প্রিয় শ্রমিক ভাই ও বোনেরা
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ।
পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষে আপনাদের জন্য রইল আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
সময়ের পরিক্রমায় রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে পবিত্র ‘মাহে রমজান’ আবারো আমাদের নিকট সমাগত। রাসূলুল্লাহ (সা) এ মাসকে শাহরুন মোবারক তথা বরকতময় মাস বলে অভিহিত করেছেন। মাহে রমজানের রোজাকে ফরজ করার মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানবজাতির ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের উন্নতি ও কল্যাণের মূল ভিত্তি তাকওয়াপূর্ণ জীবনগঠনের অনন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআন মাজিদের সুরা আল বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।” সাওম বা রোজা যেমন ক্ষুধায়-কাতর দুঃখী মানুষের প্রতি আমাদের মমত্ববোধ জাগিয়ে তোলে, তেমনি শিক্ষা দেয় সততা, ধৈর্য, একনিষ্ঠতা, ত্যাগ, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহানুভ‚তির। আর প্রেরণা জোগায় শোষণ, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বৈষম্য মুক্ত একটি ইনসাফপূর্ণ সমাজ গড়ার।

ইসলাম প্রিয় শ্রমিক ভাই ও বোনেরা
রসূল (সা) বলেছেন, “ইসলাম পাঁচটি বুনিয়াদ বা খুঁটির ওপর কায়েম আছে- ১. এ সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, ২. নামাজ কায়েম করা, ৩. যাকাত আদায় করা, ৪. হজ্জ ও ৫. রমজানের রোজা রাখা। (বুখারী ও মুসলিম) রোজা বা সাওম হচ্ছে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। সিয়াম শব্দটি আরবি সাওম শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ বিরত থাকা। অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকাই হলো রোজা। মূলত রমজান মাসটি হলো আমাদের জন্য প্রশিক্ষণের মাস। রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা। আল্লাহকে ভয় করে জীবন পরিচালনার শিক্ষা হাসিল করা। তাকওয়া শব্দের অর্থ হচ্ছে- ‘সুরক্ষা করা, বেঁচে থাকা’ অর্থাৎ আমাদের প্রকাশ্য ও গোপনীয় সকল কাজ আল্লাহ দেখছেন এ ভয় অন্তরে ধারণ করে আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা এবং আল্লাহর পছন্দনীয় কাজ যথাযথভাবে পালন করার নাম তাকওয়া। রোজাদার ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে রোজা ভেঙে যায় এমন কোনো কাজ করে না। কঠিন পিপাসায় কাতর হয়েও পানি পান করে না, আবার ক্ষুধার কঠিন যন্ত্রণায়ও কোনো খাবার খাওয়ার চিন্তা করে না। এভাবে তাকওয়ার সৃষ্টি হয়। আর যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তাদেরকে মুত্তাকি বলে। সুতরাং রোজা রেখে যদি মিথ্যা বলা, পরনিন্দা করা, অশ্লীল কথা ও কাজ, প্রতারণা, ধোঁকাবাজি, গীবত, চোগলখুরি, হিংসা-বিদ্বেষ, কাজে ফাঁকি দেওয়া এবং অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করাসহ সকল প্রকার অপরাধমূলক কাজ থেকে আমরা নিজেকে দূরে রাখতে না পারি, তাহলে আমাদের রোজা আল্লাহর নিকট কখনো কবুল হবে না। রাসূল (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও মন্দ কাজ পরিত্যাগ করতে পারে নাই তার সারাদিন না খেয়ে থাকা আল্লাহর কাছে কোনো প্রয়োজন নাই।” (বুখারি)
সম্মানিত শ্রমজীবী ভাই-বোনেরা
রমজান মাস মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বড় নেয়ামত। আমরা জানি এ মাসে একটি ফরজ ইবাদত করলে অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আদায়ের সমান সওয়াব পাওয়া যায়, তেমনিভাবে একটি নফল ইবাদত করলে অন্য মাসের ফরজ আদায়ের সমান ফযিলত পাওয়া যায়। এ মাসে এমন একটি রাত (লাইলাতুল কদর) রয়েছে, যে রাতের মর্যাদা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। রাসূল (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও আত্মসমালোচনার সাথে রমজানের রোজা রাখবে, তার আগের গুনাহসমূহ মাফ করা হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের নিয়তে রমজানের রাত্রি ইবাদতে কাটাবে তার আগের গুনাহসমূহ মাফ করা হবে। আর যে ঈমান ও আত্মসমালোচনার সাথে কদরের রাত্রি তালাশ করবে তার পূর্বের গুনাহ মাফ করা হবে।” (বুখারী ও মুসলিম) অন্য হাদিসে আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা) বলেছেন, “পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে আমার উম্মতকে এমন পাঁচটি বস্তু দেয়া হয়েছে যা আগেকার নবীর উম্মতদেরকে দেয়া হয়নি-
১. রোজাদারের মুখের ঘ্রাণ আল্লাহর নিকট মেশকে আম্বরের চেয়েও অধিক প্রিয়,
২. সমস্ত সৃষ্টিকুল এমনকি সমুদ্রের মাছও রোজাদারের জন্য ইফতার পর্যন্ত দোয়া করতে থাকে,
৩. প্রতিদিন বেহেশতকে রোজাদারের জন্য সজ্জিত করা হয় এবং আল্লাহ পাক বলেন, আমার বান্দাগণ দুনিয়ার ক্লেশ যাতনা দূরে নিক্ষেপ করে অতি শীঘ্রই আমার নিকট আসছে,
৪. রমজানে দুর্বৃত্ত শয়তানকে শিকলাবদ্ধ করা হয়, যার দরুন সে ঐ পাপ করাতে পারে না যা অন্য মাসে করানো সম্ভব,
৫. রমজানের শেষ রাতে রোজাদারের গুনাহ মাফ করা হয়। (আহমদ, বায়হাকি)
হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “রোজা আমার জন্য, রোজার প্রতিদান আমি নিজ হাতে দিব।”
প্রিয় শ্রমজীবী ভাই ও বোনেরা
আপনারা কি জানেন রমজান মাসের এত গুরুত্ব কেন? রমজান মাসটি গুরুত্ব পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো এ মাসে নাজিল করা হয়েছে মানবতার মুক্তির সনদ মহাগ্রন্থ আল কুরআন। পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, “রমজান মাস, এ মাসেই নাজিল করা হয়েছে আল কুরআন, যা মানবজাতির জন্য পরিপূর্ণ হেদায়াত ও দ্ব্যর্থহীন শিক্ষা সংবলিত, যা সত্য-সঠিক পথ দেখায় এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়।” প্রকৃতপক্ষে আল কুরআন ইহলৌকিক মানবজাতির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পথনির্দেশক। রাসূল (সা) বলেছেন, “আল্লাহ তায়ালা কোনো জাতিকে এ কুরআন দ্বারা সমুন্নত করেন আবার কোনো জাতিকে অধ:পতিত করেন।” সুতরাং এ থেকে বুঝা যায়, আল্লাহর দেয়া কুরআন অনুযায়ী না চলে মানুষের মনগড়া বিধান দিয়ে চলার কারণে আজ মুসলমানদের এ অধ:পতিত অবস্থা। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে আমাদেরকে কুরআন পড়া, বুঝা ও কুরআনের আলোকে জীবন পরিচালনা করতে হবে। আর কুরআনের বিধিবিধান জানার ও বুঝার উপযুক্ত সময় এ রমজান মাস। আসুন আত্মগঠন ও ইনসাফপূর্ণ শ্রমনীতি বাস্তবায়নের দীপ্তশপথে উজ্জীবিত হয়ে কষ্টকর কায়িক শ্রমের পাশাপাশি নিন্মের বিষয়গুলো আন্তরিকতার সাথে পালন করার চেষ্টা করি-
১. ঈমান ও আত্মসমালোচনার সাথে রোজা রাখি।
২. জামায়াতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, তারাবিহ, তাহাজ্জুদ এবং নফল ইবাদতসমূহ অধিক পরিমাণে আদায় করি।
৩. সহিহশুদ্ধভাবে কুরআন পড়তে শিখার চেষ্টা করি।
৪. প্রতিদিন অর্থসহ কুরআন, হাদিস, মাসয়ালা-মাসায়েল ও আদর্শিক বই পড়ি।
৫. সুরা আল বাকারার ১৫৩-১৫৭, ১৮৩, ১৮৫; আলে ইমরান ১৯০-২০০; আত তাওবা ২০-২৭, ৩৮-৪২, ১১১; সুরা আল মুমিনুন
১-১১ সুরা ইয়াসিন, সুরা আর রহমান, সুরা আস সফসহ আমপারার সুরাসমূহ অর্থ ও তাফসিরসহ পড়া ও বুঝার চেষ্টা করি।
৬. রমজান মাসে অনৈতিকতা, নগ্নতা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, দুর্নীতি ও জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ গড়ে তুলি।
সংগ্রামী শ্রমিক ভাই-বোনেরা
আল্লাহ তায়ালার একমাত্র মানোনীত দ্বীন হলো ইসলাম। আর ইসলাম মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন উভয় জগতের নিশ্চিত কল্যাণ ও সাফল্যের একমাত্র ব্যবস্থা। সুরা আলে ইমরানের ১৯ নম্বর আয়াতে এরশাদ হচ্ছে, “নিঃসন্দেহে জীবনবিধান হিসেবে আল্লাহর কাছে ইসলামই একমাত্র ব্যবস্থা।” মানবজীবনের অন্যান্য দিক ও বিভাগের মতো কাজ-কর্ম, পেশা, শ্রম দেয়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাই শ্রমিক ও কর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষের জন্য সুনির্দিষ্ট সুন্দর নীতিমালার অভাবে বর্তমান আধুনিক বিশ্বে অস্থির ও বৈষম্যপূর্ণ শ্রমব্যবস্থা বিরাজমান। ফলে শ্রমিক-মালিকের মধ্যে শুধু হিংসা-বিদ্বেষ ও বৈষম্যই বৃদ্ধি পাচ্ছে। নির্যাতিত, বঞ্চিত মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্কের পরিবেশ তৈরি করতে ইসলামী শ্রমনীতির বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন ইসলামী শ্রমনীতি বাস্তবায়নের যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাতে শামিল হয়ে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার জন্য শ্রমিক ভাই-বোনদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
আপনাদের ভাই
অধ্যাপক হারুনুর রশিদ খান
ভারপ্রাপ্ত সভাপতি
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন