্ত স্থানে স্থান দিতেন। ইবন হাজার আসকালানী থেকে বর্ণিত। হযরত উম্মু সালামা (রা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা আমার গৃহে নাযিল করেন: “আল্লাহ তো এটাই চান যে তোমাদের নবী-পরিবার থেকে ময়লা-আবর্জনা দূর করে দিবেন এবং তোমাদেরকে পুরোপুরি পাক-পবিত্র করে দিবেন।” উম্মু সালামা (রা.) বলেন, এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) হযরত ফাতিমা, আলী এবং হাসান ও হোসাইন (রা.) কে নিজের কাছে ডেকে আনেন। তারপর বললেন, এরা আমার আহলে বাইত। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি কি আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত নই? রাসুল (সা.) বললেন, হাঁ, এ সম্পর্কে আরেকটি রেওয়ায়াত বর্ণিত আছে, উম্মু সালামা (রা.) বলেন, আল্লাহর নবী একটি কালো চাদর দ্বারা আলী, ফাতিমা এবং হাসান ও হোসাইনকে আচ্ছাদিত করেন। অতঃপর বলেন, হে আল্লাহ! আমি ও আমার আহলে বাইত আগুনের কাছে নয়, তোমার কাছে আশ্রয় চাই।
হযরত উম্মু সালামা (রা.) বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার গৃহে বিমর্ষ চেহারায় প্রবেশ করেন। অসুস্থতার কারণে তাঁর এরূপ হওয়ার আশঙ্কা করেছিলাম। বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার চেহারা বিমর্ষ কেন? তিনি বললেন, গতকাল যে সাতটি দীনার আমি নিয়ে এসেছিলাম সে কারণে। সন্ধ্যায় এসে উপনীত হলাম অথচ দীনারগুলো বিছানার পাশে রয়ে গেল।
হিজরী একাদশ বর্ষে রাসুলুল্লাহ (সা.) জীবনের শেষ দিনগুলোতে যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং হযরত আয়িশার ঘরে অবস্থান করতে থাকেন তখন হযরত উম্মু সালামা প্রায়ই রাসুলকে দেখতে আসতেন। একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে পড়ে। এতে উম্মু সালামা নিজেকে সামলাতে পারেননি। হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠেন। রাসুল (সা.) নিষেধ করে বললেন, এটা মুসলমানদের আদর্শ নয়।
স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের জন্য পোশাক সাদৃশ
আল্লাহ তায়ালা সুরা আল বাকারার ১৮৭ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করেন স্বামী স্ত্রী পরস্পরের জন্য লেবাস সাদৃশ। কিন্তু স্বামী স্ত্রী পরস্পরের জন্য লেবাস এই কথা আল্লাহ তায়ালা কেন বলেছেন তার ব্যাখ্যায় আল্লামা আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন আহমদ আল আনসারী আলকুরতুবী বলেন, স্বামী স্ত্রী পরস্পর লিবাসের মত মিলে মিশে একাকার হয়ে থাকে। তারা একের অপরের দেহের সাথে এমনভাবে থাকে যেন একই পরিচ্ছেদ স্বরূপ। একে অপরকে ভালভাবে জানতে হবে; পরস্পরের চিন্তা-চেতনা ও রুচি অনুধাবন করেই সেইভাবে আচরণ করার চেষ্টা করতে হবে। মওদুদী (রহ.) তাঁর তাফসীর তাফহীমুল কুরআনে উল্লেখ করেন, ‘‘পোশাক ও শরীরের মাঝখানে যেমনি কোন পর্দা বা আবরণ থাকতে পারে না এবং উভয়ের সম্পর্ক ও সম্মিলন হয় অবিচ্ছিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য, ঠিক তদ্রুপ তোমাদের ও তোমাদের স্ত্রীদের সম্পর্কও।” বিভিন্ন তাফসীরে এই সংক্রান্ত যেসব ব্যাখ্যা এসেছে তার সাথে আমার ব্যক্তিগত কিছু উপলব্ধিসহ নীচে তার সার নির্যাস পেশ করছি। নীচের এই কথাগুলোর সাথে পাঠকের দ্বিমত থাকতে পারে। কারণ এটা আমার অধ্যয়ন ও উপলব্ধির সারাংশ:
১. পোশাক যেমনিভাবে শীত বা গরম থেকে রক্ষা করে তেমনিভাবে স্বামী-স্ত্রীকে স্ত্রী স্বামীকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে এবং অবৈধ কাজ করার ক্ষেত্রে রক্ষাকবচ। এই জন্য হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি বিয়ে করল সে যেন তার দ্বীনের দুই তৃতীয়াংশ রক্ষা করল। তারা একে অপরের জন্য অবৈধ কাজ থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রে পর্দা স্বরূপ।”
পোশাক মানুষের দৈহিক দোষ-ত্রুটি গোপন করে তেমনিভাবে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের দোষ গোপন করে। পোশাক যেমনিভাবে ব্যক্তি যেখানে যায় সেখানে সাথে থাকে। তেমনিভাবে কোন কারণে স্বামী-স্ত্রী ভৌগলিক দূরত্বে থাকলেও মনের আয়নায় একে অপরের কাছাকাছি থাকতে হবে। অন্য কারও কথা বা চিন্তা মনের ভিতর যেন উঁকি না দেয় সেজন্য সদা সতর্ক থাকতে হবে।
২. পোশাক মানুষের দৈহিক দোষ-ত্রুটি গোপন করে তেমনিভাবে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের দোষ গোপন করে।
৩. পোশাক যেমনিভাবে ব্যক্তি যেখানে যায় সেখানে সাথে থাকে। তেমনিভাবে কোন কারণে স্বামী-স্ত্রী ভৌগলিক দূরত্বে থাকলেও মনের আয়নায় একে অপরের কাছাকাছি থাকতে হবে। অন্য কারও কথা বা চিন্তা মনের ভিতর যেন উঁকি না দেয় সেজন্য সদা সতর্ক থাকতে হবে।
৪. মানুষ পোশাক তার নিজের জন্য নির্দিষ্ট করে তেমনিভাবে স্বামী স্ত্রী একে অপরের জন্য নির্দিষ্ট করে।
৫. সাধারণত কয়েকটি পোশাক দেখে নিজের পছন্দের পোশাক ক্রয় করি। কখনও মাত্র একটি দেখেই পোশাক পছন্দ করা হয়। অনুরূপভাবে বিবাহ শাদীর ক্ষেত্রে কখনও কখনও একাধিক পাত্র/পাত্রী দেখে পছন্দ করা হয়। আবার কখনও মাত্র একজনকে দেখে পছন্দ করা হয়।
৬. নতুন পোশাক শরীরের সাথে এডজাস্ট হতে একটু সময় লাগে। তাই কখনও কখনও দেখা যায় পোশাক কেনার পর তা পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। এতে পোশাক একটু নরম হয় এবং ব্যবহার করতে আরাম দায়ক লাগে। অনুরূপভাবে বিবাহের পর বর-কনে পরস্পরকে জানতে, বুঝতে এবং একে অপরের পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে ধারণা পেতে কিছুটা সময় লাগে।
৭. পোশাক পছন্দের ক্ষেত্রে যেমনিভাবে মূল্য, পোশাকের রং, কোন ধরনের কাপড় তা দেখে ঠিক করা হয়। এই ক্ষেত্রে কেউ রং এর গুরুত্ব বেশি দেয় আর কেউ দামের গুরুত্ব বেশি দেয়। অনুরূপভাবে বিবাহের ক্ষেত্রে দ্বীন, রূপ, অর্থ, বংশ দেখে ঠিক করতে হয়। এই ক্ষেত্রে কেউ রূপের গুরুত্ব দেয় আর কেউ অর্থের গুরুত্ব দেয়। তবে আল্লাহর রাসুলের হাদিসের আলোকে দ্বীনদারীকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
৮. পোশাক আটকা পড়লে যত্মের সাথে খুলতে হয়। কখনও কখনও দেখা যায় কারও পোশাক একটু ছিঁড়ে যায়। তখন ব্যক্তি নিজে তা সেলাই করে পরিধান করে আর অথবা অন্য কেউ বা প্রফেশনাল দর্জি সেলাই করে দেয়। অনুরূপভাবে বিবাহে মাঝে মধ্যে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তখন নিজেরা বসে আলাপ আলোচনা করে তা সমাধান করা ভাল। তা না হলে পরিবারের মধ্য থেকে উদ্যোগ নিয়ে তাদের মাঝে সুলহ ও ইসলাহ করতে হয়। আর প্রয়োজনে প্রফেশনাল কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করে বিবাহ কার্যকর রাখতে হয়। অনেক সময় দেখি নিজের অজান্তে কোথাও বসলে বা পথ চলতে পোশাক আটকা পড়ে। এই সময় জোরে টান দেওয়ার পরিবর্তে সতর্কতার সাথে খুলতে হয়। জোরে টান মারলে অনেক সময় ছিঁড়ে যায়।
৯. পোশাক ক্রয় করার সময় তা ফিট হবে কিনা যাচাই করা হয়। একটি পোশাক সুন্দর হলেও সকলের জন্য সব পোশাক ফিট হয় না। পোশাক শরীরের সাথে এডজাস্ট হয় কিনা তা আগে যাচাই করে দেখতে হয়; এই জন্য সাইজ দেখতে হয়। বিবাহের আগে নারী-পুরুষ একে অপরের সাথে এডজাস্ট কতটুকু হবে তা ভালভাবে দেখতে হয়। ফিটনেস যাচাই না করে পোশাক কিনলে কখনও কখনও শরীরে ফিট হয় না। অনুরূপভাবে কখনও কখনও বর-কনে উভয়েই ভাল হলেও একে অপরের জন্য উপযোগী হয় না বলে বিবাহের পর ভাঙ্গন দেখা দেয়। এমনকি আল্লাহর রাসুলের অনেক সাহাবীর জীবনেও বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। উভয়েই সাহাবী হওয়ার পরও একে অপরের সাথে চিন্তা চেতনাসহ সকল ক্ষেত্রে ফিট হয়নি বলেই তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহের আগে কয়েকটি বিষয়ে সমতা দেখতে হয় একে বলা হয় কুফু। ছেলে-মেয়ের মাঝে সামঞ্জস্যতার কথা চিন্তা না করে অনেক সময় শুধুমাত্র অভিভাবকরা একে অপরের বন্ধু বলে কোন ছেলে-মেয়ের বিবাহ দেওয়া উচিত নয়।
১০. পোশাক এর প্রতি আকর্ষণ কমে যাওয়া প্রসঙ্গ: অনেক সময় পোশাক কেনার পর যেমনিভাবে ক্রেতা খুশী হয় না কিন্তু তারপরও উক্ত পোশাক পরিধান করেন। অনুরূপভাবে বিবাহের পর কখনও কখনও স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে দেখে খুুশি হয় না তারপরও তারা সংসার করছেন। এই অস্তুষ্টির কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায় স্বামী-স্ত্রী আর আগেরমত পরস্পরকে আকর্ষণীয় মনে করেন না। পুরুষেরা মনে করেন তাদের সহধর্মিণী হয় বুড়িয়ে গেছে নয়তো মুটিয়ে গেছে। শুরুতে যে প্রেম, যে ভালবাসা সহধর্মিণীর প্রতি তৈরি হতো তার ছিঁটেফোটাও এখন অন্তরে নেই।
১১. পোশাক সীমাবদ্ধতা ও বাস্তবতা মেনে নেয়: আমরা পোশাক গায়ে দিয়ে মাঝে মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজি কিংবা তপ্ত রোদে চলি। এই ক্ষেত্রে বাস্তবতা ও সীমাবদ্বতা পোশাক মেনে চলে। তেমনিভাবে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মধুর হয় যদি পরস্পরের সীমাবদ্বতা ও বাস্তবতা সহজেই মেনে নেয়া হয়। কিন্তু কখনও কখনও দেখা যায় বাস্তবতা মেনে না নিয়ে প্রত্যাশা বেশি করায় প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে অনেক দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এই দূরত্ব পারিবারিক জীবনে বিরাট প্রভাব ফেলে।
১২. পোশাক পছন্দ হওয়ার পর আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে পোশাকের মানের উপর ভিত্তি করে যেমনিভাবে মূল্য নির্ধারিত হয় অনুরূপভাবে বর-কনে পরস্পরকে পছন্দ করার পর মোহর নির্ধারণ করতে হয় আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে। সকল পোশাকের দাম যেমনিভাবে এক রকম হয় না। পোশাকের মানের আলোকে মূল্যের তারতম্য হয়। অনুরূপভাবে সকলের মোহর সমান হয় না। এই ক্ষেত্রে পাত্রের সামর্থ্য এবং পাত্রীর সামাজিক মর্যাদা এবং পারিবারিক ঐতিহ্য বিবেচনা করে মোহর নির্ধারণ করতে হয়। তবে মনে রাখতে হবে পরিশোধ করার নিয়্যাত ছাড়া অধিক পরিমাণের মোহর নির্ধারণ করা যাবে না। ভাল মানের কাপড়ের মূল্যও ইচ্ছে করলে বিক্রেতা কম নিতে পারেন অনুরূপভাবে কনের বংশীয় মর্যাদা ও সার্বিক বিবেচনায় অধিক পরিমাণের মোহর হওয়ার কথা থাকলেও কনে ইচ্ছা করলে কম মোহর নিতে পারেন।
১৩. বিক্রেতার কাছ থেকে পোশাক নেওয়ার সময় ব্যবহার শুরু করার আগে মূল্য পরিশোধ করতে হয়। অনুরূপভাবে বিবাহ-শাদী হওয়ার পর শারীরিক সম্পর্ক করার আগে মোহর দিতে হয়। বিক্রেতার অনুমতি সাপেক্ষে যেমনিভাবে বাকিতে মূল্য দেওয়া যায়। তেমনিভাবে শুধুমাত্র কনের অনুমতি সাপেক্ষ বিলম্বে মোহর দেওয়া যেতে পারে অন্যথায় নয়। যেমনিভাবে বিক্রেতা ইচ্ছা করলে কাউকে পোশাক উপহার দিতে পারেন। অনুরূপভাবে কনে ইচ্ছা করলে তার মোহর পুরোটাই স্বামীকে উপহার হিসেবে দিতে পারেন।
১৪. পোশাকের মূল্য পরিশোধের পর উক্ত অর্থের উপর ক্রেতার যেমনিভাবে আর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। অনুরূপভাবে বর কর্তৃক কনেকে মোহর দেওয়ার পর তা দিয়ে কনে কি করবে সেটা সম্পূর্ণভাবে কনের ইখতিয়ার। ক্রেতা কোন পোশাক পছন্দ করলে বিক্রেতা ক্রেতাকে তার পছন্দনীয় পোশাক কেনার জন্য যেমনিভাবে কোন অর্থ দেওয়া হয় না। অনুরূপভাবে কনে পছন্দের পর বর কোন ধরনের যৌতুক চাইতে পারে না। তবে পোশাক বিক্রেতা ইচ্ছা করলে ক্রেতাকে যেমনিভাবে কোন কিছু উপহার দিতে পারেন অনুরূপভাবে কনে বা কনের পক্ষ থেকে বরকে উপহার দেওয়া যায়। কিন্তু যেমনিভাবে কেউ উপহার চাইতে পারেন না বা উপহারের জন্য চাপ কিংবা ডিমান্ড করতে পারে না। অনুরূপভাবে বর কর্তৃক কনের উপর বা কনের পরিবারের উপর উপহারের জন্য কোন ধরনের চাপ প্রয়োগ করা যায় না।
১৫. পোশাকের মূল্য পরিশোধের পর যেমনিভাবে উক্ত পোশাক ব্যবহারের আগে তা যদি ফেরত দেওয়া হয় তাহলে বিক্রেতা পুরো অর্থ ফেরত দেয় বা কিছু রেখে বাকিটা ফেরত দেয়। অনুরূপভাবে বর-কনের বিবাহের পর পরস্পরের দৈহিক মিলনের আগে বিচ্ছেদ হলে মোহর এর অর্থ ফেরত দিতে হয়। কিন্তু পোশাক ব্যবহারের পর যেমনিভাবে তা ফেরত দিতে চাইলে অর্থ ফেরত পাওয়া যায় না। তেমনিভাবে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে পরস্পরের শারীরিক সম্পর্ক হওয়ার পর বিচ্ছেদ হলে মোহর ফেরত পাওয়া যায় না।
১৬. নতুন পোশাক কেনার পর তা যদি সুন্দরভাবে যতœ করে রাখা না হয় অনেক সময় ভাঁজ পড়ে যায়। তেমনিভাবে বিবাহ-শাদীর পর স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের জন্য সব সময় সুন্দর পরিপাটি থাকার চেষ্টা করা উচিত। কিছু দিন পোশাক পরিধান করলে ময়লা বা দুর্গন্ধ লাগতে পারে। তাই পোশাক মাঝে মধ্যে পরিষ্কার করার জন্য ধোয়া হয় এবং আবার ইস্ত্রি করে পরিধান করা হয়।
১৭. কখনও কখনও পোশাক একটু ছিঁড়ে গেলে আবার সেলাই করে পরিধান করা হয়। অনুরূপভাবে স্বামী-স্ত্রী কিছু দিন এক সাথে বসবাস করলে কিছু সমস্যা হতে পারে কিন্তু তা মাঝে মধ্যে ধুয়ে মুছে ছাপ করে নিতে হয়। একটু ময়লার জন্য পোশাক যেমনিভাবে ফেলে দেওয়া হয় না। অনুরূপভাবে মাঝে মধ্যে কিছু মতপার্থক্য বা তর্ক বিতর্ক হলেই বিবাহ বিচ্ছেদের চিন্তা করা ঠিক নয়। এমনকি ছিঁড়া কাপড়ও দীর্ঘদিন সেলাই করে পরিধান করা যায়। অনুরূপভাবে ভাঙনের মুখোমুখি অনেক দম্পতিকেও দেখা যায় তারা নিজেদের মতপার্থক্য ও সমস্যা সমাধান করে আমরণ সুখী জীবন যাপন করছেন। যেমনিভাবে পোশাক পরিধান করার পর তার উপর আতর লাগানো হয় খুশবু ছড়াতে। তেমনিভাবে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের জন্য মোহনীয় হতে খুশবু ব্যবহার করা হয়। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে আমরা পোশাক যতটুকু যতœ করে রাখি স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক সুন্দর রাখার জন্য একে অপরের প্রতি ততটুকু যতœশীল থাকি না। আমরা নতুন পোশাক পছন্দ করার জন্য যতটুকু ভাবি বিবাহ-শাদী করার ক্ষেত্রে ততটুকু ভাবি না।
১৮. পোশাক ক্রয় করার জন্য যতটুকু দেখা দরকার ততটুকু দেখতে হয়। প্রতিদিন গিয়ে ক্রয় করার কথা বলে পোশাক দেখতে বিক্রেতা দিবে না। অনুরূপভাবে বর-কনে পরস্পর পছন্দ করার জন্য একে অপরকে দেখা দরকার। এই ক্ষেত্রে সিদ্বান্ত নেওয়ার জন্য যতটুকু প্রয়োজন শুধু ততটুকু দেখা ও আলাপ-আলোচনা করা যায়। বিবাহের আগে প্রস্তাবিত বর-কনের সাথে ইচ্ছামত ঘুরাঘুরি করা যায় না। একদিন একজন সাহাবী রাসুলে কারিম (সা.) কে বললেন হে আল্লাহর রাসুল! আমার বিবাহ ঠিক হয়েছে। আল্লাহর রাসুল তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি কনেকে দেখেছো? তিনি জবাব দিলেন না । তখন আল্লাহর রাসুল বললেন, ‘তুমি তাকে দেখ। এই দেখা তোমাদের মাঝে হৃদিক সম্পর্ক তৈরির জন্য অধিক উপযোগী।
১৯.অনেক সময় পুরাতন পোশাক ক্রয়-বিক্রয় হতে দেখা যায়। অনুরূপভাবে কারো স্বামী-বা স্ত্রী মারা গেলে কিংবা বিবাহ বিচ্ছেদ হলে দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে দেখা যায়। এইক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। স্বামী মারা গেলেও স্ত্রীকেও স্বামীর সাথে কবর দেওয়া হতো। আর বিধবা নারীকে বিবাহ করতে কেউ কেউ চান না। কিন্তু হযরত আয়েশা ছাড়া আল্লাহর রাসুল (সা.) এর সকল স্ত্রী ছিলেন বিধবা। তাই কুমারী মেয়ের মত বিধবা নারী বিবাহ করারও সুন্নাহ।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও গবেষক